Wednesday, February 7, 2024

দশভুজা: দুপুর মিত্র


দশভুজা



দশভুজা


দুপুর মিত্র


 


প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১২


 


কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোন অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই নকল ও পরিবেশন করতে পারবেন।


 


প্রকাশক


দুপুর মিত্র


 


প্রচ্ছদ


নির্ঝর নৈ:শব্দ


 


বইটি বিক্রির জন্য নয়


 


যাদের ভালবাসায় ঋদ্ধ


রুবাইয়াৎ আহমেদ,অদ্বৈত মারুত, সিদ্ধার্থ টিপু, বিল্লাল মেহেদী, অদিতি ফাল্গুনী, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, মেহেদী উল্লাহ,


হামীম কামরুল হক, আহমাদ শামীম, সঞ্জয় ঘোষ, সালাহ্উদ্দীন শুভ্র, মাহবুব মোর্শেদ এবং অন্যান্য লেখকদের যারা গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও সহযোগিতা করেছেন ও এর মুদ্রণ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে যে সমস্ত শ্রমিকেরা শ্রম দিয়েছেন




উৎসর্গ


রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যে লোকটি


গান করে টাকা তুলে সংসার চালায়


মাঝে মাঝে মনে হয়


সেই লোকটিই কেবল জানে


শিল্প আর জীবন


এক ও অদ্বিতীয়


…এইসব মানুষের করকমলে


 

পাঁচটি কিসসা 


গণতন্ত্র



সংসদ ভবনের পেছন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকগুলো লেক দেখলাম, সেই লেকের দুইপাশে অনেক মানুষ বসে আছে, গল্প করছে, প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত ধরে বসে আছে। ওদের বসতে থাকা দেখে আমারও মনে হল এখানে বসা দরকার। কারণ কোনো কাজ নেই আজ আমার, কারণ ওরাও বসেছে, কারণ এখানে আগে কখনই বসিনি। তাই বসে বসে কিছুণ বাদাম খেলাম, আশপাশের মানুষজন দেখলাম, একা বসে আছি বলে কেউ কেউ কয়েকবার করে আমার দিকে তাকাল, কেউ কেউ বোধহয় বিরক্ত হল। আমি বাদাম কিনলাম, বাদাম কিনে সবগুলো বাদাম বসে বসে খেলাম, সময় চলে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না বোঝা যাচ্ছিল না বা সময় কখনো যায় না, আমরা যাই। যাই হোক, এক পর্যায়ে টের পেলাম, একা বসে থাকতে থাকতে আমার কোমর ধরে গেছে। তাই দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করব। একটা খেলা মনে হল- চার কোণা বা তিন কোণার মাটির বা ইটের চাকতি দিয়ে কায়দা করে লেকের উপর ছুড়ে মারলে ওটি ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয়। আমার মনে হল এখন এই খেলাটা খেলব। কিছুণ চার কোণা বা তিন কোণা বিশিষ্ট এরকম মাটি আর ইটের চাকতি সংগ্রহ করলাম। আমি লেকে একবার এভাবে ছুড়লাম। প্রথমটা একবার কি দুইবার লাফাল। কেউ তেমন খেয়াল করেনি বা একজন কি দুইজন দেখেছে যে আমি এরকম করছি। আমি আরেকবার করলাম, ওটা দুইবার কি চারবার লাফাল। বেশ কয়েজন আমার দিকে তাকাল আমার এই খেলাটা দেখতে পেয়ে। কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কী খেলা। তেমন তো লাফাল না ইত্যাদি। আমি হেসে বললাম- আরও কয়েকবার করলে এটা আরও বেশি লাফাবে। ওদের আমার কাছে এসে কথা বলাতে বেশ মজা পেলাম। একটু সাহসও পেলাম। এবং আবারও আমি খেলার চেষ্টা করলাম। এবার অনেকণ লাফিয়েছে। এই খেলা দেখে বস্তির কয়েকটি ছেলেমেয়ে জুটে গেল। তারাও আমার মত করে চার কোণা বা তিন কোণা বিশিষ্ট মাটি বা ইটের চাকতি সংগ্রহ করল। এবং আমার মত খেলতে লাগল। ওরা দেখল কেউ আমার মত পারছে না।



বেশ কয়েকজন প্রেমিক-প্রেমিকাও আমার মত খেলা শুরু করল। কিন্তু ওরা শখের বশে খেলল। প্রেমিকটি তার প্রেমিকাকে দেখানোর চেষ্টাও করল যে, সে আমার চেয়ে বেশি চাকতি লাফাতে পারে। কিন্তু পারল না। এরকম করে অনেকেই লেকজুড়ে এই খেলা শুরু করল।


একজন আমাকে বলে বসল আচ্ছা চাকতিটি লেকের ওপারে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলে কী হয়। আমি একবার বিস্মিত হলাম, লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। এই খেলা খেললে কী হয়, এই জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন কখনও হইনি। তাও আবার যে লোকটি জিজ্ঞেস করেছে সে বয়সে অনেক বড়। আমি বলে ফেললাম, ওপারে ব্যাঙের মত লাফিয়ে নিয়ে যেতে পারলে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আসে। বুড়ো লোকটি আমার দিকে তাকাল আর আমার কাছ থেকে একটি চাকতি নিয়ে এমন ভাবে কায়দা করে ছুড়ল যে, ওটি অনেকণ লেকে ঘুরপাক খেতে খেতে লাফিয়ে লাফিয়ে একেবারে লেকের ওপারে গিয়ে হাজির হল। সবাই বৃদ্ধলোকটির এই কাজে বিস্মিত হয়ে গেল। কেবল আমি মনে মনে বললাম- বেটা পাগল।


 

মদ




লোকটা প্রতিদিন বারে আসত মানে মদের দোকানে। লোকটাকে ঘিরে প্রতিদিন কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার-আমলা, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-বাম নেতারা, আমলারা বসত। লোকটা কখনোই বারের ছেলেদের দিয়ে কাজ করাত না। একবার কবি, না হয় ডাক্তার, না হয় আমলা, না হয় আওয়ামী লীগের নেতা, না হয় বিএনপি নেতা, না হয় জামায়াত নেতা, না হয় বাম নেতাদের দিয়ে কাজ করাত। এই ধরুন যখন ছোলার প্রয়োজন পড়ত তখন কোন এক বাম নেতাকে বলত এই খানকির পোলা, ছোলা নিয়া আসস না কেন। পাছায় একটা লাথ্থি দিমু। আর অমনি সুড়সুড় করে নেতাটি ছোলা নিয়ে আসত। এরকম করে একবার আওয়ামী লীগ নেতাকে, একবার বিএনপি নেতাকে, জামায়াত নেতাকে। আর ওরা সুড়সুড় করে ওই কাজটি করে দিত। প্রতিদিন মদ খাওয়া শেষে পুরো টাকাটা দিয়ে সে বাসায় চলে যেত। অদ্ভুত একটা লোক- মনে হয় এইভাবে মদ খাইয়ে হুকুম দিয়ে সে একটা মজা লুটত। এইভাবে লোকটাকে ঘিরে আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, বাম, আমলা জড়ো হতে থাকলে লোকটার হুকুম বাড়তে থাকল আর লোকটা আরও বেশি মজা পেতে থাকল। এইভাবে মজা মজা পেতে পেতে লোকটা একদিন দেশের বিশেষ কেউ হয়ে উঠল আর এইভাবে লোকটার মজার পরিমাণ দিনকে দিন বাড়তেই থাকল।



প্রেম


 


একবার এক ছেলে এক মেয়ের প্রেমে পড়ল, এমন প্রেম যে ছেলেটি কখনোই মেয়েটিকে বলে না যে সে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে বা বলবে কি, কোনোদিন মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়নি পর্যন্ত, মেয়েটি ছেলেটিকে চিনে কি-না সন্দেহ; তারপরও ছেলেটি মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। মানে গোয়েন্দা পুলিশের মত মেয়েটি কখন বাসা থেকে বের হয়, কোথায় যায়, কী করে, কোথায় আড্ডা দেয় সবই ছেলেটির মুখস্থ। কেবল মেয়েটির সামনে দাঁড়ায় না সে, কেবল মেয়েটির সাথে কথা বলে না সে, কেবল মেয়েটিকে সে দূর থেকে দেখে। একদিন মেয়েটিকে না দেখলেই তার মন খুব খারাপ থাকে; কারণ সে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। তাই সে দূর থেকে মেয়েটিকে দেখে তবে বাড়ি ফিরে। এটাই তার প্রেম- এতেই তার আনন্দ।


এভাবে প্রায় একবছর ছেলেটি মেয়েটির সাথে প্রেম করে। একদিন ভেজা বৃষ্টির দুপুরে কোনো এক পার্কে মেয়েটিকে তার এক বন্ধুর সঙ্গে চুমু খেতে দেখে ছেলেটি বুঝতে পারে- মেয়েটিকে সে আসলে ভালোবাসে না।


   

বশীকরণ


একবার এক লোক এক সাধুর কাছে গিয়ে বলল, আমার ব্যবসায়ী বন্ধুটি, যাকে নিয়ে আমি ব্যবসা করি; সে আমার কথা মানছে না। আমাকে এমন কোনো মন্ত্র দিন যাতে করে সে আমার কথা শুনে।


সাধুটি বলল, ঠিক আছে এই নে তাবিজ, এই তাবিজ হাতে রাখবি, দেখবি বন্ধু তোর কথা মানবে।


তাবিজ হাতে রাখার পর থেকে লোকটি বিস্ময়কর ফল পেল। বন্ধুটি তার কথার বাইরে এক চুলও এগোয় না। মানে সে যা বলে ব্যবসায়ী বন্ধুটি তাই করে কোনো বাকবিতণ্ডা ছাড়াই।

এমন অভাবনীয় ফল পেয়ে লোকটি আবারও সাধুটির কাছে গেল। বলল, আমার ব্যবসায়ী বন্ধুটি এখন আমার সব কথাই মন দিয়ে শুনছে ও কাজ করছে, আপনার অশেষ কেরামতি, এখন ব্যবসাতেও আমার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল কয়েক মাস ধরে আমার স্ত্রী আমার কথা শুনছে না, আমাকে এমন মন্ত্র দিন যাতে করে স্ত্রী আমার কথা শুনে।


সাধু বলল, ঠিক আছে এই তাবিজ নিয়ে যা, বিছানার নিচে রাখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে।


 


তাবিজটি বিছানার নিচে রাখার পর সত্যি সত্যি স্ত্রীও তার কথা শুনতে লাগল।


 



কয়েক মাস পর লোকটি আবারও সাধুর বাড়িতে গিয়ে হাজির। বলল, সবই ঠিক আছে, আপনার দেওয়া তাবিজে সবাই আমার কথা মানছে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি আমার কথা মানছি না। এজন্য কি কোনো তাবিজ আছে?


 


সাধু কিছুণ লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্য কোনো তাবিজ নেই। কেবল একটি মন্ত্র আছে, সেটি সারাণ জপ করতে হবে। লোকটি বলল, ঠিক আছে তাই দিন।


 


সাধু লোকটির কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল, আমি আমার কথা মানব, আমি আমার কথা মানব।


 


এরপর থেকে লোকটি শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু এই মন্ত্রই জপ করে- আমি আমার কথা মানব, আমি আমার কথা মানব।


 


দুই-তিন মাস পর কোনো এক দুপুরে লোকটি জানতে পারে তার স্ত্রী আর ব্যবসায়ী বন্ধুটি পালিয়ে গেছে।


  

শুভ পরিণয়


 এক দেশে বহু গুণে গুণান্বিত এক রাজপুত্র ছিলেন। তার গুণে রাজা-রানী-দেশবাসী সবাই সন্তুষ্ট। এমন রাজ পরিবারে এমন রাজপুত্রই চাই। কিন্তু রাজপুত্রটির একটিই দোষ ছিল- আর সেটা হল তার বিয়ে হচ্ছিল না। তাই রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দেওয়া হল, কে হতে চায় রাজপরিবারের বধূ। বধূ হবার জন্য কেবল একটিই শর্ত, কন্যাটির পূর্বে কোনো প্রেম থাকা চলবে না।


 


একদিন গেল, দুই দিন গেল এরকম করে এক মাস কেটে গেল রাজ্যজুড়ে এমন এক কন্যা পাওয়া গেল না, যার পূর্বে প্রেম ছিল না। রাজা-রানী-রাজপুত্র বেশ শঙ্কায় পড়ে গেলেন। তাহলে কি রাজপুত্রের বিয়ে হবে না?


