উপপাদ্য

দুপুর মিত্র
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

বইটি বিক্রির জন্য নয়। কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোন অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই যে কেউ নকল এবং পরিবেশন করতে পারবেন।

এছাড়া বইটি ই -মেইলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পাবেন। ই -মেইল ঠিকানা-mitra_bibhuti@yahoo.com

প্রকাশক

দুপুর মিত্র

প্রচ্ছদ

দুপুর মিত্র

দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
-মাহবুব বোরহান
দুপুর মিত্র বিজ্ঞানের ছাত্র। ছাত্রজীবনের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা সবটুকু বিজ্ঞান নিয়েই। বিজ্ঞান পড়েও বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে যে অবিজ্ঞান অন্ধত্বে আস্থা তা সওয়ার হতে পারে নি দুপুরের ঘাড়ে। শিরদাঁড়া শক্ত রেখে কলেজ জীবন থেকেই ও চলেছে যুক্তির পথে। এই পথ চলা ছিলো উদোম উন্মুক্ত। কোন ছল চাতুরি বা রাখ ঢাকের তোয়াক্কা করে নি ও। নিজে যা বিশ্বাস করে নি তা পরিবার, সমাজ ও স্বার্থের শাসনে বিশ্বাসের ভান করে চলা ওর ধাতে নেই। ঋজু দৃঢ়তায় অকপটে উচ্চারণ করেছে ওর চিন্তার দর্শন। বিজ্ঞানে তার আগ্রহ আর উৎসাহে যে ভাটা পড়ে নি তা বোঝা যাচ্চে তার কাব্যগ্রন্থ উপপাদ্য পড়েই। পঞ্চাশটি প্রশ্ন ও তার উত্তর অন্বেষাকে কবিতায় সাজিয়ে দুপুর মিত্র নির্মাণ করেছেন তার উপপাদ্য। এই প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্য দিয়ে বস্তুজীবনকে অবলম্বন করে কবি খুঁজেছেন মানুষের আরেকটু স্পষ্ট করে বললে বলা যায় আধুনিক মানুষের সমাজ ও মনোজগতের সারৎসারকে। এই সময় ও তার সামূহিক যন্ত্রণা রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দর্শনকে স্পর্শ করে আমাদের সামনে ব্যক্ত হয় কবির অন্তর্গত উপলব্ধির সত্যকে আশ্রয় করে। আমরা কেউ তার সাথে একমত হতে পারি। কেউ বা পারি তা প্রত্যাখান করতে কিন্তু কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না। ডিজিটাল বাস্তবতার যাঁতাকলে পড়ে আমরা চিন্তা থেকে নির্বাসন নিয়েছি। কেউ এখন আর চিন্তার ধার ধারে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি আর লাগামহীন ভোগবাদের বিচার বিবেচনাহীন অনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া যা সামনে হাজির করে তারই স্বকীয় সংস্করণ আমরা উদগীরণ করে চলি। বিশেষভাবে তরুণ সমাজ। চিন্তাগতভাবে আমরা প্রায় দেউলিয়া হবার পথে। এই রকম একটি সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় দুপুর মিত্রের উপপাদ্য আশা জাগানিয়া এক অনন্য সংযোজন।
বিদ্যার বাচালতায় প্রবেশ না করে আমি কয়েকটি উপপাদ্য শুধু তুলে ধরছি। যে পাঁচটি কারণে মানুষ গভীর রাতে কাঁদে (১), মানুষের মন কেন জলের মত ? (১৩), পাথরে পাথর ঘষলে আলো জ্বলে কেন? (১৫), আমাদের সাথে চাঁদ হাঁটে কেন? (১৮), ল্যাম্পপোস্ট সারারাত জেগে থাকে কেন? (২৪), মোম আলো জ্বালাতে জ্বালাতে হারিয়ে যায় কেন? (২৫), শীতকালে পাতা ঝরে পড়ে কেন? (২৭), আমাদের বাড়ি হলো না কেন? (৩২), আমাদের ভয় কাটে না কেন? (৩৪), শিশুরা বন্দুক দিয়ে খেলে কেন? (৩৭), এত শুধু ব্যর্থ সার্টিফিকেট কেন? (৩৯), অন্ধকারে কিছু মানুষ দেখে কেন ? (৪১), আমি বারবার ঠকে যাই কেন? (৪২), গাছ বা পুরুনো দেয়ালে নাম লিখে রাখে কেন? (৪৫), ভালবাসা মানুষকে অসহায় করে ফেলে কেন? (৪৮), যন্ত্রণা থেকে কবিতার জন্ম হয়ে কেন” (৪৯), গাছ মাটি থেকে তুললে মরে যায় কেন? (৫০)। কয়েকটি নমুনা দিলাম। কৌতূহলী পাঠককে সবগুলো উপপাদ্য পড়ে দেখতে বলি। আমার ধারণা কেউ পড়া শুরু করলে শেষ না করে ছাড়তে পারবেন না।
শিল্পের শেষ বিচারক সময়। উপপাদ্য সম্পর্কে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এ একেবারে ভিন্ন রকম। কারো মতোই নয়। গণিতজ্ঞ কবি বিনয় মজুমদারের কবিতা স্মরণে রেখেই বলছি।
একটি বিষয় বিজ্ঞানের ছাত্র এমন পাঠকের দৃষ্টি কাড়বে। তা হলো জ্যামিতিতে উপপাদ্য হলো প্রমাণিত ধ্রুব সত্য বা তত্ত্ব গণিতের ভাষায় যাকে বলা হয় সূত্র। যেমন ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ। বা ত্রিভুজের যে কোনো দুই বাহুর দৈর্ঘ্যের যোগফল তৃতীয় বাহুর দৈর্ঘ্য অপেক্ষা বড়ো। কিন্তু দুপুর মিত্র এমন কোন সূত্রকে তার কবিতায় তুলে ধরেন নি। শুধু প্রশ্ন তুলে তার উত্তর অন্বেষণ করেছেন। সূত্র দিয়ে বেঁধে দেওয়াকে পরিহার করে প্রশ্ন-উত্তর পর্যবেক্ষণ কবির অফুরান অনুসন্ধান প্রবণতারই পরিচায়ক। কবির কেন পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান সন্ধানের অনিরুদ্ধ পথযাত্রাও এমন নয় কি! প্রশ্ন উঠতে পারে তা হলে উপপাদ্য নাম কেন? এই জন্য যে উপপাদ্যের কাজ যুক্তি পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণসাপেক্ষ। এই কাজটিই কবিতার মধ্য দিয়ে করেছেন দুপুর মিত্র।কবিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ছাপানো সংস্করণ ছাড়া শুধু অনলাইন ভার্সন কেন? কবির সাফ জবাব টাকা নাই। বুঝলাম আরেকবার মানি ইন রং হ্যান্ড।

