Tuesday, January 9, 2024

৪৪ কবিতা : দুপুর মিত্র

 

Enjoy more offers 


প্রথম প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
বইটি বিক্রির জন্য নয়
কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোন অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে

মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই যে কেউ নকল এবং পরিবেশন করতে পারবেন।
এছাড়া বইটি কেবল মাত্র ই মেইলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পাবেন। ই মেইল ঠিকানা-
mitra_bibhuti@yahoo.com
প্রকাশক
দুপুর মিত্র
প্রচ্ছদ
কাঠের শরীর
লে আউট ও মুদ্রণ
ম্যাড হর্স, ১২৫, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: আমার বন্ধু আহসান হাবীবকে

উৎসর্গ
আমার মা
কল্যাণী রানী মিত্র
আমার বাবা
ভোলা নাথ মিত্র
ও আমার ছোট ভাই
আকাশ মিত্র – কে

১.

নদীঘাটেই তবু আসতে হবে কারো
নদীর বুক চিরে নিতে হবে তাকে রূপালি দানা
সন্ধ্যায় বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে গলা ছেড়ে দিতে হবে টান

জলকে শাসন করতে করতে নায়ককে পেতে হবে
স্নান করতে আসা জলকুমারী

স্টিমার আসবে দূর দেশ থেকে
ভিনদেশী দেবতার পায়ে হুমরি খেয়ে নিতেই হবে ধূলো

সমস্ত রাত সাইরেনের মতো কেঁদে কেঁদে ঘুমাবে
তীরবর্তী গ্রামের নিত্যনতুন শিশু

কারো কারো মনে পড়বে শৈশবে সাঁতার শিখতে এসে
ডুবে যাওয়া রঙধনু
আর
ক্রোধান্বিত মেঘ তাড়িয়ে বেড়াবে কাউকে এপার থেকে ওপার

২.

বড় রাস্তাগুলো হবার পর
এলাকাটির অনেক উন্নতি হয়েছে
অনেক দালানকোঠা হয়েছে
দোকান বসেছে
শিক্ষিত মানুষ এসেছে
এসেছে বিদেশী জিনিস
এই এলাকায় নতুন আসা লোকজন খুব খুশি
বড় রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে অনেক সুখ

কেবল যারা এই এলাকার মানুষ
তারা বড় রাস্তার দিকে কখনোই যান না
তাদের ভয়
বড় রাস্তায় গেলে হারিয়ে যায় মানুষ

৩.

একদিন বুঝবে ট্রেন চলে গেলে শূন্য হয়ে থাকে স্টেশন
দোকানিরা পান মুখে দেয়
হকাররা জিরিয়ে নেয় কোথাও বসে
স্টেশন মাস্টার হেসে কথা বলে
স্টেশনের পাশে যে নদী
সে নদী থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসে
আশ-পাশের গাছগুলোতে পাখি এসে বসে
গান গায়
কেবল আমরা যাদের বলি স্টেশনের মানুষ
তাদেরই বুকটা খালি হয়ে যায়
বিষন্ন চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা
আর তাদের বাচ্চাদের চলে যাওয়া ট্রেনকে দেখিয়ে বলেন
ঐ যে দেখ আবার আসছে

৪.

আমার সন্তান যখন আমার
ঘাড়ে চড়ে ঘোড়া বানিয়ে বলতে থাকে
টগবগ টগবগ
তখন আমার নিজেকে খেলনা ঘোড়া করেই রাখতে ইচ্ছে করে
সারাক্ষণ
সারাটাজীবন
যে ঘোড়ায় চরে
একদিন সে জয় করবে সমস্ত রাজ্য
৫.

শহরে হেলিকপ্টার উড়ে আসলে
কতলোক উপরে তাকায়
যেন কত দিন ধরে তাদের ইচ্ছে উড়ে বেড়াবার
কতদিন ধরে ইচ্ছে তাদের মুক্ত হবার

আমাদের গ্রামেও একদিন হেলিকপ্টার উড়েছিল
তখন অবশ্য কেউ উড়ে বেড়াবার কথা ভাবেনি
ভেবেছিল কিছু খাবার পড়ুক
হেলিকপ্টারের জানালা থেকে

৬.