রাজপুত্র কয়েকদিন পর সিদ্ধান্ত নিলেন এমন ঘোষণা দিতে যে পূর্ব প্রেমে সমস্যা নেই, কিন্তু কোনো পূর্ব যৌন সম্পর্ক থাকা চলবে না। যথারীতি রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দেওয়া হল। কিন্তু একদিন গেল, দুই দিন গেল, একমাস কেটে গেল রাজ্যজুড়ে কোনো কন্যা পাওয়া গেল না, যার পূর্ব যৌন সম্পর্ক নেই। রাজপুত্র কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। পরে সিদ্ধান্ত নিলেন এমন ঘোষণা দিতে যে, পূর্ব যৌন সম্পর্ক থাকলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এখনও যৌন সম্পর্ক আছে এমন কন্যা থাকলে চলবে না। রাজ্যজুড়ে তাই ঘোষণা দেওয়া হল। কিন্তু এবারও রাজপুত্রের ভাগ্যে কন্যা জুটল না। এই অবস্থায় রাজপুত্র একবার সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বিয়ে করবেন না, চিরকুমার থেকে যাবেন।


 


রাজা-রানীর মনে অনেক কষ্ট। রাজ্যবাসীরও মনে কষ্টের শেষ নেই। এমন রাজপুত্রের জন্য কোনো কন্যা নেই?


 


অনেকদিন পর কোনো এক সকাল বেলায় কোনো এক ফুলকুমারীর প্রেমে পড়ে গেলেন রাজপুত্র। রাজপুত্রের মনে হল, এই কন্যার যদি কোথাও প্রেম থেকেও থাকে, যদি কারও সাথে দৈহিক সম্পর্ক থেকেও থাকে, তবুও তাকে চাই, যে কোনোভাবেই তাকে চাই, তাকেই বিয়ে করতে হবে আমার।


 


এ নিয়ে রাজপ্রাসাদে কানাঘুষাও চলতে লাগল। একদিন রাজা উজিরকে ডেকে কন্যার সমস্ত বৃত্তান্ত জোগাড় করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। অতঃপর রাজপুত্রের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হল।


 


 


 


 




পাঁচটি গল্প 


মাকড়সা


কখনো কখনো মানুষের জীবনে কী এমন কিছু ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা নাই, বা যার কোনো কার্যকারণ নাই, বা ব্যাখ্যা করার মতা নেই বলেই বোধহয় মনে হয় এটি ব্যাখ্যাতীত; অথবা আসলেই কি কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা থাকে-এটা তো এমনও হতে পারে বিষয়টির উপর মানুষের চাপিয়ে দেওয়া অলীক কল্পনা। কিন্তু এটা ঠিক যে ঘটনাটি ঘটে, কখনো সাদা-কালো, কখনো বা রঙিন রঙে, কখনো টিভি পর্দায়, কখনো কম্পিউটার স্ক্রিনে, কখনো অট্রালিকায় কখনো বস্তিতে। সোমা কি প্রায়ই সেই ঘটনাটির দিকেই তাকিয়ে থাকে, দেখে তার চারপাশ দিন দিন কেমন স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠছে, দেখে তার আকাশ জুড়ে টেলিভিশনের রঙিন রঙ, দেখে এই শরীরটা শরীর নয়, কে যেন বানিয়ে রেখেছে। কে যেন তার শরীরে কিক করছে, আর সে হাঁটছে, দৌঁড়ুচ্ছে, কথা বলছে-কোন এক কম্পিউটার গেইমের সে যেন ব্যর্থ এক নায়িকা, তাকে বসে থাকতে হয় কারও অপোয় যে সোমাকে নিয়ে খেলবে।


 


সোমারা সবাই মিলে আজ যে বন্ধুটির বাসায় বেড়াতে যাবে, সে বন্ধুটিকে হয়তবা সে ভালোবাসে, হয়তবা এই কারণেই অন্য অনেকের উচ্ছ্বাসের চাইতে তার উচ্ছ্বাসটাই এত বেশি যে তাকালেই মনে হয় কখনও কখনও কেন মানুষ সবকিছু ছেড়েছুড়ে শুধু প্রেমের দিকে ছুটে চলে। বন্ধুর বাড়ি যাওয়া উপলে সোমার বাসায় দু’জন বান্ধবী এসেছে, যাদেরকে দেখলে বোঝার উপায় নেই পৃথিবীর কোথাও আজ কিছু ঘটতে যাচ্ছে কি-না, যে ঘটনায় এতটা বিস্ময়, এতটা রহস্য আর এতটা সৌন্দর্য ভেসে উঠে, তা কেবল সোমার দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। কোনো এক বান্ধবী বলেই বসল, এমন করে যে এতে সন্দেহ আর মশকরা এক সাথে, কোনো দিক বা বিদিক না ছুটে সেই বাক্যবাণ সোমার মুখের ওপর এসে পড়ল। কি রে আজ এত সেজেছিস?


 


দীর্ঘদিনের লুকিয়ে রাখা কোনো সম্পদ হঠাৎ করে কারও দেখা ফেলা বা জেনে যাওয়ার ভয়ে অনেকটা ঘাবড়ে গেলে মানুষের মুখ যেমন কিছুণের জন্য অন্য রকম হয়ে যায়, সোমারও তেমন হয়েছিল, যদিও সোমার মত চুপচাপ, একটু আলাদা রকমের মেয়ের ক্ষেত্রে এরকম প্রেম জাতীয় কোনো একটা বিষয় সন্দেহ করতে হবে- এই ধারণা কারও ভেতর বিন্দুমাত্র ছিল না। যে বান্ধবী প্রশ্নটি করেছে, সে আসলে বোঝেনি, এমন একটা বিশ্বাস ভিতরে রেখেই সোমা বলল- না রে, এমনি, মাঝে মাঝে সাজতে হয়; সব সময় কি একরকম থাকতে ভালো লাগে?


 


তিন বান্ধবী মিলে যে বন্ধুটির বাসায় গিয়ে হাজির, সে বাসায় একাই থাকে, মানে ঢাকায় পড়াশোনা করে, মা-বাবা দেশের বাড়িতে, যা কেবল তার আবাসস্থলে গেলেই টের পাওয়া যায়। ছেলেটি যতটা ফিটফাট, সুন্দর, হ্যান্ডসাম ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই আবাসস্থল যেন জানান দিচ্ছে ঘরের প্রতি কোনো মায়া নেই তার। এই মায়াহীন ঘরে যখন এত মায়ার আলো এসে হাজির, তখন এর ভার বইবার মতা আবাসস্থলটির যে নেই তাই ণে ণে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল ছেলেটি কী করবে না করবে তার ব্যাকরণ পাঠ দেখে। সোমার সমস্ত সৌন্দর্য যতটা না এই ঘরকে আলোকিত করল তারচেয়ে বেশি বাতাসে প্রদীপশিখার নিভন্ত অবস্থাই বারবার উঁকি দিচ্ছিল এবং শেষমেশ তাই হল। বারান্দায় এসেই সোমা চিৎকার দিয়ে উঠল মাকড়সা বলে, এত জোরে চিৎকার দিল যে আসলে কী হয়েছে এটা বোঝার আগেই কেউ কেউ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। আর প্রকৃত ঘটনা যখন সবাই জানল তখন কেউই মুখে হাসি লুকিয়ে রাখতে পারছিল না। কেউ কেউ সোমার মাকড়সাকে এত ভয় কেন এরকম হাজারো প্রশ্নে সমস্ত লজ্জা, বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল সোমার, যেন এই মুহূর্তে এই ঘরটি থেকে বের হলেই সে হারিয়ে যাওয়া প্রাণটিকে ফিরে পাবে।


 


দূর থেকে দেখলে মনে হবে অনেকগুলো অন্ধকারের দলা, তার মাঝে জোনাক পোকার মত ক্ষীণ কিছু বাল্বের আলোর ভেতর দিয়ে তিন বান্ধবী হেঁটে হেঁটে রিকশা ঠিক করল। সোমার মুখে কথা নেই, এতটা নিশ্চুপ যেন টের পাওয়া যাচ্ছে ভেতরে জগতের সমস্ত কান্না যেন এখনই বৃষ্টির মত ছড়িয়ে পড়বে।


 


গতকালের ঘটনার ভূতটাকে মাথায় নিয়ে, কী হতে পারে আজ কলেজে, কে কী বলতে পারে এমন কিছু ভাবতে ভাবতেই কলেজে ঢুকল সোমা। কাসরুমে ঢুকেই সবার মুখের হাসা-হাসি দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে তার দুই বান্ধবীর আজ আলাপের বিষয় ছিল সোমা।


 


কারও সাথেই আজ সে কথায় জড়াতে পারছিল না, পাছে মাকড়সার গল্পটা না সবাই জানতে চায় তার মুখ থেকে। একবার সে পুরো কাসরুমে তাকাল, যে বন্ধুটির বাসায় গতকাল বেড়াতে গিয়েছিল সে বন্ধুটি এসেছে কি-না দেখার জন্য। কাস শেষে বন্ধুটির কাছে মাও চাইল সে, যেন মাকড়সাই তার প্রেমের বাধা হয়ে উঠছে ক্রমাগত। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হল তার, নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হল, বিরক্তিকর হয়ে উঠল যেন তার সমস্ত পৃথিবী। অথচ তার এমন হওয়ার কথা নয়, বিশেষ করে সদা লাস্যময়ী সোমার জন্য তো এটা একেবারেই মানায় না। দীর্ঘ কান্ত অর্থহীন এক দুপুরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোমা।


 


যে মাকড়সা তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিল, এতটা নিঃসঙ্গ, এতটা অপাংক্তেয় সেই মাকড়সাকেই এবার যেন দেখে নেবার পালা সোমার। কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিল, পড়াশোনাও ভালো লাগছিল না তার, এর বদলে সে কিনতে শুরু কলল মাকড়সার আচরণবিদ্যা আর মনোবিজ্ঞানের বই।


 


সোমা ভাবে, রবার্ট ব্রুসকে নাকি যুদ্ধ করার প্রেরণা জুগিয়েছিল মাকড়সা, যে মাকড়সার ভয়ে আজ তার এই অবস্থা সেই মাকড়সা কীভাবে যুদ্ধ জয়ের প্রেরণা জোগায়। এই ভয়ঙ্কর, উদ্ভট একটা কীট ছাড়া রবার্ট ব্রুস কি আর কোনো পোকা খুঁজে পেল না এই রকম দম বন্ধ করা একটা জীবনে সোমা এতটাই অস্থির হয়ে পড়ে যে সে এখন চোখটাও বন্ধ করতে পারে না, চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে উদ্ভট সেই কীটটির চেহারা।


 


ভয় তাড়ানোর জন্য সোমা মাকড়সার আচরণবিদ্যা পড়ে আর ভাবে, অসামাজিক হিসেবে বিশেষ দুর্নাম আছে মাকড়সার, এমন দুর্নামের কারণ হলো, এরা একা একাই থাকে, একাই চলাফেরা করে, একাই খাবার সংগ্রহ করে ও একাই খায় এবং মূলত একাই জীবন কাটায়। সোমা আরও আঁতকে উঠে এই ভেবে যে, এই একা থাকার এই অস্বাভাবিক জীবনের প্রতীক তো সেও।


 


তবে ১৪ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে বসবাসকারী মাকড়সার গড় আয়ু মাত্র এক বছর জেনে সে আবার আশ্চর্যও হয় বটে, এত কম বয়সী একটি কীট অথচ তার ভয়ের বিষয়।


 


তবে একটি জায়গায় এসে সে কেন যেন মাকড়সার জীবনকে মেনে নিতে পারে না, তার অস্থিরতা বেড়ে যায়, কিছুটা মায়াও তৈরি হয় এই মাকড়সার প্রতি, তা হল মাকড়সা যখন গর্ভবতী হয়, তখন গাছের খোল অথবা পাথরের ফোকরের মধ্যে স্থান গ্রহণ করে এবং পেট থেকে ডিম বের হওয়া থেকে নিয়ে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সে বসে থাকে এবং বাচ্চারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই তারা মাকে খাওয়া শুরু করে দেয় এবং শক্তিশালী হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।