০৩.০২.২০২৩
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

১।

যে পাঁচটি কারণে মানুষ গভীর রাতে কাঁদে

আশি ভাগ মানুষ মনে করে কাউকে ভালবাসলে একা হয়ে যেতে হয়।

শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মনে করে সে খুব ক্লান্ত এবং দিন দিন জীবনটাই ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে।

শতকরা ৮৫ ভাগ লোক বুঝতে পারে সে যাকে চায় তাকে পায় না এবং কোনদিন পাবেও না।

শতকরা ৯৫ ভাগ লোক মনে করে মানুষের জীবন আকাশের তারার মত নিশ্চুপ ও নির্জন।

৯৯ ভাগ মানুষ নিজেকে উপেক্ষিত মনে করে। মনে করে নিজের পায়ের চূর্ণ মাটির মত প্রত্যেকের পায়ের চাপে প্রত্যেকের জীবন বিপর্যস্ত।

২।

যে ৫ টি কারণে সাদা ফুল রাতে ফুটে

সাদা ফুল রাতে ফুটে,

কারণ তার ধারণা রাতের অন্ধকারে সমস্ত কিছু যখন নিকষ কালো, তখন সাদা ফুল ফুটলে এটিই সবার নজরে পড়বে।

কারণ অন্ধকারে সবাই যখন ঘুমন্ত তখন জেগে থাকা জীবের রাণী হয়ে সেই পারবে নাচতে।

কারণ ওর তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে সকলের অগোচরে তার কাছে যেতে পারবে অনেক পুরনো বন্ধু।

কারণ ও জানাতে চায় সকালই কেবল ফুল ফোটার সময় নয়, ফুল ফুটতে পারে যে কোন সময়।

কারণ রাতের তীব্র অন্ধকারকেও পরিহাস জানাতে পারে কিছু ফুল।

৩।

যে ৫টি কারণে মানুষেরা চুরি হয়

অনেকের ধারণা যারা রাতের বেলা ঘর থেকে ঘুমের ঘোরে বের হয় তাদেরকে নদীরা চুরি করে নিয়ে যায়।

কিছু মানুষকে চুরি করে পথ।

আর কিছু মানুষ সমুদ্রে বেড়াতে গেলে চুরি হয়ে যায়।

যে সমস্ত মানুষ রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে তারাও চুরি হয়ে যায়।

যারা বনের কাছে গিয়ে মুগ্ধ হয় বেশি তারা খুব তাড়াতাড়ি বনেই চুরি হয়ে যায়।

৪।

যে ৫টি কারণে দূর থেকে দেখে চলে যায় কেউ কেউ

কেউ কেউ ভাবে এতটুকুই সব, যাকে ভালবাসে তাকেই তো দূর থেকে ভাল আছে দেখে খুশি মনে চলে যাওয়া যায়।

কেউ কেউ ভাবে সে যদি দেখে ফেলে দীর্ঘদিন পরে তার এই পঁচে যাওয়া দেহ।

আবার দূর থেকে দেখলে বোঝা যায় না কে তাকিয়ে আছে কার দিকে।

দূর থেকে দেখলে কেউ এত ভেঙে পড়ে না,

কাছাকাছি দেখলে মনে হবে আরও কাছে এসে দেখি তারে, তাই দূর থেকে দেখে অনেকেই।

৫।

যে পাঁচটি কারণে শীতরাতে ঘুম ভেঙে যায়

কারণ প্রতিটি শীতরাতে করুণ আর্তনাদে কাঁদে পাখি।

সারারাত আকাশের কান্নার শব্দে যেন ভেঙে পড়ে টিনের চাল।

কারণ গভীর রাতে বাতাসের শব্দে উথাল পাতাল করে গাছের পাতারা।

অন্ধকার গাঢ় হয়, মনে হয় মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে আছে সমস্ত চরাচর।

কারণ কুয়াশার শব্দে ভিজে জুবুথুবু কাঁপতে থাকে আমার হৃদয়।





৬।
যে পাঁচটি কারণে প্রেম মুছে যায়

কারণ জীবনের প্রেমে পড়ে শীতকালে মুছে যায় পাতাদের প্রেম।

হাজার চেষ্টা করেও প্রকৃতির নিয়মে জলের স্রোতে ভেঙে যায় পাতাশ্যাওলার সংসার।

চিরকাল ডুবে থাকে রঙধনু আকাশে, হঠাৎ হঠাৎ দেখা মেলে তার।

ঝড়ের রাতের শেষে কত পাখির বাসা যে আর যায় না খুঁজে পাওয়া।

তুমিও মানিয়ে নিয়েছ, আমিও নিয়েছি মেনে, তাই মুছে যাওয়া৷

৭।
যে পাঁচটি কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে

যখন সে দেখে সে নিজেই নিজেকে ভালবাসে না।

যখন সে দেখে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা গাছও বাঁচতে দেয় না তার কাছের গাছকে।

যখন সে জানে সকল ফুলেরা মূল্যবান হয়ে ওঠে মৃত্যুর পর।

যখন সে জানে মৃত্যুর পর মানুষেরা মৃতব্যক্তিকে অনেক গুরুত্ব দেয়।

যখন সে টের পায় মৃত্যুও এক ধরনের সুখ।

৮।
যে পাঁচটি কারণে মানুষ নদীতীরে যায়

কিছু মানুষ মনে করে রাতের বেলা কেউ কেউ নদীর ডাক শুনতে পায়।

কেউ কেউ মনে করে যে নদী যত বেশি গভীর, সে নদীর কাছে যা চাওয়া যায় সেই মনস্কামনা পূরণ হয়।

কারও কারও মতে নদীর বুকে যে হাওয়া বয় তা রোগ বালাই সারিয়ে দিয়ে যায়।

কেউ কেউ মনে করেন নদীতে সত্যি সত্যি মৎস্যকুমারি থাকে, মৎস্যকুমারি যাকে ধরা দেয় তার ঘরে কোন অভাব থাকে না।

নদীতে গভীর রাতে নৌকা ভেসে উঠে, যে এর দেখা পায়,তার ঘরে ফেরা হয় না কখনো।

৯।
যে পাঁচটি কারণে মানুষেরা বৃষ্টিতে ভিজে

অনেক মানুষ মনে করে বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর পবিত্র হয়।