মা যখন তার বালকদের শরীর
সাবান দিয়ে পরিস্কার করিয়ে দেন
তখন আমার বালকবেলার কথা মনে পড়ে
মনে হয়
সমস্ত বালকদের আগামী দিন যদি
মায়েরা
এরকম সুন্দর-উজ্জ্বল-পরিষ্কার
করে দিতে পারতেন
৭.

আমাকে তোমার ফসলি ক্ষেতের
কাকতাড়ুয়া বানিয়ে নাও
আমি আজীবন তোমার আদরের পাশে
থাকতে চাই
আর তোমার ক্ষেতের ফসল দেখে রাখতে চাই
যেন কোন বিদেশী ছলাকলা এসে নষ্ট না করে ফসল

যেন তুমি ফসলকে জড়িয়ে ধরে
ঘুমিয়ে পড়তে পার
নিশ্চিন্তে

৮.

আবার তো দিন আসবে
আকাশ ভেদ করে গলে পরবে আলো
সে আলোয় দেখা যাবে
পৃথিবীর ঘর বাড়ি মানুষ জীবজন্তু সব
এবং তোমাকেও
আজ রাতটা অন্ধকার থাক
কালো নিকষ অন্ধকার
যেন পৃথিবীর কোন কিছুই দেখা না যায়
এমনকি আমাকেও

আজ রাতটা
শুধু পরস্পরকে বিশ্বাস করে ভালবাসতে চাই
কোন প্রকার বিচার বিবেচনাহীন
যেন তুমি আমার সাথেই লড়ছো
শহরে
গ্রামে
বন্দরে
একই স্বপ্নে আমরা
দীর্ঘদিন

৯.

কাশ্মীরকে ভূ-স্বর্গ বলা হয়
আমি সেই স্বর্গের দিকে তাকিয়ে আছি
আর ভাবছি
আমার মা যখন ছোট ছিলেন
তখনও কাশ্মীরে অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হত
এখন আমি যখন বড়
এখনও কাশ্মীরে অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়

আর কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে আমার বাবার মতো আমিও
ভাবি এখনও
আমার স্ত্রী আর সন্তানদের কথা

১০.

আমার তা মনে হয় না
অন্তত কৃষকের বাড়ির উঠোন দেখে
যে উঠোন শরতের আকাশের মতো স্বচ্ছ আর পরিষ্কার
সন্ধ্যা হলে যেখানে তারা ফোটে
কিষান-কিষানিরা গোল হয়ে বসে
গল্প জমে হাসিতে
গানে
কিচ্ছায়
আর ধান কাটা শেষ হলে
সমস্ত সোনা ঝরা ¯^cœ এসে জড় হয় উঠোনে উঠোনে

বাংলাদেশের সমস্ত সুন্দর
সমস্ত মানুষের আগামী সুদিন
উঠোনের উপর চিকচিক করে চলছে অজস্র বছর
আমার এরকম মনে হয়




১১.

এই যে চুপচাপ বসে আছে
খুব দূরে একা একটি শ্বেত-শুভ্র বক
দেখে মনে হয়
এত ধ্যানী এত শান্ত-স্নিন্ধ রূপ
কোথাও যাবে না পাওয়া
তাই আমিও মেলে রাখি চোখ
তার দিকে

হঠাৎ একটু উড়াল দিয়ে
যখন ডুবিয়ে দিল মুখ
জলের গভীরে
তখনও ঠিক টের পাইনি
এই ধ্যান এই শান্ত-স্নিগ্ধতা
এও এক কৌশল
শিকারের

১২.