সোমার মনে হয় এই কীটটির প্রতি তার মায়া না হয়ে ভয় কেন হচ্ছে, তার একবার মনে হয় এই ভয়টা তার এক ধরনের ফোবিয়া, আবার মনে হয় ফোবিয়া হতে যাবে কেন; সে ভেতরে ভেতরে সাহস বাড়াতে থাকে।


 


সমস্ত লজ্জা, সমস্ত ভয়, সমস্ত একাকিত্ব ভেঙ্গে একদিন সে সিদ্ধান্ত নেয় এই মাকড়সার কাছে সে যাবেই, ভয়টা তার ভাঙ্গাতেই হবে। তাদের বাড়ির বাগানে সে মাকড়সার জাল খুঁজে বের করে কিছুটা দূরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যাতে করে মাকড়সা লাফ দিয়ে তার কাছে আসতে না পারে। ধীরে ধীরে সে কাছে আসে আর মাকড়সার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোনো অসতর্কতায় কোনো বিপদই না হয়। আরও কাছে এসে সে জালকে স্পর্শ করে, জালটা তার হাতে জড়িয়ে যায় আর মাকড়সা দূরে পালাতে শুরু করে। তার মুখে তখন বিজয়ের হাসি যেন এই মুহূর্তে তার সেই বন্ধুটির মুখ, দিগন্তবিদারী আকাশ আর একটা অদ্ভূত হাওয়া একসাথে খেলা শুরু করে তার সাথে। এই বিকেলটা কেমন সংগীতের মত বেজে উঠে, গুনগুন করে তারও কণ্ঠে বাজে গান, যেন আর কোনো ভয় নেই, আর কোনো বাধা নেই, জীবনের একটা ণ কী করে এত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে এক মুহূর্তে তাকে তখন না দেখা গেলে বোঝাই যেত না।


 


সোমার আনন্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এতটা যে এই কথা কাউকে না বলতে পারা পর্যন্ত তার আনন্দ যেন পূর্ণতা পাচ্ছে না। রাতে সে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমুতে যায় আর ভাবতে থাকে কাল সবাইকে দেখাবে মাকড়সাকে দেখে সে ভয় পায় না। সে পরিকল্পনা করে মনে মনে যে প্রথম এই সংবাদটি দেবে তার বন্ধুটিকে উপহার হিসেবে, তারপর তার সেই দুই বান্ধবীকে, যারা সমস্ত কলেজ তার মাকড়সা ভয়ের কথা বলে বেড়িয়েছে, তারপর তাদের সামনেও কোনো একটা মাকড়সাকে হাতে নিয়ে আদর করবে আর বোঝাবে এই মাকড়সাটির প্রতি আসলে আমাদের মায়া করা উচিত, এরা মাত্র ১ বছর বাঁচে। এসব ভাবতে ভাবতে সোমা কখন ঘুমিয়ে পড়ে একটা দীর্ঘ দিনের ভয়কে দূর করতে পারা জয়ের হাসি মুখ নিয়ে তা সে নিজেই জানে না। রাত তিনটা বা চারটার দিকে ভোর রাত সে সময় হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠে আবার মাকড়সা বলে। ভয়ে তার গা কাঁপতে থাকে আর কঁকিয়ে উঠতে থাকে, সে অন্ধকারে তাকালেই তার মনে হয় এই বুঝি এখানেই কোথাও ওঁত পেতে আছে একটি মাকড়সা। কেননা স্বপ্নে সে দেখেছিল, মাকড়সার বাচ্চারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই তারা মাকে খাওয়া শুরু করে এবং শক্তিশালী হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।


 


 


চা বাগান


 


 


নিয়তি বলে কোন কিছু কি আসলেই নেই- ভাগ্য-অদৃষ্ট-নসিব বলে আসলেই কি কিছু নেই, তাহলে আমরা যা চাই তা করতে পারি না কেন, আমরা যা স্বপ্ন দেখি তা পাই না কেন, আমাদের কেন কেবলই মনে হয় আমরা নিয়ন্ত্রিত- আমাদের চোখের সামনে তাহলে কেন এসে দাঁড়ায় কোন না কোন নিয়ন্ত্রণ কর্তা। আমাদের ইচ্ছেমত কিছু হয় না -আমাদের ইচ্ছেমত আমরা কাউকে ভালবাসতে পারি না- কথা বলতে পারি না- হাসতে পারি না- কোন এক নিয়ন্ত্রণকর্তা যার বাগানে আমরা কাজ করি সেই আমাদের নিয়তি- সেই আমাদের ভাগ্য-অদৃষ্ট-নসিব।


 


এই যে নিপুণ হাতে ছেঁটে রাখা চা গাছগুলো, যে কাউকে স্বীকার করতে হবে এসব কোনো মহৎ, সৎ শিল্পীর কাজ; এসব ভালো মানুষের ভালোবেসে করা কোনো কাজ। উঁচু উঁচু টিলা ধরে এত সবুজ আর সবুজ, মনে হয় একটি সবুজের দীর্ঘ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে কত শত পাহাড়-টিলা, যেন হাজার হাজার বছরের দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে ঢেকে রেখেছে এই সবুজের শিল্প, যেভাবে কবি সমস্ত কষ্টকে পুড়িয়ে গড়ে তোলেন কবিতা।


এই যে সুভাষ আর ফুলমতি, ওদের দেখে কি মনে হয় ব্রিটিশদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় চা শ্রমিকরা প্রায় ৯০ বছর আগে মুল্লুকে চলো বা বাড়িতে চলো আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল, ওদের দেখলে কি মনে হয় ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনী বন্দুকের নল চেপে ধরেছিল সেই আন্দোলনকে, চাঁদপুর জাহাজঘাটে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়েছিল শত শত চা শ্রমিককে।


সুভাষ আর ফুলমতিকে দেখলে মনে হয় ওরা শুধু মাথা নুইয়ে কাজ করতে জানে, কষ্টগুলো দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে জানে চা বাগান, প্রলম্বিত সবুজের কারুকাজকে। হয়ত এই কারণে যে, ও জানে শত চেষ্টা করেও একজন শ্রমিক সারা দিন কাজ করে ৫০ টাকার বেশি পাবে না, হয়ত এই কারণেই যে সে জানে তিন বেলা খাওয়া জোগাড় করতে পারে না, হয়ত এই কারণেই যে সে জানে ব্রিটিশরা এলো, পাকিস্তানিরা এলো, আবার চলেও গেল। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো কিন্তু তাদের জীবন তেমনই রয়ে গেল।


ভাবছিলাম কত শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন ওদের আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে, ভাবছিলাম ফুলমতির কথাও। ফুলমতিও জানে চা বাগানে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবের আগের দিনেও কাজ করতে হয়, কাগজে-কলমে হয়তবা গর্ভকালীন ছুটি ছ’সপ্তাহ মঞ্জুর আছে, তা তারা কাজের চাপে ভোগ করতে পারে কি-না কে জানে, আরও ভাবছিলাম এই কারণে যে ফুলমতি নামের যে মেয়েটিকে এখন আমি দেখছি সে গর্ভবতী।


 


তবে বেশ কিছু দৃশ্য আজও আমার স্মৃতিতে শিউরে উঠে, সেসব দৃশ্য মনে পড়লে নিজেকেও কেমন বন্দি বন্দি মনে হয়। লম্বা লাঠি হাতে সরদাররা একেকটি শ্রমিক লাইনে ঘুরে ঘুরে সুর করে হাঁকেন, এর ঠিক কিছুণের মধ্যেই দেখা যায় সারিবদ্ধভাবে চা বাগানের নারী-শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য লাইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আমার সেই দাসযুগের কথা মনে পড়ে, মনে হয় ওদের হাতে-পায়ে যেন বেড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাজে।


এরা সকাল ৯টায় বের হয়ে চা বাগানে নির্ধারিত সেকশনে যায়, রোদ-বৃষ্টি-খরা মাথায় নিয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চা পাতা তুলে, মাঝে যতটুকু সময় পায় তা শুধু খাবার খাওয়ার জন্য। এ সময় এরা গাছের ছায়ায় বসে শুকনো রুটি অথবা কচি চা পাতা দিয়ে বানানো খাবার অথবা চিড়া খেয়ে নিয়ে আবার কাজে যায়। সারাদিনের পাতা তোলার পর চা পাতাগুলোর মাপ শেষে পাতিঘরে পাতা জমা দিয়ে তবে বাড়ি ফেরে।


 


 


মাঝারি উচ্চতার, কালো কিন্তু অসম্ভব সুন্দর মুখাবয়বের অধিকারী সুভাষ, যাকে বলা যায় সুপুরুষ, এই বাইশ বছরের যুবকটিই এক বছর আগে বিয়ে করেছিল ফুলমতিকে। ওদের শরীর থেকে এখনও যায়নি ভালোবাসার গন্ধ, দাম্পত্য সুখের রঙ যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওদের সমস্ত শরীর জুড়ে। অথবা এই রং, এই গন্ধ কি কখনও হারিয়ে যায়? যায় হয়তবা। সুভাষ ভাবছিল খুব বেশি দিন হয়নি ওদের বিয়ের। এই এক বছরেই কত কিছু হয়ে গেল। মা-বাপ মরা ছেলেটি যে মাকে পেয়েছিল মানে ফুলমতির মাকে, সে মা-ও মারা গেল মাস তিনেক আগে। তার স্পষ্ট মনে পড়ে মা তাকে মরার আগে বলেছিল এই ফুলমতিকে দেখে রাখিস বাবা। ও খুব ভাল মেয়ে। এরপর থেকে সুভাষের দায়িত্ব যেন আগের চাইতে আরও বেশি বেড়ে গেল, এত বেশি সতর্ক হয়ে গেল যে নিজে দুঃখ-কষ্ট পাই পাব কিন্তু ফুলমতিকে কোনো কষ্ট দেওয়া যাবে না।


 


আর ফুলমতির কাছে সুভাষ যেন শুধু স্বামী নন, সাক্ষাৎ দেবতা, এই পতিদেবতার কাছে যেন কোনো কিছু আবদার করতে নেই, নিজের দুঃখ-কষ্ট বলতে নেই, কেবল স্বামীর সেবা করে যাওয়া। সুভাষও জানে, সে এমন একজনকে ঘরের লক্ষ্মী পেয়েছে যার জন্য সবকিছুই স্বামী হিসেবে করা উচিত। কিন্তু অভাব এমন এক জিনিস যে প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি কোনো কিছুই মানে না, কোনো কিছুই তার সামনে দাঁড়াতে পারে না, সমুদ্রের মত হাঁ করে থাকে, সবকিছু খেয়ে ফেলতে চায়, আপাদমস্তক। সুভাষও তাই অভাবকে নিয়তি হিসেবে মানতে নারাজ, আবার অভাবের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসবে তাও নয়, যেন একটু সময় নিয়ে অল্প অল্প করে বুঝেশুনে এগুতে হবে- তাড়াতে হবে অভাব। শুধু অভাবের বিরুদ্ধ তার লড়াইয়ের ধরন এমন তা কিন্তু নয়, সবেেত্রই সে ঠাণ্ডা সুস্থির স্বভাবে কাজ করে এগুতে চায়। তাই গর্ভবতী বউকে নিয়ে তার যে ভাবনা, ছুটি চাওয়ার হিসাব-নিকাশ সেটাও সে করে রেখেছে নিখুঁতভাবে, যদিও জানে না ছুটি আদৌ পাওয়া হবে কি-না।


 


দিন যতই যায় ততই ফুলমতির প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে, সুভাষেরও স্থির সিদ্ধান্তে আসার সময় আসতে থাকে সে কাকে কখন কীভাবে বলবে ছুটির কথা। কেননা এই ছুটি চাওয়ার সাহস কোনো চা শ্রমিকই করতে চায় না- কখনও কখনও এমন হয় যে ছুটি চাইতে গেলে বলে দেওয়া হয় কাল থেকে চা বাগানে আর না আসতে, কখনও কখনও নয়, যারা ছুটি চেয়েছে তাদের অনেকেরই এমন কিছু হয়েছে। কাজেই সুভাষের এমন কিছু করা যাবে না যাতে তাদের চাকরি যায়, বা এমনভাবে ছুটি চাইতে হবে যেন চাকরিটাও থাকে, ছুটিটাও পাওয়া যায়। সুভাষ ভাবে, এর আগে যারা ছুটি চেয়েছে সবাই সরদারকে অনুরোধ করেছে। সুভাষের ধারণা সরদারকে নয়, ম্যানেজার স্যারের কাছে ছুটি চাইলে সে কখনও না করবে না, সুভাষ অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তই স্থির করে যে সে ম্যানেজার স্যারের কাছেই ছুটি চাইবে আর পরিকল্পনা করতে থাকে কীভাবে, কখন ম্যানেজার স্যারের কাছে ছুটিটা চাওয়া যায়।