কেউ কেউ মনে করে বৃষ্টিতে ভিজলে মনও পবিত্র হয়।

কারো কারো মতে বৃষ্টি একটি বিশেষ দান, তাই বৃষ্টি নামলে উৎসব করে।

বৃষ্টি নামলে কারও মন শীতল হয়, অনেক বেশি ভালবাসতে ইচ্ছে করে কাউকে।

বৃষ্টি নামলে কেউ কেউ বাইরে বেরিয়ে আসে, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ একসাথে গাইতে থাকে বৃষ্টির গান।

১০।
যে পাঁচটি কারনে মানুষ সমুদ্রে যায়

অধিকাংশের মতে সমুদ্র মানুষকে বিশালত্বের আনন্দ দেয়,

কারও কারও সমুদ্রের কাছে গেলে নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হয়,

সমুদ্রের কাছে গেলে অনেক মানুষ ডুবে যেতে চায়।

কারও মতে সমুদ্রের বাতাস মানুষকে মৃত্যুর গান শোনায়।

কেউ কেউ বলেন কোন কোন মানুষকে সমুদ্র কাছে ডাকে, যাকে ডাকে সমুদ্র তাকে নিয়ে যায় সাথে করে।

১১।
মানুষ কেন পাহাড়ের কাছে এসে চিৎকার করে

কারণ এত এত পাহাড়ের কাছে নিজেকে এতটা ক্ষুদ্র মনে হয় যে চিৎকার করে তার অস্তিত্ব আছে কিনা চেখে দেখে।

কারণ তার চেয়েও পাহাড় এত বড় এটা সে মানতে পারে না

সে যখন উপরের দিকে তাকায় নিজের অসহায়ত্বকে মেনে নিতে পারে না।

সে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে থাকে, যেন তার অনেক হিসাব আছে পাহাড়ের কাছে।

কারণ সবাই না জানলেও কেউ কেউ জানে পাহাড়ও জীবন্ত, পাহাড়ও ফেলে দেয়, গোপনে হত্যা করে কাউকে কাউকে।

১২।

মেঘ কখনো কাছে আসে না কেন?

মেঘ কখনো মানুষের কাছে আসে না, কারণ সে জানে তার কোন আকার নেই।

কারণ সে জানে মেঘ দূরে থাকলেই বৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়।

দূরে থাকলেই তাকে নানান রকম দেখায়,

কারণ শুধু কালো নয়, হাজারো বিচিত্র বর্ণের দেখা মেলে শরীরে তার।

দূরে থাকা মেঘেরাই পিঠে জীবন চড়িয়ে আনে, সে জীবনের দেখা মেলে পৃথিবীতে।

১৩।

মানুষের মন কেন জলের মত?

মানুষের মন জলের মত কারণ এর কোন আকার নেই।

কারণ জল কঠিন থেকে তরল, তরল থেকে বায়বীয় আবার বায়বীয় থেকে তরল, তরল থেকে কঠিন সহজেই হতে পারে।

কারণ জলের প্রবাহ নিম্নমুখী।

জল যে পাত্রে রাখা যায় আকার ও রং সেই পাত্রের মতই দেখায়।

কারণ জল যখন স্রোতস্বিনী হয়ে উঠে, তখন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

১৪।

কখনো কখনো রাত কেন ফুরায় না?

কখনো কখনো রাত ফুরাতে চায় না। কারণ রাতেরও কথা থাকে অনেক।

আমরা যে রাতকে ফাঁকি দিয়ে চিরকাল ঘুমিয়ে গিয়েছি, সে কথা সেও জানে।

আমাদের অলক্ষ্যে কে পৃথিবীকে দিয়ে গেছে মৃত্যুর মন্ত্র, বলতে হবে তাকে।

বলতে হবে সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাতও খুব একা হয়ে যায়।

বলতে হবে ভোরের ঠিক আগে তারও মনে হয় এক গাছি দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়তে চাঁদের গলায়।

১৫।
পাথরে পাথর ঘষলে আগুন জ্বলে কেন

পাথরে পাথর ঘষলে আগুন জ্বলে। কারণ দীর্ঘদিন আগুন পুষে রাখে সে।

সে নির্জীব, মৃত, নিথর সাড়া শব্দহীন হয়ে দিনের পর দিন শুয়ে থাকে।

মনের ভেতরের ন্যূনতম ইচ্ছাটাও মরে যায় তার।

পথে পথে পড়ে থাকে। মানুষের লাথ্থি গুতা খেতে খেতে কোন অনুভূতিই থাকে না আর।

তাই একদিন সুযোগ পেলে, কাউকে সাথে পেলে শেষ চেষ্টা করে মাথা তুলে বেঁচে থাকবার।

১৬।
আগুন নেভার পরও তাপ থেকে যায় কেন

আগুন নেভার পরও তাপ থেকে যায়। কেননা কত না উত্তাপেই না জ্বলে উঠেছিল সে।

যে স্বপ্নের ঋণ নিয়ে পাতা মেলে দিয়েছিল, তারই দেনায় সব পাতা এখন পড়ছে ঝড়ে।

যে জ্বলে উঠা আলোয় হেসে উঠেছিল প্রেমিকার মুখ, সে আলোয় চায় সে মুখ ঝলসে দিতে।

যে ব্যাগ নিয়ে সে বাজারে যায়, সেই ব্যাগ ভরে নিয়ে আসে ক্রোধ আর ব্যর্থতা।

তাই সে মাঝে মাঝে জ্বলে উঠে নিভে যায়, উত্তাপ বয়ে বেড়ায় সারাজীবন।

১৭।
গাছের নিচে ছায়া পড়ে কেন

গাছের নিচে ছায়া পড়ে৷ কারণ সে চায় তার বীজগুলো যেন ছায়ায় থাকে, রোদের তাপে শুকিয়ে না যায়।

তার ছায়ার তলে বীজগুলো থেকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠে ভ্রূণ, তারপর হেসে হেসে মেলে ধরে পাতা আর মূল।

কারণ সে চায় তারই ছায়ার তলে হেসে খেলে যেন দৌড়োয়, বৃক্ষ বড় হয়, বড় হয় তার ছায়া, আর ছায়ার নিচে বড় হয় সন্তানেরা।

কারণ তা না হলে রোদে শুকিয়ে যেত, হাওয়ায় ওড়ে যেত, বৃষ্টিতে ভেসে যেত তারা।

যেভাবে আমরা বড় হই, আমাদের পিতা, প্রপিতামহের ছায়াতলে, বড় হই আর শূন্যে মিলিয়ে দেই কতসব মায়া।