আমার এখনো সাঁতার শেখার কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে আমার বাবা কীভাবে
আমার শরীর শক্ত করে ধরে সাঁতার শেখাতেন
কখনো একটু হাত ফসকে গেলেই
কেমন ছোট হয়ে যেত তার মুখ

সেই মুখ এখনো হঠাৎ মনে হলে
কেমন যেন সেই সাঁতার থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরার মতন
কোথাও চুপচাপ জড়সড় হয়ে যাই
কাজের গতি কমে যায় আমার
আর মনে মনে বলতে থাকি
বাবা এইতো আমি তোমার পাশেই আছি

১৩.

মানুষের ঘুমমুখ দেখলে কেমন চুপ হয়ে যাই আমি
ঘুমন্ত মানুষেরা শিশুর মতো পাপহীন জ্যোতির্ময় দেহে চোখ বুজে থাকে
মানুষের ঘুমমুখ আমার ভিতর ছড়িয়ে দেয় এক অদ্ভূত ভালবাসা
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি তাই ঘুমমুখের দিকে
ঘুমমুখ আমাকে জাগিয়ে রাখে সারারাত
আমি মিশে থাকি স্নিগ্ধতার ভিতর
জেনে যাই যে মানুষ রমণীকে ফুল দেবার আগে কেঁদেছিল
কিংবা কাউকে খুন করার আগে হেঁটেছিল সারারাত
সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে যে মানুষ একটু স্বস্তির মতো আশ্রয়ের জন্য
অথবা মুখ গুঁজে রাখে শীতল জলে
সেইসব মানুষেরাও অজান্তে আশ্রয় চায় ঘুমের কাছে
ঘুম তাকে অনেকক্ষণ ভুলিয়ে রাখে বেঁচে থাকা
ঘুম অনেকক্ষণ তাকে তার ভাবনার ভিতর, স্বপ্নের ভিতর,
প্রাপ্তির ভিতর বাঁচিয়ে রাখে
আমি তাই গোপনে ঘুমপাড়ানি মেয়ে বসিয়ে রাখি
মানুষের শিয়রের কাছে
আর তাকিয়ে দেখি পাপহীন জ্যোতির্ময় স্নিগ্ধ এক ঘুমমুখ

১৪.

আকাশে ওড়া চিল দেখে মনে হয় সবসময় সুন্দর সুন্দর
আর আড়ালে থেকে যায় তার হিংস্র শিকারি চোখ
সৌন্দর্য থেকে দূরে থাকাই বোধহয় ভাল
তাতে বিশুষ্ক মাঠ
দমকলের পেট থেকে টেনে হিঁচড়ে নিতে পারবে প্রাণবন্ত জল
সন্ধ্যা হলে
হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যেতে পারবে সকল প্রাণিজগত
আর আমরাতো সবাই জানি
সৌন্দর্য বিমোহিত হয়ে
বেশিক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলে
জল আসে চোখে

১৫.

ধনীলোকদের বাসার সামনে
অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান থাকে
বাগান যত্নের জন্যে একজন মালি রাখা হয়
সেখানে বাহারি রকমের ফুল ফোটে
গরীব লোকদের বাসার সামনে
থাকে সবজির বাগান
বাসায় খাবার কিছু না থাকলে
তারা এখান থেকে তুলে নেন
রান্নার জন্য

১৬.

বস্তির যুবতি মেয়ে সুন্দর হতে পারে
এ ধারণা ছিল না
ধারণা ছিল না
অদ্ভুত কণ্ঠে সেও গেয়ে উঠতে পারে গান
বস্তির চেয়ারম্যান যে গানের মানে জানে না
উঠতি মাস্তান জানে না কাকে বলে হৃদকম্পন
শুধু জানে ওর শরীর ধরে কিভাবে টেনে নিতে হয় অন্ধকার ঘরে
আর আমিও কেবল জানি
বস্তির মেয়ে মানে খারাপ মেয়ে

১৭.

শহরে বড় বড় বিল্ডিং হবার পর
অনেক মানুষ হয়েছে
বিল্ডিংগুলো হবার কারণে
এলাকাটির চেহারাও পাল্টে গেছে
এখন অনেক উন্নত মনে হয়
কিন্তু শহরের যে জায়গার বিল্ডিংগুলো ছোট
একটা খুপরির মত
সে জায়গাগুলো আর সেখানকার মানুষগুলোকে
জঞ্জাল মনে হয়
একদিন হয়ত এই জঞ্জালগুলো এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে যাবে
কেউ টেরও পাবে না

১৮.