 


এরই মাঝে একদিন ফুলমতি সুভাষের সাথে আলাপ করছিল যে তার কাকীরা তাকে বলেছে চা বাগানে বাচ্চা প্রসব করলে নাকি মরা বাচ্চা হয়। তার কাকীরা এরকম এক ঘটনার প্রত্যদর্শীও বটে। ফুলমতি যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন সুভাষও টের পেয়েছিল তারা কথার ভেতরে কোথায় যেন একটা ভয়, একটা হতাশা, একটা কান্না শিউরে উঠছিল।


সুভাষ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে কালই ম্যানেজার স্যারের বাসায় যাবে এবং যেভাবেই হোক ছুটি তাকে নিতেই হবে। সুভাষ ভাবে, ম্যানেজার স্যারের বাড়িতে হয়ত তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না, কিন্তু খুব ভোরে সে বাগানে হাঁটতে বের হয় সেই সময়টাই তার জন্য ছুটি চাওয়ার মোম সময়।


 


ফুলমতি কি জানে না তার বাচ্চার জন্য ছুটি কেন, চাকরিও যদি চলে যায় তাতে তার কিছু যায় আসে না, তার বাচ্চা, তার শিশু সন্তান পৃথিবীর যাবতীয় সুখ-দুঃখের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু সেও পারে না এমন সিদ্ধান্ত নিতে যে সিদ্ধান্তে হয়ত তাদের না খেয়ে থাকতে হবে, হয়ত তাদের ভিটেহারা হতে হবে, হয়ত তাদের সামনে তখন শুধু খোলা আকাশ আকাশের নিচে দিন কাটানোই হবে ভবিষ্যৎ। তাই সে আবার এগুতেও চায় না, ভাবতেও চায় না বা অভাব এমন এক সমুদ্র যা শুধু গ্রাস করতেই জানে, কিছু দিতে জানে না, এ কথা ফুলমতিও জানে।


 


এক একটা দিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে দেয় ফুলমতি, এক একটা দিন চাপা কান্না, আর পেটের ভেতরের বাচ্চার কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় দিন। দিন যে যায়, আসে এই পৃথিবীতে কোনো কিছু যায় না, বরং আসে। কেউ তার জন্য প্রস্তুত থাকে, আবার কেউ তার জন্য প্রস্তুত থাকে না। ফুলমতিরও দিন আসছে, এতটা ফুটফুটে বাচ্চা, ঘর-সংসার আলো করে দিয়ে একটি দিন হেসে উঠবে ঠিকই তাদের জন্য। তাই ফুলমতি চা বাগানে যায়, আস্তে ধীরে কাজ করে, আর সতর্ক থাকে, মনে মনে ভাবতে থাকে যদি প্রচণ্ড প্রসব ব্যথা উঠে সে দৌড়ে চলে আসবে ঘরে, তারপরও বাগানে প্রসব নয়। কিন্তু এই কথা তার মাথায় আসে না প্রচণ্ড প্রসব ব্যথা উঠলে সে দৌড়াবে কীভাবে। সে হয়ত কয়েকজনকে বলেও রাখে তাকে যেন বাচ্চা প্রসবের ব্যথা উঠলে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, সে এও বলে রাখে যে এই গল্প তো সবার জানা চা বাগানে বাচ্চা প্রসব করলে বাচ্চা মৃত হয়। ফুলমতি চায় না সে মৃত বাচ্চা প্রসব করুক, ফুলমতি কেন কোনো মা-ই চান না যে মৃত বাচ্চা প্রসব করতে। কোনো মা-বোনই চান না কারো মৃত বাচ্চা হোক।


 


ফুলমতি কখনও কাজ করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর তখন একটু কান্তি, একটু অবসাদের দৃষ্টিতে এই সবুজ পাহাড়, এই থরে থরে সাজানো সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, তোরাও কি আমার সন্তান না, কত যত্ন, কত কষ্ট, কত স্নেহ, কত প্রেম দিয়ে এই যে তোদের বড় করে তুলি তোরা কেন তোদের ভাইকে এই অভিশাপ দিবি। ফুলমতি কিছুতেই মানতে পারে না এই অভিশাপ, এই পাহাড়ের এই অভিশাপ এই সবুজের, এই অভিশাপ এই সন্তানের মত করে ধীরে ধীরে বড় করে তোলা চা বাগানের কিংবা ফুলমতি হয়ত জানে না এই পাহাড় এভাবে থাকতে চায়নি, চেয়েছিল হেলেদুলে, নেচে-গেয়ে তার সমস্ত শরীর ফুটিয়ে তুলবে জংলি ফুল, ফুলমতি হয়ত জানে না এই সবুজ চা বাগানে এভাবে থাকতে চায়নি, সে চেয়েছিল যে তাকে ভালোবাসে তারাই যেন পায় তার আশীর্বাদ, অথবা ফুলমতি হয়ত জানে না সে যে কাজ করছে এটাও সে করতে চায় না, তাকে দিয়ে অন্যায়ভাবে করানো হচ্ছে, যে ভালোবাসার ভাগ তার পাওয়া দরকার তাকে এই চা বাগানের মালিক কখনও তা দেয় না।


 


সুভাষ খুব ভোরে উঠে চলে এলো চা বাগানের এমন এক পথে যেখানে ম্যানেজার স্যার মর্নিং ওয়াক করেন। চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে থাকল যেন কোনোভাবেই ম্যানেজার স্যার তার চোখ এড়িয়ে না যেতে পারেন। এক ঘণ্টা হয়ে গেল ম্যানেজার স্যারের আসার নাম নেই, দুই ঘণ্টা হল, সুভাষের সন্দেহ হল হয়ত তার এই পথে আসার আগেই ম্যানেজার স্যার রাস্তা ধরে চলে গেছেন। কিন্তু ফেরত পথে তো আসবেন আটটা বেজে গেল তারপরও উনি বাড়ি ফিরছেন না, নয়টা বেজে গেল তারপরও উনি বাড়ি ফিরছেন না, দশটা বেজে গেল তারপরও উনি বাড়ি ফিরছেন না। এদিকে খুব ভোরে না খেয়ে বেরুনোয় প্রচণ্ড খিদে লেগে গেল তার, কিন্তু আজ যে তাকে দেখা করতেই হবে, ছুটি তাকে নিতেই হবে। ম্যানেজার স্যার গতকালই ঢাকা থেকে ফিরেছেন, হয়ত আজই হিসাব-নিকাশ দেখে চলে যাবেন।


সুভাষ সাহস করে ম্যানেজার বাবুর বাগান বাড়ির দিকে এগুতে লাগল। গেটের সামনে আসতেই এক দারোয়ান তাকে জিজ্ঞেস করল কার কাছে সে এসেছে। সুভাষ বলল ম্যানেজার স্যারের কাছে। দারোয়ান জানাল ম্যানেজার স্যার গতকালই ঢাকা চলে গেছেন। সুভাষের মাথায় যেন বাজ পড়ল। কী করবে ভাবতে ভাবতে দেখল শেষ ভরসা চা বাগানের সরদার, তাকে হাতে-পায়ে ধরে হলেও ছুটি নিতেই হবে। নিজের ছেলের চাইতে কি মান-সম্মান, লাজ-লজ্জা বড়? সে বুদ্ধি আঁটল ছুটি না দেওয়া পর্যন্ত সে সরদারের পা ধরে বসে থাকবে।


 


সকালে উঠে আজ স্বামীকে না দেখতে পেয়ে, তাকে না জানিয়ে সে কোথায় চলে যেতে পারে এরকম ভাবতে ভাবতে সরদারের বাঁশি ফুঁ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগানের কাজে যেতে বাধ্য হল ফুলমতি। কী যেন একটা হয়েছে কোথাও। আবহাওয়াটাও কেমন খারাপ মনে হচ্ছে তার, অন্যদিনের মত নয়, অন্যদিনের চেয়ে আজ যেন একটু বেশি গরম, বা রোদের তীব্রতা যেন আজ একটু বেশিই বোধ হয় তার। অন্যদিন এত ঘামে না ফুলমতি, আজ যেন একটু বেশিই ঘামছে, ফুলমতির কি তাহলে শরীর খারাপ। ফুলমতি একবার সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত কোমরে চেপে দৃষ্টিটা দিগন্তের দিকে নেবার চেষ্টা করে। এরপর আবার কাজ। হঠাৎ ফুলমতি বসে পড়ে, ব্যথাটা ক্রমশই বাড়ছে বলে মনে হয়, ফুলমতি বুঝতে পারে এটা প্রসবেরই ব্যথা, এবং এটাও বুঝতে পারে যে সে এখন চা বাগানে। তারপর সে একবার চা বাগানেই কাজ করে কাকীর দিকে তাকায়, কিছু একটা বলতে চেয়েছিল সম্ভবত সেই গল্পের ইঙ্গিতটা, চা বাগানে বাচ্চা প্রসব করলে মৃত বাচ্চা হয় কিন্তু বলতে পারেনি। ব্যথায় সমস্ত শরীর তার অবশ হয়ে পড়ে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখন তার চারপাশে চা বাগানের শ্রমিক মেয়েরা দাঁড়িয়ে, কাকী এসে ফুলমতির মুখটি কোলে নেয়, আরেক কাকীর কোলে তখন ফুটফুটে ছেলে-বাচ্চা।


 


ফুলমতির যখন জ্ঞান ফিরে, তখন দেখে সে তার ঘরের বিছানায়, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর একটি কুপি জ্বলছে, সে বাঁ হাত দিয়ে একবার বাম পাশে কিছু একটা আছে কি-না বোঝার চেষ্টা করে, তারপর ডান হাত নাড়াতেই টের পায় তার ফুটফুটে বাচ্চার অস্তিত্ব। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকে, তখন খুব দূরে একটা শেয়াল চিৎকার করছিল আর তার বাড়ির পাশের কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল। এর কিছুণ পর টের পেল তার বিছানার পাশেই একটি ভাঙা চেয়ারে বসে আছে সুভাষ।


 


 


 


 


মার্কসবাদ ও প্রেম


 


বালিকাকাণ্ড


 


মেয়েটির বাসায় ওর আপার অনেক বন্ধু-বান্ধব আসত, ওদের সব সময়ের খাওয়া-দাওয়া ছিল লাল চা আর পাশের দোকানের বিস্কুট। তারপরও তারা আসত। ওরা তার মাকে খুব পছন্দ করত। আপা না থাকলে ওরা ওর সাথেই আড্ডা দিত। বন্ধুরা ওকে পছন্দ করত খুব। ওদের বাসাটা ছিল নদীর তীরে । সেখানে ও সাঁতার শিখেছে। গামছা দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরেছে।


 


ও বলছিল, একদিন আপার এক বন্ধু আমাকে ওদের ক্যাম্পাসে বেড়াতে নিয়ে গেল। সেখানেই হঠাৎ আমাকে বলল সে আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আমি সে দিনই বুঝি আমি অনেক বড় হয়েছি। কী যে অবস্থা ছিল সেদিন। আমি তখন নবম কি দশমে এ পড়ি। ক্যাম্পাসের সবাই জেনে গেল আমাদের প্রেম। আমি বাসায় এসে আপাকে বলার পরই সে ক্ষেপে গেল। আপার বন্ধুরা ওকে হলে গিয়ে ধমক দিয়ে আসল। ওর আমাদের বাসায় আসা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ও বাম সংগঠনে যোগ দিল। একদিন বাসায় তাকে ডেকেও আনা হল। বলা হল, তোমাকে আমরা কত স্নেহ করতাম। আর তুমি এটা কী করলে। আসলে ওদের জায়গা থেকে এটা তো ঠিকই। এরপর শুনতাম এইদিন শিবির ওকে পেটাচ্ছে। সে কেমন হয়ে গেল। এর মধ্যে আমরা চিঠি লিখতাম। কী যে অবস্থা ছিল। আমি বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে সেসব চিঠি পড়তাম। একদিন আপা ধরেও ফেলল। কী যে করল সে দিন আমাকে। অথচ এই আপার শরীরের স্পর্শ ছাড়া, তার গায়ের সাথে গা না লাগানো ছাড়া আমি ঘুমাতে পারতাম না।