১৮।

আমাদের সাথে চাঁদ হাঁটে কেন

আমাদের সাথে সাথে চাঁদও হাঁটে। তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। যেভাবে আমরাও তাকিয়ে থাকি তার দিকে।

আমরা থেমে গেলে সেও থেমে যায়, কখনো আড়ালে থেকে লক্ষ্য করে চলে আমাদের।

কারণ সে আমাদের চোখে চোখে রাখে। আমরা কি করি সব সে লক্ষ্য করে।

কারণ যে সূর্য জন্ম দিয়েছে আমাদের, সেই সূর্যই চাঁদ সেজে খেয়াল রাখে আমাদের, যেভাবে মা দেখে রাখে বাচ্চাদের ।

চাঁদ তার রূপ দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে। যেন আমরাও তাকিয়ে থাকি তার দিকে। যেন সূর্যকে ভুলে না যাই।

১৯।
সুন্দরবনের গাছেদের শ্বাসমূল থাকে কেন

সুন্দরবনের অনেক গাছের শ্বাসমূল থাকে। মাটির নিচে নয়, মাটির উপরে চোখ মেলে দেখে কে আসে কে যায়।

কারণ মাটির নিচে অনেক কান্না। কান্নায় লবনাক্ত মাটিজল। যে লবনাক্ত কাঁদা মাটি থেকে অক্সিজেন নিতে পারে না। বন্ধ হয়ে আসে শ্বাস।

কারণ খাবারে এত বেশি লবন যে রুচি চলে যায়। পেট ভরে আসে৷ বমি চলে আসে লবনাক্ততায়।

যে মূলের ধর্ম মাটির নিচে ডুবে থাকা, সে কখনই দেয় না ডুব। শঙ্কা পিছু ছাড়ে না তার। বুক ভরে নিয়ে চলে শ্বাস।

বেঁচে থাকার তাগিদে কত কিছুই না করতে হয়। কত কিছু ভাঙে গড়ে, হারিয়ে যায় পুরনো অভ্যাস।

২০।
গাছে পাখির বাসা থাকলেও গাছ পাখিকে চেনে না কেন

গাছে পাখির বাসা থাকলেও গাছ পাখিকে চেনে না। পাখি পরম যত্ন নিয়ে গাছের শাখা প্রশাখা আর পাতা একসাথে করে তাতে খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। যে গাছ পাখিকে আশ্রয় দেয় সেই তাকে চেনে না।

হয়ত গাছ প্রয়োজনই মনে করে না। কাউকে সাহায্য করতে হলে তাকে চিনতে হবে কেন, এই কথা ভাবে।

অথবা তার বুকের ভেতর অজস্র পাখি অজস্র প্রাণ বেঁচে থাকবে, এই কি কম সুখ।

হিংসা করে করে কাউকে আহত কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে কে বাড়ায় অসুখ।

পাখি হয়ত বা চেনে, কোন গাছে বানাতে হবে বাসা কিন্তু গাছ চেনে না, হয়ত মনেও রাখে না কারও মুখ।

২১।

যে যেতে চায় তাকে কেন যেতে দিতে হয়?

যে যেতে চায় তাকে যেতে দিতে হয়। কেননা জোর করে আটকে রাখা পাখিও মরে যায়।

দুর্দান্ত প্রতাপশালী সিংহও ক্রমশ দুর্বল হয়ে মরার মতন পড়ে থাকে চিড়িয়াখানায়।

গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নেয়া নদীও শুকিয়ে যায়।

ভালবেসে যে টবের ফুল গাছ ঘরে এনে রাখ, জল দাও নিয়ম করে, সেও মরে।

জোর করে রেখ না কাউকে, জোর করে রাখা প্রেম দুর্গন্ধ ছড়ায় ঘরে।

২২।
কুয়াশায় ঘাস ভিজে থাকে কেন?

কুয়াশায় ঘাস ভিজে থাকে। কেননা কুয়াশায় ভেজা শরীর চিকচিক করে রোদে।

মানুষের চোখে পড়ে তার শরীর। হাল্কা বাতাসে হেলতে দুলতে আড়ালে তাকায় সে।

তার মন আনন্দে নেচে উঠে। যে কখনো কোন মানুষের নজরে আসতে পারেনি, আজ সে এসেছে।

কারণ কুয়াশায় ভেজা থাকা শরীর নরম হয়। সেই নরম শরীর হাত বুলিয়ে দেখে মানুষ।

সারারাত কুয়াশার ভালবাসায় ভিজতে ভিজতে যদি ক্লান্তি না আসে, কুয়াশার কি দোষ।

২৩।
কখনো কখনো মনে হয় কেন সব কথা বলা হয়ে গেছে

কখনো কখনো মনে হয় সব কথা বলা হয়ে গেছে। কারও মুখ থেকেই কোন কথা বেরুয় না।

চুপ মেরে বসে থাকি নিথর পাথরের মত।

হয়ত এই কারণে যে আমরা জেনে গেছি স্থির নিরব বসে থাকার মধ্যেও একটা ভাষা আছে।

হয়ত আমরা জেনে গেছি অজস্র কথা বলেও যে কথা বোঝানো যাবে না, সেই কথা নিমেষেই বোঝা যাবে নিরবতায়।

হয়ত এই কারণে যে কথার ভিতরে যে গোপন কথা থাকে তার প্রকাশ হয় না কথায়।

হয়ত এই কারণে বসে থাকে, চুপচাপ পাথরের মত, সমুদ্রের জল এসে আছড়ে পড়ে পাথরের গায়ে পরম মমতায়।

২৪।

ল্যাম্পপোস্ট সারারাত জেগে থাকে কেন?

ল্যাম্পপোস্ট সারারাত জেগে থাকে, আলো জ্বলে, পোকারা এসে ভিড় করে তার নিচে।

জেগে জেগে দেখে অন্ধকার কতখানি গাঢ় হয়।

কোন ঘরে গভীর রাতে অসুখ ঢুকে।

জেগে থাকে কারণ সে জানে কোন কোন রাতে কাউকে কাউকে বেরিয়ে পড়তে হয়, আর তার পথে জ্বালাতে হয় আলো।

সারারাত যে পাখি কাঁদে, কুয়াশার গানে ঘুমিয়ে পড়ে শহর জানে না, শুধু ল্যাম্পপোস্ট জানে কে তাকে কাঁদালো।

২৫।

মোম আলো জ্বালতে জ্বালতে হারিয়ে যায় কেন?