এই দুপুরে যে রোদ খিল খিল করে হেসে ওঠে বালির চরে
তা কি কোনো নতুন কৃষকের ভাষা
যে ভাষার হাসির আন্দোলনে ঝাপসা হয়ে আসছে
আয়েসি চোখ
আজ যেন তাকানোর জায়গা নাই কোথাও
আজ তাই ঘরের ভিতর শাড়ির কারচুপি লাগিয়ে যাচ্ছে গেরস্থের বউ

আর কৃষক একটি বিড়ি নিয়ে বসে বসে আঁকছে
লাল টুকটুকে তরমুজ ক্ষেতের স্বপ্ন

১৯.

রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যে লোকটি
গান করে টাকা তুলে সংসার চালায়
মাঝে মাঝে মনে হয়
সেই লোকটিই কেবল জানে
শিল্প আর জীবন
এক ও অদ্বিতীয়

২০.

প্রকৃতির কাছে এলে
মানুষ অজান্তেই হয়ে উঠে
প্রাকৃতিক আর জীবন্ত

তা না হলে পার্কে
অবারিত প্রকৃতির কাছে এসে
যুবক-যুবতীরা চুমু খেত না
এভাবে

২১.

যে ঘটনাগুলোর সাথে বৃষ্টি জড়িত
সে ঘটনাগুলো প্রায়ই মনে পড়ে কেন জানি না
জানি না বৃষ্টির সাথে ঘটনার কি এমন সম্পর্ক

যেদিন তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিলে
সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল খুব

আমার বাহিরে আর ভিতরে

২২.

আজ মাঝ নদীতে এসে মনে হলো
আমাদের চারপাশে কেউ নেই
বিশাল জল আর জলরাশি ছাড়া

আর আমি
নৌকা
নৌকার মাঝি ছাড়া

পৃথিবী সৃষ্টির সময়ও নাকি এরকম ছিল

আজ মনে হচ্ছিল আবার নতুন করে যদি
পৃথিবীটা সাজাতে পারতাম

২৩.

পুলিশের হাতে লাঠি-বন্দুক থাকার
মানে হচ্ছে দেশের খুব কম লোকই
প্রচলিত রাষ্ট্রের পক্ষে

২৪.

যে মেয়েটিকে পুতুল খেলতে দেখেছি ছোটবেলায়
সেই মেয়েটি আজো পুতুলই খেলে চলছে
গভীর মনোযোগে

২৫.

এতদূর সূর্য্য
তবু কত নির্ভরতা
মানুষের

২৬.

বিয়োগেও আনন্দ আছে
এ কথা শিশুটিও বোঝে
কেননা
গ্যাসবেলুন উড়িয়ে দিয়ে
সেও আনন্দে লাফিয়ে উঠে

২৭.

জলের নিচে যে আকাশ
সে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে
মাছ আর গাঙচিল
আর তার পাশে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে আমায়
চুপচাপ
প্রাচীন যুগের পাথুরে গড়া মূর্তির মতো

২৮.

চারিদিকে শুধু ধানের ক্ষেত
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ
শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে
এই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের আনাচে কানাচে
দাঁড়িয়ে আছে যেসব কৃষক
তাদের আর ভালো লাগে না
দূর থেকে দেখে মনে হয়
এই সবুজের গা জুড়ে
বেশ কটি কীট ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে

অথচ এই সবুজকে জন্ম দিয়েছে তারাই

২৯.

শ্রমিকের মুখ আর পণ্যের মুখ এক নয়
কেননা শ্রমিকের অনেক শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে তৈরি হয় পণ্য
শ্রমিক কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
আর পণ্য হয়ে উঠে উজ্জ্বলসুন্দর
পণ্য ক্রমান্বয়ে দামি হয়ে উঠে
শ্রমিক কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
শ্রমিক আর পণ্য ক্রমাগত সরে সরে যায়
দূরে
আরো দূরে


৩০.