 


আপার চাকরি হয়ে গেল। আপা এতটাই মেধাবী ছিল যে সে সেখানে প্রথম ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়েই তার চাকরি হওয়ার কথা ছিল। একটা পলিটেকনিকে চাকরি হল। আপা চলে যাবে। আমার যে কী কান্না। তারপর আপার বিয়ে হল। ওদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছেলের সাথে। সেই বিয়েটি আমিই ঠিক করেছি। ওই ছেলে নাকি কে না পেয়ে কান্নাকাটি করত। ভাবলাম কাছের ছেলের সাথেই বিয়ে হওয়া ভালো। বিয়ে হল। বিয়ের পর এক সপ্তাহের মধ্যেই ওদের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হল। কী যে অবস্থা হল। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য জোর করা হল। সে সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দিল। ওরা ওকে খুবই নির্যাতন চালাত। এমনও হত না খেয়ে রাখত। আমাদের বাসার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। যা হোক এখন ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে। যদিও বাচ্চাটার ঠোঁট একটু কেমন যেন। কিন্তু এটা হওয়াতে ওদের ভালো হয়েছে। আমার মনে হয় নির্যাতনের কারণেই বাচ্চাটা এমন হয়েছে। সেলাই করলেই আস্তে আস্তে অবশ্য ঠিক হয়ে যাবে। যাই হোক এই কারণে এখন অবশ্য এদের সম্পর্কের গাঢ়ত্ব তৈরি হয়েছে।


 


কলেজে আমি কিছুই পড়িনি। পরীক্ষার দুই মাস আগে মা বাবার তোড়জোড়। ওরা শুধু কান্নাকাটি করত। আমার মেয়েটার কী হল। তখন তসলিমা নাসরিন পড়েছি। হুমায়ুন আজাদ পড়েছি। আমি তখন বাসায় একা। এসব পড়তে পড়তে আমার মনে হল আমাদের প্রেমে ধর্ম কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এক প্রকার জেদ করেই আমি পাড়ার সবচেয়ে নষ্ট ছেলেটির সঙ্গে আমি মেলামেশা শুরু করি। লোকজন যা বলে বলুক, আমি কাউকেই মানতাম না। একদিন ওদেরই একজন আমাকে ধর্ষণ করে। এরকম ঘটনাও ঘটেছে আমি টেবিলে বসে শুধু নিচের দিকে চেয়ে থেকেছি। শুধু নিচের দিকেই তাকিয়ে থেকেছি। এটা দেখে বাবা কেঁদে ফেলতেন। সে সময় তসলিমা-হুমায়ুন পড়ার কারণে বখাটেদের সাথে মিশতাম। পাড়ার ছেলেরা যারা টিজ করত তাদের সাথে মিশতাম। যাই হোক, রেজাল্ট দেওয়ার পর সবাই অবাক, আমি এ প্লাস পেয়েছি। কেউ বিশ্বাসই করেনি। এরপর ভার্সিটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম। যদিও কাস একটাও করেনি। এটা অবশ্য বাসায় জানে না। সে সময় একজনের প্রেমে পড়ি। ওর সাথেই সারাণ থাকতাম। সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম। মনে হত রিকশায় যখন ঘুরতাম ওর সাথেই শুধু ঘুরি। এক পর্যায়ে আমার বুয়েটে চান্স হয় না। ওর হয়ে যায়। ও আমাকে এভয়েড করতে থাকে। সে বলে যে তোমার সাথে আমার আর মেশা হবে না। ও ছিল হিন্দু। এর আগের যিনি তিনিও ছিলেন হিন্দু। এরপর আমাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান হল। মা-বাবার অনেক আশা। এটা আমাকে পূরণ করতে হবে। একটা পার্টিতে ঢুকেছি। মার্কসবাদী পার্টি। আমি এখানেই জীবন দিয়ে দেব। এর মধ্যে এক বড় ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে আমাকে একদিন ফোন করে। সে এক সময় পার্টি করত। এখন বিবাহিত। তার একটা মেয়ে আছে। সে একদিন আমাকে বলে এই ধরনের মেয়েরা সাধারণত ফ্রি সেক্সে বিশ্বাস করে। সে আমাকে অফার করে। আমি অবাক হয়ে যাই সে কীভাবে এটা বলতে পারল। সে বলে যে সে বিবাহিত জীবনে সুখী না। এরপর সে আমাকে ফোন করলে আমি তার ফোন ধরি না।


 


এই পার্টিতে এসে আমি আরেকজনের প্রেমে পড়ে যাই। সে অবশ্য অনেক বড়। আমাকে পাত্তা দেয় না। যে ছেলেটির সাথে আমার প্রথম প্রেম, তখনকার প্রেম। ইস এই যে দেখছেন হাতে দাগ, আমার মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে আমি কম্পাসের কাঁটা এখানে এই হাতে ঢুকিয়ে দিতাম। যে ছেলেটিকে ছোটবেলায় ভালোবাসতাম, সেই ছেলেটি এখন ফার্মগেটেই থাকে। সে এখন পিএইচডি করে। সে পার্টিতেই তার জীবন দিয়ে দিবে। আমিও পার্টিতেই জীবন দিয়ে দিব।


 


 


বালককাণ্ড


 


পৃথিবীতে কখনও কখনও কারও কারও জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যার জন্যে সে অপো করে না, কিন্তু ঘটে যায়; আবার কারও কারও জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যার জন্য সে অপো করে এবং ঘটেও আবার কিছু কিছু সময় এই দুই ঘটনাই একইসাথে এমনভাবে ঘটে, যার একটির জন্য সে অপো করে ছিল আরেকটির জন্য সে অপো করেনি। আমার জীবনে এই দুই ঘটনা এমনভাবে একই সাথে ঘটল যে মানুষ যে কেন কখনও কখনও তালগোল পাকিয়ে ফেলে, মানুষ যে কেন কখনও কখনও সত্যি অসহায় হয়ে পড়ে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম এবং অবশ্যই এটি একটি মেয়েকে নিয়ে।


 


আমি বুঝতে পারছিলাম না সে কেন আমার সঙ্গে প্রেম করতে চায়, আমি তাকে এও বলেছি আমি অন্য আট-দশজনের মত না যে হাজারজনের সঙ্গে প্রেম করব আর একজনকে বিয়ে করব-আমি এমন মানুষ নই। আবার এও ভাবছিলাম এত সব কাহিনী তার আমাকে শুনানোর মানে কী, সে যদি প্রেম করতেই চায় তাহলে এসব তো তার লুকানোর কথা ছিল। আমার ভেতরে ভেতরে ওকে নিয়ে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে, আবার ভয়ও লাগে এই ভেবে যে ও কি এমন কেউ যে আমাকে চেখে দেখতে চায়। একবার আমার মনে হয় হতেও পারে মার্কসবাদ, প্রগতিশীল, তসলিমা নাসরিন এরা তো সবাই ফ্রি সেক্সে বিশ্বাসী, অমূলক কিছু নয়। এছাড়া সে এও বলল আমার কোনো এক বড় ভাই তাকে সেক্সের অফার করেছে, একটা মানুষের মধ্যে নিশ্চয়ই সে এমন কিছু পেয়েছে যে কারণে সে এই অফার করেছে, সে নিশ্চয়ই যে কাউকে অফার করে না। কিন্তু ও এইসব বলার পর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে এত তোড়জোড় করছিল যে আমি বুঝে ফেলি ও আসলে ভালো মেয়ে নয়। আমি ভাবতে থাকি, এরকম একটি মেয়ের সঙ্গে আমি প্রেম করব, যে মেয়ে কলেজে থাকতে একবার ধর্ষিত হয়েছিল, যে মেয়ে ভার্সিটিতে এসে কয়েকজনের সঙ্গে শুয়েছে, ঘৃণায় নিজেই নিজেকে সামাল দিতে পারছিলাম না। আমার ভেতরে যে গোপন স্বপ্নগুলো ফুটে উঠছিল হেলেদুলে, যে বালিশের নিচে রেখে দিয়েছিলাম আমার গোপন স্বপ্ন, সেসব হঠাৎ করে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে উঠল যে আমার মনে হল বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমি। বোধহয় এইখনই সেই ডাইনি মেয়েটা আমার দিকে তেড়ে আসছে, বোধহয় সে আমাকে খেয়ে ফেলবে, তার মুখ আমার মনে পড়ছিল, তার হাসি আমার মনে পড়ছিল, এসবের মধ্যে আমার সেই স্বপ্নবালিকাটি নেই, যেন তার মুখ তার হাসি এক রাসীর। আর যখনই এসব মনে পড়ে বুঝতে পারি আমি যেন অসুস্থ এক মানুষ, আমাকে কে যেন আঁচড় দিয়েছে, যেন আমার সেই সহজ, সরল, স্বাভাবিক জীবনে কোথাও একটা আঘাত লেগেছে, এতটাই জোরে আঘাত যে সেদিন হঠাৎ রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে মরতেই বসছিলাম, যা আমার জীবনে এই প্রথম স্পষ্টত মনে করিয়ে দিচ্ছে এতটা অসচেতন আমি কখনোই ছিলাম না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এই ডাইনি, রাুসী মেয়েটি আমাকে অবচেতনেও খেয়ে ফেলছে, আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে, পিষে খাওয়ার জন্যে অপো করছে। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে কোনোভাবেই হোক ওর থেকে আমাকে দূরে থাকতে হবে, ও যেন কখনই আমার কাছে না আসে সেরকম কিছু একটা করতে হবে, ও যেন কখনই আমার চোখের সামনে না পড়ে সেরকম কিছু একটা করতে হবে। আমি ওকে মোবাইল করা বন্ধ করে দেই, ও ফোন করলে আমি ব্যস্ত বলে মোবাইল বন্ধ করে দেই, ও কোথাও আসতে বললে আমি সেখানে যেতে পারব না বলে জানিয়ে দেই। যেন ও বুঝতে পারে ওকে চাচ্ছি না, যেন ও বুঝতে পারে আমি ওকে ঘৃণা করছি, যেন ও বুঝতে পারে আমি তার জন্য নই। এইভাবে প্রায় একমাস আমি স্বাভাবিক হতে থাকি আর ওর মোবাইল করা, কোথাও যেতে বলা, দেখা করতে বলা বন্ধ হতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসি, আমি সত্যিই ভুলে যেতে পেরেছি তাকে, আর সেও বুঝে সরে যেতে পেরেছে।


 


এর বেশ কিছুদিন পর আমি রাস্তার আইল্যান্ডে বসেছিলাম, তখন হঠাৎ ওকে দেখতে পাই এমনভাবে যে প্রথমে মনে হচ্ছিল সুমি না, আমি আবারও তাকাই, কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি আবারও তাকাই হ্যাঁ, ও সেই সুমিই, অবিকল সুমির মত দেখতে, মানে সুমিই একটি ছেলের হাত ধরে নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছে, যেন একটি স্বপ্ন হাতে নিয়ে হাঁটছে, যেন এই স্বপ্নটির হাত ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে কোথাও, তাই অনেক দৃঢ় করে ধরে রেখেছে হাত, যেন এই হাতটির মধ্যেই তার সকল নিরাপত্তা, সকল প্রেম, সকল আবেগ, সকল দ্রোহ, সকল কিছু লুকিয়ে আছে।


 


আমার ভেতরে কোথা থেকে যেন কান্নার বুদবুদ উঠতে থাকে, যেন রক্তের ভেতরে ফিনকি দিয়ে উঠতে থাকে কান্নার জল, যে মেয়েটিকে আমি ডাইনি ভেবেছিলাম, যে মেয়েটিকে আমি রাসী ভেবেছিলাম, যে মেয়েটিকে আমার জীবন থেকে যে কোনোভাবে মুছে ফেলতে পারলেই আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠব ভেবেছিলাম, সেই মেয়েটিকেই, সেই ডাইনিকেই- সেই রাসীটিকেই এতদিন পর হঠাৎ কারও হাত ধরে হাঁটা দেখে এভাবে কান্নার ফোয়ারা উঠল কেন বুঝতে পারছিলাম না। কেবল কেউ এই কান্না দেখে ফেলবে, কেবল হু-হু করে কেঁদে ফেলার ভয়ে, এই সকল মানুষের মধ্যে, সকল ভিড়ের মধ্যে আর মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে এই ভেবে আমি যেন পালাতে চাইলাম, কচ্ছপের মত আমি যেন লুকিয়ে ফেলতে চাইলাম মুখ, আমি যেন দৌড়ে পালাতে চাইলাম এই মানুষের ভিড় থেকে- আমার নিজেকে প্রচণ্ড একা মনে হতে লাগল, নিজেকে দূর থেকে দেখা একা একটি গাছের মত নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরর্থক, পৃথিবীর সবচেয়ে অসিদ্ধ মানুষ মনে হতে লাগল। তাহলে কি এই রাসীই আমার প্রেমিকা যাকে দেখে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে কি এই ডাইনিকেই আমি চাই যাকে দেখে অস্বাভাবিক হয়ে উঠি, তাহলে কি সেই আমার প্রেমিকা যাকে ভালোবাসা মানে আমার মৃত্যু।