মোম আলো জ্বালতে জ্বালতে হারিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় বাতাসে। কিছু অবশিষ্ট গলে পড়ে থাকে নিচে।

কেননা যে আলো দেয়, সে আলো জ্বালাতেই ব্যস্ত থাকে, ব্যস্ত থাকে আলো ফোটাতে।

কারণ যে ভালবাসে সে সবটা দিয়েই ভালবাসে।

সবটাই পোড়ে, পুড়ে পুড়ে জ্বলে আগুন। দেহ যত পুড়তে থাকে, আলো তত উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

আলো তত প্রকাশিত হতে থাকে। বাতাসে নুয়ে পড়া শিখা আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু অবশিষ্ট থাকে পড়ে।

কেননা মোম পোড়ে বলেই, বাতাসে মিলিয়ে যায় বলেই, হারিয়ে যায় বলেই হেসে ওঠা মুখ ভাসে নিকষ কালো অন্ধকারে।

২৬।

তাকালেই সব হয় না কেন?

তাকালেই সব হয় না। মুখের দিকে মুখ, চোখের দিকে চোখ রাখলেই ভেসে ওঠে না সুখ।

তোমার দিকে তাকিয়ে কত তারা পড়েছে খসে রেখেছিলে কি কোন খোঁজ।

কেননা বুকের ভেতরেও আলাদা ভাষা থাকে, হৃদয় থাকে, কজন বুঝতে পারে দেখে মুখ।

কেননা যে ভাষা হৃদয়ের, যে ভাষা স্বপ্নের – যে ভাষা প্রেমের সেই ভাষা সহসা উঠে না ফুটে।

কতকিছু গোপন থেকে যায়, কতকিছু জানা হয় না, হাসির আড়ালে কতকিছু পঁচে দুর্গন্ধ হয়ে উঠে৷

২৭।

শীতকালে পাতা ঝড়ে পড়ে কেন?

শীতকালে পাতারা ঝরে পড়ে। গাছেরা শুষ্ক ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একা, নিথর পাথরের মত, তীব্র কনকনে বাতাসে কাঁপে।

কেননা শীতকাল এলেই সবকিছু শুকিয়ে যায়।

শীতকাল এলেই দুঃখগুলো দুলতে থাকে হাওয়ায়।

কেননা শীতকাল এলেই তোমার কথা মনে পড়ে খুব।

পাতারা ঝড়ে পড়ে। যেন তোমার শোকে না মরে গাছ, যেন জলের ভেতরে প্রাণ বেঁচে থাকে দিয়ে ডুব।

২৮।

কখনো কখনো চাইলেও ফিরে আসা যায় না কেন?

কখনো কখনো চাইলেও ফিরে আসা যায় না। সমস্ত পরিস্থিতি অনুকূলে জেনেও, এমনকি তুমি প্রাণপনে চাও জেনেও ফিরে আসা যায় না আর।

কেননা যে ঝড়োবাতাস একবার বয়ে যায়, তছনছ করে যায় ঘরবাড়িসংসার, সেসবের কি আদৌ শক্তি থাকে ফিরবার।

কিংবা নদীতে বেড়াতে এসে যার প্রেম খেয়ে নিয়েছে কুমিরে সে জানে ভাল, ফিরে আসবার কতখানি চেষ্টা ছিল তার।

অথবা সেই মায়েরও অগাধ বিশ্বাস, ছোটবেলায় যাকে পরী নিয়ে যায়, সে আর আসে না ফিরে।

তোমার মুখের আর্তনাদ আমি দেখেছি, দেখেছি তোমার চোখ বেয়ে বয়ে চলেছে নদী, কী আশ্চর্য শয়তান সময়; পাশাপাশি বসে আছি, অথচ আমাদের শক্তি নেই ফিরবার।

২৯।

মাঝে মাঝে আমি কেন পালিয়ে থাকি?

মাঝে মাঝেই আমি পালিয়ে থাকি। সবার থেকে। কখনো লজ্জায়। কখনো হেরে যাওয়ার গ্লানিতে। কখনো৷ ব্যর্থতায়।

কারণ যে প্রতিমার মুখ ভেঙে ফেলা হয়েছে তা আর জোরা লাগাতে পারি না।

ছোটবেলায় যেমন দিদিরা ঘরে আসলে পালাতাম, লজ্জায় বালিশে মুখ গুজে রাখতাম। ঠিক তেমনই এখনো।

এখনো আমি সবার থেকে পালাই, কারণ সবাই কত বড় হয়ে গেছে, আমি কেবল রয়ে গেলাম ছোট।

এই যে বছরের পর বছর একসাথে আছি, তুমি জান না, তোমার থেকেও পালাই আমি, সময় হলে লুকিয়ে পড়ি দ্রুত।

৩০।

কিছু কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায় কেন?

কিছু কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়। চাইলেও আর করা হয়ে উঠে না। মনে হয় করব, তারপর ভুলে যাই।

এর কারণ হয়ত এই যে কিছু কাজ করার পর আগ্রহটা কমে যায়। মনে হয় এইসব করে কি হবে আর।

হয়ত এই কারণে যে কিছু দূর বাতাস এগিয়ে এসে ঘুরে যায়। মনে পড়ে এই গ্রামে বাজে শুধু দুঃখের সেতার।

কিছু কাজ আর হয় না। চেয়ে দেখি পড়ে আছে যত্র তত্র।

কেননা কিছু কাজ কখনই শেষ হবে না। কিছু কাজ ভুলে ভরা, ইচ্ছে করে তোমার সামনে পড়া ভুল মন্ত্র।

৩১।

কেন তোমার থেকে বিশ্বাস হারালাম

আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তোমার পাশে বসতে। মার্কসবাদ, রাশিয়ার ভাঙণ, কমিউনিস্ট পার্টির ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলতে।

কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি না এখনো, কিভাবে তুমি নিষিদ্ধ পার্টিতে চলে গেলে আমার সাথে চলতে চলতে৷

কিন্তু গোলাপ হাতে নিয়ে যে তুমি শাহবাগে বসে ছিলে আমার অপেক্ষায়, সেই তুমি কিভাবে ছুরি মেরে দিলে পিছন থেকে।

আমার কিন্তু সরে না, তাকিয়ে থাকি অতীতের দিকে।

প্রেমের একি মৃত্যু, পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীরাও প্রেমিক স্বামীকে হত্যা করে গলা টিপে।




৩২।

আমাদের বাড়ি হল না কেন?