আমার বান্ধবী যেদিন হেসে হেসে বলেছিল
পুষ্টিহীন রোগাক্রান্ত শিশুটি তাকে মা ডেকেছে
সেদিন আমিও বাবা হবার কথা ভেবেছি
পুষ্টিহীন রোগাক্রান্ত শিশুকে দেখে বার বার মনে হয়েছে
আমার একজন ভালো বাবা হওয়া প্রয়োজন
যেমন প্রয়োজন আমার বান্ধবীর
একজন ভালো মা হবার

৩১.

বাজারে কিছু কিনতে গেলে আমার মনে হয়
কেউ একজন আমাকে বিক্রি করার জন্য
দাম হাঁকছে
আমি আর কোনো কিছু কিনতে পারি না
কেবল বাজারের জিনিস দেখে
কোনো রকম ফিরে আসি ঘরে

৩২.

এই যে জনপদ
দূর থেকে দেখে মনে হয়
আকাশ নুয়ে নুয়ে বারবার চুমু খাচ্ছে তাকে
দিন যতই যাচ্ছে বড় হচ্ছে তত
এখানে রক্ত পিপাসু দানব আছে
খেটে খাওয়া পোড় খাওয়া মানুষ আছে
করুণ আর্তি আছে আহাজারি আছে
আছে সুখ আনন্দ উল্লাস
আছে অনেক অজানা ইতিহাস
আমি বলতে পারব না
এই জনপদেরই কোনো ভাঙ্গা ন্যুব্জ ঘরে হয়ত শুয়ে আছে কোনো বুড়ো
সেই বলতে পারবে তা
সেই বলতে পারবে আকাশ কেন বারবার চুমু খায়
এই জনপদকে

৩৩.

এই শহরে কত বন্ধু হলো
ঘোরা হলো কত অলি গলি পথ
কোনকোনদিন এই শহরে
সারাদুপুর সারারাত
ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছি
তবু চেনা হলো না এই শহর
এখানে এখনো একা বের হলে
আমি হারিয়ে ফেলি পথ

কোনদিনই চেনা হবে না বোধহয় এই শহর



৩৪.

ঘুরে ফিরে আকালের মাসে আমাদের দেশে ফাল্গুন আসে
আমরা কবিতা লিখি গান গাই
গাছে গাছে ফুল ফোটে
আনন্দের ফল্গুধারায় হেসে উঠে ফাল্গুন
আর চৈত্রের খাঁ খাঁ রৌদ্রের মতো হাসে
আমাদের গ্রামের মানুষের পেট

৩৫.

নদীর পাড়ে যে ঢেউ আছড়ে পড়ে
সুর আর বাজনা হয়
আমরা জানি না
নদী পাড়ের মানুষ জানে
সেই সুর আর বাজনা
কতখানি বেদনাময়

৩৬.

কৃষকের হাতে একদিন আমি শ্রেণীসংগ্রামের বীজ তুলে দিব
সেই বীজ দিয়ে কৃষক বীজতলা বানাবে
তারপর সমস্ত ক্ষেত ছড়িয়ে দিবে সেই বীজের চারায়
তারপর ফসল ফলবে
দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত জুড়ে ফলবে ফসল আর ফসল
কিষান-কিষানীরা
হাসতে-হাসতে
নাচতে-নাচতে
গাইতে-গাইতে
তুলবে সেই ফসল
আমি একদিন বাংলাদেশের সমস্ত কিষান-কিষানীর হাতে
তুলে দেব বীজ
শ্রেণী-সংগ্রামের বীজ

৩৭.

এই লাঙলে তার প্রপিতামহের শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে তার পিতামহের শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে তার পিতার শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে তার শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে কি তার ছেলের শরীরেরও দাগ থাকবে

৩৮.