 


এর অনেকদিন পর আমি জানতে পারি ও আমাকে তাকে নিয়ে যা যা বলেছিল সবই তার বানানো, ওর যেসব বন্ধুর কাছ থেকে ওর সম্পর্কে শুনেছি সবাই আসলে ধারণা থেকেই কথাগুলো বলেছিল। আর যখন আমি এসব জানতে পারি তখন আমি সদ্য বিবাহিত এক যুবক আর শুনেছি সে এখনও বিয়ে করেনি।


 


 


 


 


ভাদরকাটানি


 


বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে আসলে পার্থক্যটা কি, কেউ কিছু বিশ্বাস করে মানে এটা আছে- এটা সত্য, কেউ কিছু বিশ্বাস করে না মানে এটা নেই, এটা অসত্য। কিন্তু যে জিনিস প্রমাণ করা যায় না, তাকে নিয়ে কেউ যদি বলেন আমি বিশ্বাস করি এটা সত্য আর আরেকজন যদি বলেন আমি বিশ্বাস করি না এটা অসত্য তখন আমরা কি করব। এরকম প্রমাণঅযোগ্য কোনো ঘটনা নিয়ে আমরা কতটুকু বচসায় যেতে পারি, এরকম ভাবতে ভাবতে পঞ্চগড়ের খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।


 


এখানে মাঠের পর মাঠ, দিগন্তের পর দিগন্ত, সবুজের পর সবুজ আর তার সাথে আকাশ এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে পঞ্চগড়ের যে কোনো গ্রামের দিকে তাকালে মনে হয় এখানকার মানুষগুলো যেন আকাশ দূর থেকে এতদিন যে সহজ, সরল রঙিন কাল বাহারি রকমের মেজাজ দেখে এসেছি এসব মানুষের সামনে দাঁড়ালে যেন মনে হবে সেই তারই হুবহু এক ছবি। আর তাই প্রকৃতির ছক বাঁধা স্বভাবের বাইরে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠে, তাকে চেনাটা একপ্রকার মুশকিল হয়েই পড়ে। যদিও অন্য সব অঞ্চলের মতই এখানে যেমন কান্না, বেদনা, ত রয়েছে; তেমনি রয়েছে হাসি, উচ্ছ্বাস, উৎসব। ভাদরকাটানি নামের একটি উৎসবের কথা এ অঞ্চলে বেশ বিশ্বাসের সাথেই পালন করা হয় বলে শুনেছি, যে উৎসব সেখানকার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বেশ বিশ্বাসের সাথে পালন করে, যে উৎসবে নববধূকে ভাদ্র মাস শুরুর আগেই স্বামী-শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। উৎসব উপলে কোনো নববধূ তিন দিন, কেউ সাত দিন, আবার কেউ কেউ পুরো মাসটাই থেকে যান বাবার বাড়িতে। তবে অধিকাংশ নববধূই ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন বা সাত দিন কাটিয়ে ফিরে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। আর এ সময় নববধূরা স্বামীর মুখ দেখতে পারবেন না বা দেখতে দেওয়া হবে না! দেখা-সাক্ষাৎ হলে তাদের স্বামীরা অন্ধ হয়ে যেতে পারেন, সংসারের অমঙ্গল হবে, নয়তো অপঘাতে স্বামীর মৃত্যু হতে পারে! আমার কাছে যদিও এটি কুসংস্কার বা অপবিশ্বাস কিন্তু লক্ষ্মীর কাছে এটি একেবারেই বিশ্বাস, যে বিশ্বাস একটুও এদিক সেদিক নড়তে পারবে না। পাখ-পাখালির যেমন ছিমছাম একটা সংসার থাকে, সুখ থাকে, মনের আনন্দে গান গাওয়া থাকে, ওদের ঘরটিকে দেখলেও যে কারও তাই মনে হবে, মনে হবে এমন সংসারটিই যেন সবাই মনের ভেতর পুষে রাখে কিন্তু হয় না। লক্ষ্মী সেই সকালে উঠে, রান্না করে, স্বামীকে ডাকে, নাস্তা খাওয়ায় তারপর স্বামী কাজে চলে যায়। লক্ষ্মী সারাদিন ধরে এটা করে, সেটা করে, সংসার নামক রাজ্যে যে কত কাজ থাকতে পারে তা একদিন লক্ষ্মীকে না দেখলে টের পাওয়া মুশকিল। রাতে স্বামী ঘরে ফিরে, ভাতটাত খেয়ে ঘুম, আবার সকাল- এভাবেই কাটছিল ওদের জীবন।


 


এই সংসারটিকেই একবার দেখতে আসেন লক্ষ্মীর মা, যেন পরীক্ষা নিতে এসেছেন উনি, পরখ করে দেখতে এসেছেন তার মেয়ে, মেয়ের জামাই কি আদৌ পারবে এই কঠিন রূঢ়, জঞ্জালময়, কণ্টকময় একটি সংসার জগৎকে সুখী করে তুলতে। এমনিতেই মা আর কতটা ধর্ম-কর্ম করে, মনে হবে এই বয়সেই লক্ষ্মী ধর্ম-কর্মে তার মাকে ছাড়িয়ে গেছে, সেই লক্ষ্মীকেই কি-না সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের কত বকাবকি। ঘুম থেকে উঠে সে গীতার উপর সাদা ফুল দেয়নি কেন, স্বামীকে কাজে যাবার আগে প্রণাম করেনি কেন, হাজারও ধর্ম-কর্মের অজুহাত আজ যেন লক্ষ্মীকে দিতেই হবে। এরপর শুরু হল শিকিার ধর্ম-কর্ম শেখানোর পালা। যেন লক্ষ্মীর এক চুল এদিক-সেদিক হলে পুরো পৃথিবীটাই উল্টে যাবে, স্বামী ধর্ম মানুক আর না মানুক স্বামী হল দেবতা, তাকে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু এই লক্ষ্মীকে যার কি-না সারাদিনে একটুও গল্প করবার অবসর হয় না, এত ছোট সংসার হওয়ার পরও তাকে সবই করতে হবে।


 


মেয়ের চুলে তেল দিতে দিতে মা তাকে গল্প শোনায়, ভাদরকাটানির গল্প- ঠিক গল্প না, মায়ের দেখা গল্প- দেখা ইতিহাস- তাদেরই গ্রামে ওদের মতই ছিল ছোট ছিমছাম সংসার। সেই সংসারে স্বামী যদিও কিছুটা ধর্ম মানত, মেয়েটা ততটা মানত না- এমনভাবেই মানতে না যে প্রায়শ স্বামীর সঙ্গে মেয়েটা ঝগড়াই করত। একবার কী এক কারণে স্বামী ভাদ্র মাসে বাড়িতেই ছিল, কারোরই খেয়াল ছিল না যে ভাদ্র মাসে প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দেখলে অমঙ্গল হয়। ভাদ্র মাস যাবার পর সেই যে ওদের সংসারে অভাব শুরু হল- স্বামী কাজ পায় না কোথাও, একবেলা খায় তো দুই বেলা খায় না- এরকম করে চলতে লাগল আর একদিন শোনা গেল কোন এক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছে।


 


লক্ষ্মীর ভেতরটা যেন হু-হু করে উঠল, যেন এই ঘটনা তার জীবনে না ঘটে, যেন সে আরও বেশি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনই ভুলেও সে ধর্ম-কর্ম নিয়ে কোনো চুল পরিমাণ এদিক-সেদিক হতে দেবে না। মুহূর্তের ভেতরেই লক্ষ্মী কেমন শিউরে উঠল, লক্ষ্মীর ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল আর ভাবতে লাগল এর আগে কি কোথাও কোনো অমঙ্গলকর কাজ করেছে কি-না আর ভাবে, ভাদ্র মাসে সে কোনোদিন স্বামীর মুখ দেখবে না। দু’দিন বাদে লক্ষ্মী যখন তার মাকে বিদায় দিল তখনও তার চোখে-মুখে ছিল প্রতিজ্ঞা আর হারানোর ভয়, যেন একটু এদিক-সেদিক ও কোনো কিছুতেই হতে দেবে না, তাহলেই উল্টে যাবে সব। সংসারে সুখ টিকিয়ে রাখতে হলে যে প্রাণপণ তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতেই হয় তা যেন লক্ষ্মীকে আর কারও বোঝানোর দরকার নেই। যেন লক্ষ্মী সত্যি এবার বুঝে নিয়েছে জগৎ সংসারের ভার।


 


আগে যদিও বিকেল বেলাতে এক-আধবার পাশের বাড়িতে গিয়ে গল্পে জুড়ে দিত তাও এখন আর নেই। আর সে কারণেই পাড়া প্রতিবেশীরা একদিন এসে বেশ কৌতুক করেই বলছিল, কি গো লক্ষ্মীর যে কোনো দেখা-সাাৎ নেই, কোনো সাড়া-শব্দ নেই- হঠাৎ এত স্বামীর প্রেমে পড়ে গেল। লক্ষ্মীও হেসে বলছিল, না গো দিদি সংসারের কাজ সারতে সারতে এখন আর সময় পাই না, ছোট সংসার হলে কী হবে সংসারটা যে একটা জগৎ এটা যখন কেউ বুঝতে পারে তখন কি আর কাজের শেষ থাকে।


 


লক্ষ্মী সকালে উঠে, স্নান সারে, ঠাকুর ঘরে যায়, ফুল তুলে, নাস্তা বানায় স্বামীকে খাইয়ে বিদায় দেয়, একটু বেলা হলেই ঘর লেপা, এটা সেটা পরিষ্কার করা, আবার রান্না, আবার ঠাকুর ঘর , সন্ধ্যার ধূপবাতি এসব করতে করতে সে বারবার মনে রাখে ভাদ্র মাসের প্রথম তিন। এটা কোনোভাবেই ভোলা যাবে নাÑ এটা সব সময় যেন মনে রাখতে হবে, এখন চলছে বৈশাখ তারপর আশ্বিন তারপর ভাদ্র নাম জপের মত করে মনে রাখে সে কোন মাসের কোন দিন এল আর কখন আসবে ভাদ্র মাস।


 


একবার তো দেরি করে স্বামীর বাড়ি ফেরার কারণে তার মধ্যে একপ্রকার ঝড়ই বয়ে গেল- এমন ঝড় সব কিছু কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে গেল তার। সে মনেই করতে পারছিল না, এটা ভাদ্র মাস না কার্তিক মাস না আশ্বিন মাস। তার বারবার মনে হতে লাগল, সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল এটা ভাদ্র মাস আর বুকের ভেতর কেমন হু-হু করে উঠল তার- সেই অমঙ্গল, সংসারের অমঙ্গলের ছাপ বোধহয় লেগেছে, ভাদ্র মাসে তো স্বামীর মুখ দেখা বারণ তবুও সে দেখেছে। লক্ষ্মীর প্রথমে মুখ তারপর শরীরজুড়ে স্বেদবিন্দু জমা হতে লাগল, তারপর বৃষ্টির মত করে যেন ওই সব ঘাম ঝরতে লাগল, সারা শরীর ভিজে গেল তার।


 


এর কিছু সময় পরেই দরজায় ঠুকঠুক শব্দ, সে যেন চমকে উঠল, তার মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ হচ্ছিল না, কোনোরকমে সে দরজা খুলে দেখতে পেল তার স্বামী। অন্য কোনোদিনের মত সে ঝটপট আজ আর গামছাটা এনে দিল না, বরং নিস্প্রভ বসে রইল। স্বামীরও বুঝতে বেশি দেরি হল না, প্রশ্ন করে বসল, কি গো কিছু আজ হয়েছে নাকি তোমার? শরীর খারাপ? যেন সমস্ত কিছু- সমস্ত আবেগ, সমস্ত প্রেম, সমস্ত বুকফাটা কান্নাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হুট করে উঠে দাঁড়াল লক্ষ্মী, কোনো কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল, খাবার বাড়ল, স্বামী খেল, তারপর লক্ষ্মী।