আমার বাবা বাড়ি করতে চেয়েছিলেন।চেয়েছিলেন আমার দাদা, হয়ত তার দাদাও। কিন্তু বাড়ি করা হয়নি।

একবার নদীর তীরে বাড়ি করতে চাইলেন আমার দাদা। নদীর হাওয়া নাকি শরীরের জন্য ভাল। নদীর মাছ বেশ সুস্বাদু। জায়গাও কিনেছিলেন। যে বছর কিনেছিলেন, সে বছরই নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায় সে জায়গা।

আমার বাবা বনের ভেতরে বাড়ি করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন মানুষের থেকে বনের পশুরা অনেক ভাল। কিন্তু যেদিন জায়গা কিনে ইট সুরকি রেখেছিলেন, সেদিনই বনদস্যুরা হামলা করে। আর বাড়ি করা হয়নি।

হয়ত আমার অন্য দাদারাও গ্রামে বাড়ি করতে চেয়েছিলেন। করেছিলেনও নাকি। গ্রামের বাতাস অনেক ফ্রেশ। গ্রামের সবজি, গ্রামের মানুষ সবই সুন্দর। এক রাতে গ্রামের মানুষেরা ডাকাতি করে মেরে ফেলল দাদাকে। আহা সে বাড়িও গেল।

আমরা শহরে থাকি। ভাড়া বাসা। আমাদের কোন বাড়ি নেই। একটুকরো জমি কিনেছিলাম বাড়ি করব বলে। কিন্তু সে জমিও এখন শত্রু হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি নেই। বাড়ি হবে না কখনও।

৩৩।

পুরনো সোয়েটার মানুষ বদলায় কেন?

পুরুনো সোয়েটার মানুষ বদলায় কেন জানিনা। গত বছর লাল রঙের সোয়েটার ছিল, এবছর নীল সোয়েটার কিনে পড়ছে।

কিন্তু পুরুনো সোয়েটারই আমার ভাললাগে ভীষণ। যতদিন যায় ও যেন তত উজ্জ্বল হতে থাকে।

পুরুনো সোয়েটার পড়লেই আমার তোমার ঠাণ্ডা হাতে হাত রেখে গরম করে দেবার কথা মনে পড়ে।

পুরুনো সোয়েটারে কতশত মিষ্টি রোদ লেগে থাকে।

কিন্তু আমার লাল সোয়েটার এ বছর আর কেউ বের করেনি। বাজার থেকে নীল সোয়েটার এনে রেখেছে ঘরে।

৩৪৷

আমাদের ভয় কাটে না কেন?

যে গোলাপের ডাল ধরতে ভয় লাগে, শরীরে কাঁটা দেখে আঁতকে উঠি, সেই গোলাপেই হাসে প্রেম। কিন্তু ভয় কাটে না।

যে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হল, শরীর থেকে ছিটকে গেল আমার হৃদয়, ছটফট করতে করতে থেমে গেল, সেই গাড়িতে করেই যেতাম তোমাদের বাড়ি।

যে কালো মেঘ আঁধার নিয়ে এল পৃথিবীতে, কাল বোশেখিতে উড়িয়ে নিয়ে গেল বাড়িঘর শৈশব, সেই কালো মেঘই সাদা তুলা হয়ে ঢুকে পড়ল বালিশে আমার।কিন্তু ভয় কাটে না।

মনে হয় আমার চারপাশে জ্বলছে আগুন, আর একটু হলেই আগুনে পুড়বে শরীর, অথচ সেই আগুনেই পার্টিতে বেশ করে পোড়ানো হচ্ছে একটি বড় হাঁস।

যে রোদের তাপে ফেটে যাচ্ছে মাটি, বিরাণ হচ্ছে হাজার হাজার একর জমি, সেই রোদের তাপেই আমি শীতকালে দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। কিন্তু ভয় কাটে না।

৩৫।

তেমন চা আর হয়নি কেন কখনো?

বিকালের রোদ এসে পড়েছিল তোমার মুখে। রবি ঠাকুরের গান গাইতে গাইতে চা এনে হাতে দিয়েছিলে তুমি। আহা তেমন চা আর হল না কখনো।

মিছিলের আগে পড়ে টং ঘরে কত চা আড্ডা, তেমন চা আর হল না। তুমি আমার সামনে থাকার পরও ভাল লাগল না কোনদিন কোন চা।

আমি চেয়েছিলাম, মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে যে ঘাম পড়ে ঝড়ে, তুমি তা মুছে দিবে। হয়ত তুমি চাওনি তা এজন্য হয়ত।

হয়ত আমি চাইতাম তুমিও আমার হাতে হাত রেখে মানববন্ধন কর, তুমি করনি। এজন্য হয়ত।

আমি জানি না। শুধু সেদিনের চায়ের স্বাদ আমার মনে পড়ছে বেশ। মনে পড়ছে বিকালের সূর্যটা সেদিন অনেক লাল হয়ে ফুটে উঠেছিল।

৩৬।

আমরা পেন্সিল দিয়ে লেখি না কেন?

আমরা কলম দিয়ে লিখি। পেন্সিল দিয়ে লিখি না।

এই কারণে যে পেন্সিল দিয়ে লেখা স্পষ্ট হয় না।

অথবা হয়ত এই কারণে যে পেন্সিল দিয়ে লেখা সহজে ইরেজার দিয়ে মোছা যায়।

আমাদের জীবনের প্রতিটি অক্ষর আমরা কলম দিয়ে লিখি।

আবার কখনো মনে মনে ভাবি জীবনের প্রতিটি অক্ষর যদি পেন্সিল দিয়ে লেখা যেত, তাহলে ইরেজার দিয়ে ভুলগুলো মুছে কত সহজেই না ঠিক করে দেয়া যেত।

৩৭।

শিশুরা বন্দুক দিয়ে খেলে কেন?

শিশুরা কতকিছু দিয়ে খেলে।

কোন কোন শিশু খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলে।

কোন কোন শিশু ছোট ছোট হাড়ি পাতিল দিয়ে রান্নাবান্না খেলে।

তবে অধিকাংশ শিশুকে আমি বন্দুক দিয়ে খেলতে দেখেছি। মিথ্যে মিথ্যে মানুষ মারার খেলনা পিস্তল।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমি মানুষকে ভালবাসার খেলনা দেখিনি শিশুদের হাতে, মানুষকে ভালবাসার খেলনা থাকে না বাজারে।

৩৮৷

কেউ আর ফিরে না কেন?