সকাল বেলায় আয়নায় মুখ দেখে
যখন অফিসে যাই
তখন মনে হয়
আয়নাটি আমার সৌন্দর্য আটকে রেখেছে
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে
যখন আয়নার দিকে তাকাই
তখন মনে হয়
আয়নাটি আমার সৌন্দর্য ফেরত দিয়েছে

৩৯.

আজ আমি সেই ট্রাফিক
যার ইশারায় থেমে যাচ্ছে শহরের সমস্ত গতি
গাড়ি-রিক্সা-টেম্পু-বেবী সব
সাগরের গভীর থেকে ছুটে আসা এক নিঃসীম বেগের অজানা হাওয়া
যার আঘাতে তছনছ হয়ে যায় শহরের অলিগলি পথ
সেও থেমে যাচ্ছে আঙুলের একটুখানি ইশারায়
জ্বলে উঠছে লাল-হলুদ-নীল রঙের বাতি
কোথায় আছো শহরের আরাম?
আজ তোমাকে নিয়ে যেতে চাই ঘরে
যে ভিখিরি লম্বা কালো হাত ঢুকিয়ে দেন
প্রাইভেট কারের জানালার ভিতর
যে শিশুর কোমল চোখ পপকর্ন পপকর্ন বলে
তাকিয়ে থাকে ধনীশিশুর হাতে থাকা
আইসক্রিমের উপর
তার জন্য
আজ থামিয়ে রেখেছি শহরের সকল গতি

৪০.

আমি পাখিদের ভাষা বুঝি না
পাখিদের সমস্ত শব্দই আমার কাছে গান মনে হয়
কেননা পাখির গান ছাড়া
আমি তার অন্য কোন ভাষার সাথে পরিচিত নই

৪১.

গ্রাম থেকে যারা শহরে আসেন
কেমন যেন তাদের মুখের দিকে
তাকানো যায় না
কেমন উৎকণ্ঠা
আর নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়
সারাক্ষণ তাকে যেন তাড়িয়ে বেড়ায়

যারা শহর থেকে গ্রামে যান
তাদের মুখগুলো অবশ্য
বেশ হাস্যোজ্জ্বল
মুক্ত মনে হয়
মনে হয়
কিছুটা সময়ের জন্য তারা
নিজেরা নিজেদের ফিরে পেয়েছেন

৪২.

উৎসব হলে
কত মানুষ দুলে ওঠে
কত প্রেম কত অনুরাগ
হেসে ওঠে
অনেকদিন পর
যেন অনেকদিন পর
তাদের উদোরে ঢুকেছে ভাত
আর কিছু মাংস
সেই ঘ্রাণ
রন্ধন-ঘ্রাণ
মুহুর্মুহু কেঁপে উঠে
আকাশে-বাতাসে
নববধূর শীৎকারে
উৎসবের ছায়ায়
উৎসব হলে
তোমাকেও বেশ ভালো মানায়
অনেক অনেকদিন পর
অভাবের সংসারে

৪৩.

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হয়
কেউ একজন আমাকে
ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে
বিছানার চাদর থেকে
ময়লা ফেলার মতো

প্রতিদিন ঘুমুতে গেলে মনে হয়
এখানেই আমাকে ঘুমুতে হবে
বালিশে শ্বাসরোধ করে হলেও

৪৪.

মুখোশের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ
এমনকি শিশু বাচ্চাদেরও
ওরা মুখোশ পরে ভয় দেখাতে এত আনন্দ পায়
আর বাবাদেরও ভয়ের অভিনয় করতে ভালোলাগে
ছোটবেলা থেকেই এমন মুখোশ-মুখোশ খেলা দেখতে
আমার ভাললাগে না
ভেবেছিলাম আমি আমার বাচ্চাকে
কখনও মুখোশ কিনে দেব না
কিন্তু যেদিন সে হালুম বলে
আমাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল
সেদিন থেকে
আমি নিশ্চিত
মানুষ ইচ্ছে করলেই মুখোশ থেকে

বেরুতে পারে না


Enjoy more offers