 


এমন করেই দিন যাচ্ছিল ওদের, যেভাবে নৌকোর বৈঠায় এক এক টানে নৌকো এগোয়, সংসারটাও যেন সেভাবে এগুচ্ছিল। মাঝে স্বামীর কাজের চাপ বেড়ে যায়Ñ আজ আসে তো কাল আসে না, রাত-দিন খাটুনি আর লক্ষ্মীর একাকী ঘরে স্বামীর কথা ভাবা, সংসারের কথা ভাবা। লক্ষ্মী কোনো এক বিকেলে একবার পাশের বাড়ির কাকীর সাথেও ভাদরকাটানি নিয়ে আলাপ করছিল যে তার মার কাছে শুনেছে ভাদ্র মাসে প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দেখলে অমঙ্গল হয়। তার মা বলেছে এরকম এক সংসারে স্বামীর মুখ ভাদ্র মাসে দেখায় শেষ পর্যন্ত স্বামীটি মারা যায়। কাকীও তাকে বলেছিল আমরা সবাই এটা পালন করি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকীও বলেছিল বলা তো যায় না কার জীবনে কখন কী ঘটে। লক্ষ্মী একবার তার শাঁখার দিকে তাকায়, আবার ঘর থেকে আয়না বের করে করে ভালো করে সিঁদুর দেয় আর ভিতরে ভিতরে যেন বলতে থাকে- ঠাকুর আমার যেন এমন না হয়।


 


আমি মাঝে মাঝে অবাক হই এই ভেবে যে লক্ষ্মী তার বরকে নিয়ে এত ভাবে, সংসার নিয়ে এত ভাবে, বলতে গেলে পুরো জীবনটাই যে এই নারী সংসারের মুখে তুলে দিচ্ছে তার কি সত্যি কোনো সাধ-আহাদ নেই। তাহলে কি সংসার নামক বস্তুটির সাথে এর চেয়েও আরও বহুগুণ সাধ-আহাদ জড়িয়ে আছে যা কেবল লক্ষ্মী জানে, আমরা নই। হতে পারে বিচিত্র এই জগতের ভিতর সাধ-আহাদেরও রয়েছে হাজারো রকমফের, রয়েছে এমন কিছু গোপন সুখের ডালি যা সহজেই কেউ দেখতে পায় না। লক্ষ্মী তার বর আর সংসার নিয়েই পড়ে থাকে- কথাটি বললাম আরও এই কারণে যে তাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই তার বিয়ের বয়স খুব একটা বেশি নয়, অথচ পোশাক-আশাক, শাড়ি-কাপড় দেখলে মনে হবে তার যেন জগতে সাধ-আহাদ বলে কিছু নেই। শুধু তাই নয়, বরকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া তো দূরে থাক বরের সাথে যে একটু সাধ-আহাদ করে গল্প করবে তাও দেখা যায় না।


 


লক্ষ্মীকে আজ খুব উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছিল, ঝড় বয়ে গেলে পর চারপাশে তাকালে যেমন নুয়ে পড়া গাছ, পথঘাট, ডাল-পালা পড়ে থাকা এমন দেখায় লক্ষ্মীর চোখে-মুখে তেমনি এক তাণ্ডবের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। লক্ষ্মীর বর বীরেন মাঝে মাঝে আসে না এটা সত্য কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে লোকটার কোনো খোঁজখবর নেই- এটা বিচলিত হবার মত সংবাদই বটে। একবার ভাবে বীরেন বুঝি তার মায়ের বাড়ি গিয়ে কোনো একটা কাজে আটকা পড়েছে, আবার ভাবে তাহলে তো কেউ তাকে খবর দিত, আবার ভাবে তাহলে কি তার মা-বাবার বাসায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি-না যে কোনো কিছু কাউকে জানানোর সময় পায়নি।


 


এমনও তো হতে পারে তাকে মহাজন বড় বড় কাজ এলে বন্দরে পাঠায়, সে বোধহয় বন্দরেই গিয়েছে। এরকম কিছু ভাবতে ভাবতে লক্ষ্মী মনে করা চেষ্টা করল এটা যেন কী মাস লক্ষ্মী চাুস দেখতে পেল এটা ভাদ্র মাসার প্রথম তিন দিন সে বরের সাথে কাটিয়েছে। তার নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, একবারও সে বাড়ির বাইরে গেল না, একবার অন্তত একবার পাশের বাড়ির কারও সাথে আলাপ করলেও তো বুঝতে পারত এখন ভাদ্র মাস। তার বুঝতে দেরি হল না এটা অমঙ্গলের ছাপ। তার বুঝতে দেরি হল না বড় ধরনের কিছু একটা ঘটেছে। তার সেই মায়ের গল্পটা মনে পড়ল, মনে পড়ল সেই গল্পে মেয়েটি তার বরকে হারিয়েছিল। তার দু’চোখ দিয়ে কখন থেকে যেন অনবরত কান্না ঝরছিল, তার হাত-পা সারা শরীর অবশ হয়ে পড়ছিল সে চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। যে মাসটির জন্য, যে সময়টিকে নিয়ে এতদিন ধরে সে সতর্ক ছিল, এতটা সময়েও যে ভুলতে দেয়নি নিজেকে এটা ভাদ্র মাস এটা প্রথম তিন দিন সেই ঘটনাটাই আজ তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল। নাকি এই যে মানুষের ভাগ্যে যা থাকে তাকে সে আটকাতে পারে না মানে ভাগ্য বলেও একটা ব্যাপার আছে। একা একটা অন্ধকার ঘরে আজ যে লক্ষ্মী নামের মেয়েটি মরার মত পড়ে আছে সেই মেয়েটিই তো প্রাণপণে বাঁচাতে চেয়েছে তার বরকে তার সংসারকে কোথাও কোনো ত্র“টি হতে দেয়নি। যদিও আমিও অনেক দেখেছি ভালো মানুষগুলোর জীবন যে কী পরিমাণ কষ্টের হয়, হয়তো আমার আরেকটা অভিজ্ঞতার যোগ হল।


চারপাশটা কেমন থমথমে, দূর থেকে একটি শেয়াল একনাগাড়ে ডাকছে তো ডাকছেই আর তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে কুকুর। লক্ষ্মীর চোখ হঠাৎ বড় হয়ে উঠল, হাত-পা কেমন সচল হয়ে উঠল তার। দরজায় কে যেন ঠকঠক করে শব্দ করছে আর বলছে, লক্ষ্মী ঘুমিয়ে গেলা নাকি!


 


প্রকৃতপে ওটা ভাদ্র মাস ছিল কিন্তু লক্ষ্মীর বর প্রতিদিনই বাড়িতে এসেছে। কিন্তু লক্ষ্মীর কেন এমন মনে হল যে সে এক সপ্তাহ যাবত বাড়ি আসে না বা আর আসবে না বা আদৌ আর ফিরবে না, এটা নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি। কিন্তু এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই লক্ষ্মীর মধ্যে আরও কিছু বিষয় প্রকট হয়ে উঠল, এমনকিছু বিষয় যা আরও বেশি ভাবনার উদ্রেক করে মানে লক্ষ্মীর মনে হয়, যে এসেছে সেদিন রাতে সে তার বর নয়। হুবুহু তার বরের মত দেখতে অন্য কেউ, সে বিশ্বাস করতে পারে না ভাদ্র মাসে এভাবে স্বামীর মুখ দেখলে কোনো স্বামী বেঁচে থাকতে পারে। কাজেই সে কেমন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, বোবার মত হয়ে যায়। লক্ষ্মী একটা মেশিনের মত, সবকিছু যেন করে, সকালে উঠে, স্বামীকে নাস্তা দেয়, ঠাকুর ঘরে যায়, পূজাপালি করে, কিন্তু ভাদ্র মাসের কথা আর মনে করে না। কারণ মনে করেই বা কি হবে তার স্বামী তো আর বেঁচে নেই- যে এখন তার সাথে সে তার স্বামীর মত অন্য কেউ। একটি মেশিন-একটি যন্ত্র- স্বয়ংক্রিয় কোনকিছুর মত লক্ষ্মী দিন কাটাতে শুরু করে- স্বয়ংক্রিয় কোন কিছুর মত নয় আমার একবার মনে হয় লক্ষ্মী চরিত্রটি স্বয়ংক্রিয় মানে অটোমেটেড সফ্টওয়্যার জেনারেটেড।


 


লক্ষ্মী কেমন পুতুলের মত হয়ে যেতে থাকে, – লক্ষ্মীকে দেখলে মনে হয় শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় না, ঘামে না, হাসে কিন্তু পুতুলের মত হাসি, কথা বলে কিন্তু পুতুলের মত কথা। এটা প্রথম মনে হয় তার বরের। একবার বর তাকে জিজ্ঞেসও করে-তোমাকে এমন লাগছে কেন? লক্ষ্মী অবাক হয়ে যায়, কিছু বলে না। সে পাশের বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা আমাকে কি এখন পুতুলের মত মনে হয়। পাশের বাড়ির লোকজন কিছু বুঝতে পারে না। একবার তাকায়, তারপর বলে, হ্যাঁ একেবারেই পুতুলের মত। লক্ষ্মীর চারপাশে কেবল মানুষ আর মানুষের ভিড় জমতে থাকে আর লক্ষ্মী হতে থাকে পুতুল। লক্ষ্মী কাউকেই বোঝাতে পারে না সে পুতুলের মত না মানুষের মত।


 


 


 


পাতাবাহার


 


বাসে ওঠে স্বভাবসুলভ পেছনের একটি সিটে বসেই কেমন চমকে গেলাম, কেমন হতচকিত হয়ে গেলাম এই দৃশ্য দেখে যে, সামনের যতগুলো সিট তাতে সবাই একজন একজন করে বসে আছে। আশ্চর্য তো, মানুষ তো সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চায়, সমাজে থাকতে চায়, রাষ্ট্র গঠন করতে চায়; কিন্তু এরা সবাই একটি একটি সিট নিয়ে বসে আছে কেন? বাসে ওঠার লোক আজকে না হয় কম, তাই বলে ওরা এক সিটে দুইজন বসবে না, বসল না কেন, দুইজন বসে তো গল্প করা যেত, দুইজন বসে তো একে অপরজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যেত, দুইজন বসে তো কিছুটা সময় দু’জনে মিলে কাটানো যেত। কিন্তু ওরা একজন একজন করে বসল, আমিও খেয়াল করলাম যে স্বয়ং আমিও একা বসে থাকা সব সিটের পাশ দিয়ে এসে পেছনের সিটটিতে বসেছি, সেখানেও আমি একা। আমিও তো পারতাম কারও সাথে বসতে, পরিচিত হতে, গল্প করতে কিন্তু করলাম না, কেন যেন করলাম না। আমি কি একা থাকতে চাই, একাকী শঙ্খচিলের মত সমস্ত দুপুর, সমস্ত আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াতে চাই, উড়ে উড়ে নিজের মত করে দেখতে চাই সমস্ত পৃথিবী। ওরা হয়তো একা, ওরা হয়তো একা থাকতে চায়, ওরা হয়তো একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করে না, ওরা হয়তো ভালবাসতে পারে না, ওরা হয়তো হাত বাড়িয়ে দিতে পারে না বন্ধু বলে, ওরা হয়তো ওদের মত থাকতে চায়, ওদের মত অথবা ওরা হয়ত ধনীলোক, গরিবদের সাথে মিশে না, বা ওরা হয়তো নিজেদেরকেই শুধু ধনীলোক ভাবে, অন্য কেউ তার চেয়ে ধনী এটা ভাবতে পারে না। কিন্তু ওদের তো বউ আছে, বান্ধবী আছে, প্রেমিকা আছে, ছেলেমেয়ে আছে, ওরা তো ওদের পাশে থাকতে পারত, এক সিটে বসতে পারত। অথচ আজ কারও পাশেই বউ নেই, বান্ধবী নেই, প্রেমিকা নেই, ছেলেমেয়ে নেই। হয়তো কোনো কারণে আজ একসাথে বের হয়নি অথবা যে যার কাজে চলে গেছে আজ যে যার মত। কিন্তু ওদের বউ থাকলে বা বান্ধবী থাকলে বা প্রেমিকা থাকলে বা ছেলেমেয়ে থাকলে ওরা কি একসাথে বসত? ওরা কি একসাথে বসে একজন আরেকজনের হাত ধরে থাকত, ওরা কি পাশে বসে দু’জন দু’জনের স্বপ্নের কথা বলত, ওরা কি হঠাৎ সবার অল্েয চুমু খাওয়ার চেষ্টা করত? হয়তো করত কিন্তু আজ কেন যেন ওদের দেখে তা মনে হচ্ছে না- কেবল মনে হচ্ছে ওরা একা, একা থাকতে চায়, কেবলই একা কেন যেন মনে হচ্ছে এরকম।