কেউ কেউ ফিরে না। ফিরে আসার কথা বলে চলে যায় কিন্তু কোনদিন ফিরে না।

ঘুড়িটিও ফিরেনি। একবার সুতাকাটা ঘুড়িকে বলেছিলাম ফিরে এস ভাই আবার আমাদের বাড়িতে, ফিরে আসেনি। কারণ সুতাকাটা ঘুড়ি ফিরে আসে না।

যেবার জেলেরা বাসায় বলে এল এবার অনেক ইলিশ ধরব, সেবারও ফিরেনি। কারণ জেলেরাও সুতাকাটা ঘুড়ির মত।

যেদিন বন্ধুকে বলেছিলাম সংসার মায়ার মত, সেদিন রাতেই ঘর ছেড়েছিল সে, কারণ সে সম্ন্যাসী হবে। ফিরে আসেনি সে।

কেউ ফিরে না। শুধু সারারাত কুয়াশার কান্না শোনা যায় ধূ ধূ প্রান্তর জুড়ে।

৩৯।

এত শুধু ব্যর্থ সার্টিফিকেট কেন?

তোমাকে পাবার আশায় লাউ গাছের লতার মত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ি। মাচা না পেয়ে নুইয়ে পড়ি মাটিতে। তবু ব্যর্থ সার্টিফিকেটের কথা মনে পড়ে।

হয়ত এই কারণে যে আরও একটু এগুলেই লাউয়ের লতাটি পেরিয়ে যেত দেয়াল। আর ব্যস এর পরেই অবারিত মাঠ।

অথবা হয়ত এই কারণে যে যাকে অবলম্বন করে তার বেড়ে উঠা, সেই অবলম্বনটিই একদিন গেছে সরে।

তবু তো সার্টিফিকেট, সূর্যের আলো ফুটলেই হেসে ওঠে, এ প্রতিষ্ঠান থেকে ও প্রতিষ্ঠান ঘুরে বেড়ায় চাকরির আশায়।

আর রাত হলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ব্যর্থতা। আহা এত পরিশ্রম এত মেধার সার্টিফিকেট ব্যর্থ হয়ে কেঁদে বেড়ায় শত শত যুবকের বুকে।

৪০।

পুড়ে যাবার পর ছাই পড়ে থাকে কেন?

পুড়ে যাবার পরে ছাই পড়ে থাকে। যেভাবে তুমি চলে যাবার পর পড়ে থাকি আমি।

হয়ত এই কারণে যে আমি দেখেছি বৃষ্টি চলে যাবার পর হাসতে থাকে গাছেদের পাতা।

অথবা আলো চলে যাবার পর পড়ে থাকে অন্ধকার।

কিংবা যে কারণে ভালবাসা চলে যাবার পর পড়ে থাকে হাহাকার।

তাই পুড়ে যেতে দেই। নিজেকে পুড়িয়ে দেবার পর যে ছাই পড়ে থাকে, প্রেমের নেশায় যে তাকিয়ে আছে মানুষের দিকে, তাই আমি।

৪১।

অন্ধকারে কিছু মানুষ দেখে কেন?

অন্ধকারেও কিছু মানুষ দেখে। একদম হুবুহু আলো জ্বেলে দেখলে যেমন দেখা যায়, তেমন।

হয়ত এই কারণে যে কিছু কিছু মানুষের ভিতরে দিব্যজ্ঞান থাকে, তা থেকে উদ্ভাসিত আলোয় ঝলমল করে ওঠে পৃথিবী।

এই কথা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকা বৃদ্ধও জানে, অনেকক্ষণ অন্ধকারে তাকিয়ে থাকলে সবকিছু দেখা যায় অন্ধকারেও। এরপর উনি তার মৃত্যুর তারিখও বলেছিলেন।

অমাবস্যার রাতে যারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, তারাও হয়ত দেখে ফেলেছিল সত্য কী?

আমি যখন চোখ বুজে শুয়ে থাকি, তখনও আমার চারপাশে অন্ধকার। চোখের ভিতরে অন্ধকার এত গাঢ়, এত গাঢ় অন্ধকারে আমি কারও মুখ দেখে উঠে পড়েছিলাম কি?

৪২৷

আমি বারবার ঠকে যাই কেন?

নদীও কি ঠকে যায়, তারপর হতাশ হয়ে মরে পড়ে থাকে শহরের কোণে।

তাই যদি না হবে, তবে এমন প্রমত্তা নদী একা হয়ে যায় কেন, তাকেও কি খেয়ে ফেলছে ঘুণে?

যেদিন গোলাপ ফুল তুলতে গিয়ে হাত কেটে ফেললাম, কোনভাবে বন্ধই হচ্ছিল না রক্ত পড়া, সেদিনও মনে হয়েছিল, ভালবাসাও কি ঠকাল আমাকে।

যেদিন এক গভীর রাতের ঝড় নিঃস্ব করে দিল আমায়,নির্ঘুম চোখে সকালে দেখলাম তুমি চলে যাচ্ছ ভিন্ন রাস্তায়, সেদিনও গিয়েছিলাম চমকে।

যার হয় তার হয়, যার হয় না তার সারারাত বিষের বাঁশি বেজে চলে নিরব বুকে।

৪৩।

আমার চোখে এত সমুদ্রের স্মৃতি ভাসে কেন?

শেষ কবে সমুদ্রে গিয়েছি মনে নেই, সমুদ্রের লোনাজল কেমন ঢেউ খেলে আর সারারাত ডেকে চলে তাও মনে নেই। তবু সমুদ্রের স্মৃতি ভাসে।

মনে পড়ে যে সমুদ্রের তীর থেকে সকাল বেলায় সূর্য উঠে, সেই সমুদ্রের তীরেই বিকালে অস্ত যায় সে।

হয়ত এই কারণে যে সমুদ্রের জলের স্বভাবই এই, যাকে পায় তাকে ভাসিয়ে নিয়ে ছাড়ে।

হয়ত এই কারণে যে, সেও তোমার মতন, আড় জানে, জানে কিভাবে তাকালে আমি নেশায় পড়ি, ধীরে ধীরে আমার আকর্ষণ বাড়ে।

অথবা হয়ত এই ঠিক, উন্মাদ ভিখারি হয়ে বেড়ায় সে, সত্যিকারের প্রেমের নেশা একবার ধরে যারে।

৪৪।

অনেক বছর পরে কাউকে বেশি মনে পড়ে কেন?

অনেক বছর পরেও সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে স্পষ্ট মনে পড়ে। একদম জ্বলজ্বলে, মনে হয় গতকালের ঘটনা, অথচ চলে গেছে বিশটি বছর।

কাউকে কাউকে কেন এমন মনে পড়ে হঠাৎ, কেন এমন হু হু করে কাঁদে মাঠের বুক।

ঘাসের উপরে শুয়ে থেকে ভাবি, ঘাসের গন্ধ শুকি, মনে হয় কিছুক্ষণ আগেও বসেছিলাম তুমি আর আমি, একটোও বদলায়নি, অথচ চলে গেছে বিশটি বছর।

হয়ত এই কারণে যে কোন কোন সম্পর্ক, কোন কোন ঘটনার ক্ষেত্রে সময় অপরিবর্তনশীল। মাঝখানের বিশ বছরের ব্যবধান আমার আর তোমার জন্য নয়, আমরা এখনো রয়ে গেছি আগের মতন।

হয়ত এই কারণে যে দূরত্ব থাকলেও আমরা একে অপরকে এত বেশি মনে করি যে সময়, দূরত্ব একক ধ্রুবকের মত সূত্রে বসে আছে, ছবিকে এত বেশি পরিস্কার করে গেছি যে পুরনো হয়নি তা, বদলায়নি কারণ ছবির মত স্মৃতি সম্পর্কেরও করে গেছি যতন।

৪৫।

গাছ বা পুরুনো দেয়ালে নাম লিখে রাখে কেন?

গাছ বা পুরুনো দেয়ালে নাম লিখে রাখে মানুষ। এমন ভাবে লিখে রাখে যেন কোনদিন মুছে যাবে না।

হয়ত এই কারণে যে অনেকে এই নাম দেখবে, তারপর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়বে তার নাম।

অথবা হয়ত এই কারণে যে তার ধারণা মহাকালের কোন এক বিন্দুতে সে রেখে গেল চিহ্ণ।

অথবা এই নাম বা নামের আদ্যক্ষর দেখে তার কথা কেউ আলাপ করবে, এই তার আনন্দ, এই তার উৎসব সংসারের মায়ায়।

মানুষ মরে গেলেও এই চিহ্ণ নিয়ে বেঁচে থাকে গাছ, সবার অজান্তে, সবার আড়ালে গাছেরই বুকে এই চিহ্ণ একদিন ঢেকে যায়।

৪৬।

কিছু কথা মনে রাখা সম্ভব নয় কেন?

সব কথা মনে থাকে না। কিছু কথা মনে থাকে। কিছু কথা গুরুত্বপূর্ণ হলেও হারিয়ে যায়।

যেমন একদিন হারিয়ে গিয়েছিল মেঘ। অথচ কী প্রয়োজনই না ছিল বৃষ্টির।

কেন এমন হয়। কেন এমন এলোমেলো হয়ে যায় মাঝে মাঝে সৃষ্টির।

হয়ত এই কারণে যে কথারও ব্যথা আছে। কথারাও অভিমানে হঠাৎ রাতে ডুকরে উঠে কেঁদে।

হয়ত কথারাও ভেঙে পড়ে। পাথরের মত নিথর পড়ে থাকে, কখনো জোরে, কখনো আস্তে, কখনো ফিসফাস শব্দে।

৪৭।

জন্মদিনে উৎসব হয় কেন?

জন্মদিনে অনেক উৎসব হয়। রং বেরং এর বেলুন ওড়ে৷ মিষ্টি মুখে হাসে। মানুষ তার পৃথিবীতে আসার কথা ভেবে খুশি হয়।

অথচ তার নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

হয়ত এই কারণে যে আর কিছু জুটুক না জুটুক, শুধু জন্ম নেয়াকেই সে অনেক বড় কিছু মনে করে।

যেমন শুধু ফুলে থাকা বেলুনকে সুন্দর দেখায়।
সামান্য খোচাতেই ফুটে থাকা বেলুনের সৌন্দর্য নাই হয়ে যায়।

তবু সে হাসে। আকাশের তারাদের মত জন্মদিন এলে শুধু তাকে হাসতেই দেখা যায়।

৪৮।

ভালবাসা মানুষকে অসহায় করে ফেলে কেন?

ভালবাসা মানুষকে অসহায় করে ফেলে। নদীর একাকী স্থির শান্ত শুয়ে থাকার মত অসহায়৷

কিছুই করার ছিল না যখন পাহাড়ের ঢল এসে দুই পার উপচে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গ্রাম, শহর, বন্দর।

হয়ত এই কারণে যে ওর শক্তি শুধু ভাসিয়ে নেবার, বাধা দেবার নয়।

হয়ত ভালবাসাও তাই বাধা মানে না। ভাসিয়ে নিতে নিতে কোথায় যে নিয়ে যায় কেউ জানে না।

অসহায় বিদ্যুতের খুঁটির মত দাঁড়িয়ে থাকে, কত ঘরের আলো জ্বালে, নিজে জ্বলে না।

৪৯।

যন্ত্রণা থেকে কবিতার জন্ম হয় কেন?

যন্ত্রণা থেকে তৈরি হয় কবিতা। যেমন মাটি পুড়ে তৈরি হয় ইট আর তা থেকে ঘর, সভ্যতা।

কেন এমন যন্ত্রণা থেকেই শুরু হতে হয়। পৃথিবীর জন্মও নাকি হয়েছিল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ থেকে।

হয়ত এই কারণে যে যন্ত্রণা, কষ্ট আর কান্নার আরেক নাম দহন, বিস্ফোরণ, ভাঙন।

হয়ত সৃষ্টির রহস্য এইই যে কাউকে নিঃশেষ হতে দিয়ে, কাউকে ধ্বংস হতে দিয়েই কারও জন্ম হতে হয়।

তাই যখন বিস্ফোরণের পর পাহাড়ের মুখ থেকে গলিত লাভায় পৃথিবীর শরীর গিয়েছিল পুড়ে, তখনও কি সুখ ছিল, কবিতা লেখার পর যেমন হয়।

৫০।

গাছ মাটি থেকে তুলে ফেললে মরে যায় কেন?

গাছ মাটি থেকে উপরে তুললেই মরে যায়। অনেক কায়দা করে মাটিসহ তুলে অন্যত্র লাগালেই গা বেঁচে থাকে, নয়ত মরে যায়।
অর্থাৎ গাছের শিকড়ও মাটির কাছে থাকতে হয়।

মানুষেরও কি তেমন। যে মাটিজলে বেড়ে উঠেছে সে, সেখান থেকে সরানো হলে সেও মরে যায়।

হয়ত তাই। তা না হলে মানুষ এত ব্যাকুল থাকে কেন ফিরে আসবার। কেউ কেউ কেন তার কবর গ্রামে দেবার কথা বলে যায়।

হয়ত এই কারণেই যে, যে শান্তির জন্য সে দেশ বিদেশ ঘুরেছে, অবশেষে জেনেছে এই শান্তি আসলে শিকড়েই।

অথবা একদিন হয়ত ঘুমের ভেতর