 


তবে আমি কি চাই, আমিও তো বসে আছি একা, আমি কি একা, একাই তো, আমার তো কোনো বউ নেই, বান্ধবী নেই, প্রেমিকা নেই, ছেলেমেয়ে নেই, একেবারেই নির্ভেজাল একা, একটি মরা গাছের মত একা, লোকজন হয়তো দেখে ভাবে এই গাছটির কোনো পাতা নাই, এই গাছটির পাতা হয় না, ফল হয় না, এই গাছটিকে কেটে ফেলতে হবে। ভাবছি বেঁচে থাকা কত ভয়ঙ্কর, উৎপাদনের সঙ্গে না থাকলে বেঁচে থাকার কোনো মূল্য নাই। লোকজন হয়তো ভাবে এই লোকটা একেবারেই অসামাজিক, বউ নেই, প্রেমিকা নেই, বান্ধবী নেই, সারাণ একা একা ঘুরে; লোকজন হয়তো সন্দেহ করে, এড়িয়ে এড়িয়ে চলে; হয়তো কিছু বলতে চায়, এরকম কিছু যে তুমি এমন কেন, হয়তো বলতে চায় তুমি আমাদের পাশে কখনও বসবে না, কেন যেন লোকজন আমার দিকে তাকায়ও না, কেন যেন আমাকে দেখে হাসেও না, কাঁদেও না।


 


কিন্তু আমি একা কেন, আমি কি কোনো মেয়েকে বলব আমি একা, আমাকে সঙ্গ দাও; আমি কি কোনো মেয়েকে বলব, আমি কখনও ভালোবাসা পাইনি, তুমি কি ভালোবাসবে, আমি কি কোনো মেয়েকে বলব, চল আমরা বন্ধু হই। বলা তো আর হয় না, বলতে যে আর পারি না কিন্তু বললে কী হত, বললে কি মেয়েটি আমার বন্ধু হত, বললে কি মেয়েটি আমাকে ভালোবাসত, বললে কি মেয়েটি আমাকে সঙ্গ দিত। দিত হয়তো, হয়তো বা না, কিন্তু আমি একা এটা ঠিক, একেবারেই একা, খুব দূরের একটা স্টেশনের মত, ভুতুরে রহস্যময় স্টেশনের মত একা। হয়তো এই স্টেশন জানে অনেক কিছু তাই চুপচাপ থাকে, কাউকে কিছু বলে না, মানুষজনও কিছু বলতে সাহস পায় না, কেবল এতটুকুই জেনে রাখে সবাই, এই স্টেশনটি অনেক কিছু জানে।


 


আমি কি স্টেশনের মত, আমাকে দেখে কি মানুষজন মনে করে অনেক কিছু জানে তাই চুপচাপ, আমার সাথে কি মানুষজন কথা বলতে ভয় করে। করে হয়তো, হয়তো বা না।


 


কিন্তু আমি একা এটা ঠিক, আমি কখনও বান্ধবীর হাত ধরে স্বপ্ন দেখিনি, আমি কখনও প্রেমিকার ঠোঁটে ঠোঁট মেলাইনি, আমি কখনও প্রেমিকার পাশে বসে সূর্যাস্ত দেখিনি। তবে আমি একবার এক গোপন অ্যাকাউন্ট থেকে একজনকে প্রেমের কথা জানিয়েছিলাম, সেই মেয়েটি সাড়া দিয়েছিল, সে যখন সাড়া দিল তখন আমার একবার মনে হয়েছিল, আমি কেন গোপন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রেমের বার্তা পাঠালাম। একবার মনে হল ওই অ্যাকাউন্টে আমার ছবিটা দিয়ে দেব, যাতে করে সে বুঝতে পারে এটা আমি, এই যে এই আমি। পরে আবার মনে হল, না এটা গোপন অ্যাকাউন্ট, এটা সে জেনে ফেললে হয়তো আর সাড়াই দেবে না। তার থেকে এই-ই ভালো, আমি তার সঙ্গে সেই গোপন অ্যাকাউন্টে কথা বলি, আমি তার সঙ্গে সেই গোপন অ্যাকাউন্টে ভালোবাসি, আমি তার সঙ্গে সেই গোপন অ্যাকাউন্টে তার জন্য সমস্ত প্রেম নিয়ে বসে থাকি- সে সাড়া দেয়। আমি ধরে নিই সে আমাকেই সাড়া দিয়েছে, আমি ধরে নেই সে আমাকেই ভালোবাসছে, আমি ধরে নেই সে আমাকেই চায়, গোপন অ্যাকাউন্টকে নয়।


 


আমি একবার চেয়েছিলাম সেই গোপন অ্যাকাউন্টের পাতাবাহার নাম পাল্টে নিজের ঠিকানা দিতে, কিন্তু কখনও পারিনি- কখনও কি পারব না? হয়তো পারব, হয়তো পারব না; যেভাবে কেউ কেউ পারে না বলে সহজেই পৃথিবীর শাস্তিটাকে মেনে নেয়, তেমন আমিও। কিন্তু আমি যে একা এটা ঠিক, কারণ যে মেয়েটি ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছে, সে তো আমাকে সাড়া দেয়নি, সাড়া দিয়েছে আরেকজনকে- মানে সেটা হয়তো আমিই, সেখানকার ভাষা, সেখানকার আবেগ; সবই তো আমার কিন্তু আমি না, ওটা পাতাবাহারের। পাতাবাহার অন্যরকম করে কথা বলে, পাতাবাহার অন্যরকম করে গান গায়, পাতাবাহার অন্যরকম করে হাসে, সবচেয়ে বড় কথা পাতাবাহার একটি মেয়েকে বলতে পেরেছিল ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা, হতাশার কথা, স্বপ্নের কথা- আমি তা পারিনি, আমি তা পারি না। কাজেই আমি পাতাবাহার না। পাতাবাহার অন্য কেউ, পাতাবাহার একা নয়, আমি একা।


 


পাতাবাহার একবার মেয়েটিকে দেখা করার ঠিকানা দিল, সময় বেঁধে দিল, এই সময়ের মধ্যে এখানে আসবে। পাতাবাহার একবার ধারণা করেছিল মেয়েটি আসবে না, আবার এ-ও ভেবেছিল- আসতেও পারে। আসতেও তো পারে এরকম একটি সম্ভাবনা নিয়ে পাতাবাহার সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে গিয়ে রীতিমত অবাক হয়ে গেল, বিস্মিত হয়ে গেল, তার কাছে মনে হল পৃথিবীর সমস্ত সুখ এখন তার কাছে, তার কাছে মনে হল এখন সেই রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে আজ টগবগিয়ে এসেছে। এত সুন্দর একটা মেয়ে, অপূর্ব একটা মেয়ে সাদা শাড়ির উপর লালপাড়, কেমন দেবীর মত লাগছিল দূর থেকে। পাতাবাহার কি কাছে যাবে মেয়েটির, কীভাবে যাবে, আমিই তো পাতাবাহার, আমি কীভাবে তাকে পরিচয় দেব, কীভাবে বলব তুমি যে পাতাবাহারকে চেন সে আমিই। কীভাবে বলব আমিই তোমাকে ভালোবাসি, মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি- আমিই তোমাকে চাই, একসাথে বসতে, হাত ধরে স্বপ্ন দেখতে চাই। এই প্রেম, এই একটি নারীর প্রতীা, একে তো আর দুঃখ দেওয়া যাবে না, একে তো আরা কষ্ট দেওয়া যাবে না, দূর থেকে দেখেছি ঘণ্টা খানিকের মত বসে থেকে সে চলে গেছে। সে কি তখন অনেক কষ্ট পেয়েছিল, হয়তো পেয়েছিল, পাওয়ার কথা। আমি তাই সেদিন রাতেই তাকে মেসেজে জানিয়ে দেই কোনো একটা কারণে পাতাবাহার আসতে পারেনি। সে হয়তো েেপছে, প্রচণ্ড রেগে গেছে কিন্তু তারপর আবারও প্রেম, পাতাবাহারের সঙ্গে প্রেম। আমরা প্রতিদিন সময় করে কথা বলি, প্রতিদিন কে কখন কী করছি সবই একে অন্যকে জানাই। যেন একই সাথে আছি আমরা, একই সাথে কেটে যাচ্ছে আমাদের প্রেমের সংসার। আবারও একদিন পাতাবাহার মেয়েটিকে দেখা করতে বলে, অনেক অনুরোধ করে- অনেক ভাবে বোঝায় যে এবার আর আগের মত হবে না। মেয়েটি আসে, সেই সাদা শাড়ি, লালপাড়, যেন দেবী। এবার তো দেখা করতেই হবে- এবার তো বলতেই হবে যে আমিই পাতাবাহার, এবার তো বলতেই হবে যে তুমি যাকে এতদিন দূর তার যন্ত্রে ভালোবেসে এসেছ সে আমিই। আমি তার কাছে যাই, সে একবার আমার দিকে তাকায়, তারপর আবারও অন্যদিকে। এরপর একবারও আমার দিকে চোখ রাখেনি। আমি তখনই বুঝতে পারছিলাম সে যাকে পাতাবাহার নামে চিনে, সে যে পাতাবাহারকে এতদিন ধরে ভালোবেসেছে, সে যে পাতাবাহারের জন্য আজ অপো করে বসে আছে, সে আমি না। আমি তবু তার কাছে যাই, আমাকে যে আজ বলতেই হবে- আমাকে যে আজ বলতেই হবে আমিই পাতাবাহার, আমিও এতদিন ধরে তোমার জন্য বসে আছি- আমিই তোমাকে ভালোবাসি- পাতাবাহার নয়, তুমি আমাকেই ভালোবাস, পাতাবাহারকে নয়। কারণ আমিই পাতাবাহারের স্রষ্টা, আমি যা বলি পাতাবাহার তাই করে, আমি যেভাবে ভালোবাসি, বাসতে চাই, স্বপ্ন দেখি, দেখতে চাই সবই আমার, পাতাবাহারের নয়। পাশে যে লম্বা বেঞ্চে বসে আছে মেয়েটি আমি তার পাশে বসি, বসে একবার তার দিকে তাকাই। সে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন ইতস্তত বোধ করে। সে যাই করুক, যাই বলুক; আজ যদি সে আমাকে অস্বীকারও করে, আজ যদি সে আমাকে ঘৃণাও করে, তারপরও আমাকে বলতে হবে, কারণ পাতাবাহার যে বলেছে আজ আসবেই। আমি মেয়েটির আরেকটু কাছে এসে বসি, মাথা নিচু করে বলি- আপনি যে পাতাবাহারের জন্য অপো করছেন সে আমিই। সে আমার দিকে তাকায়, তার মুখে তখন হাসি ছিল, আমার সেই হাসির কাছে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল, নিজেকে বিসর্জন দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। যে মেয়ে এমন ভুবনজয়ী হাসি হাসতে পারে, সে নিশ্চয়ই আমাকে ফিরিয়ে দেবে না, আমার ভিতরে তখন রাজ্য জয়ের আনন্দ। আমরা অনেকণ কথা বললাম, হাসলাম, স্বপ্ন দেখলাম, কী এক সুখে আমি সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম- রাতে সে আমাকে মেসেজ পাঠাল আমি যে পাতাবাহারকে এতদিন ধরে চিনেছি, আজ যে পাতাবাহারের সাথে তার কথা হল, তার মধ্যে যে যোজন যোজন ফারাক। আমার আর বুঝতে দেরি হল না, এবার পাতাবাহারও একা, আমিও একা। এরপর অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি আর কখনও পাতাবাহার হতে পারিনি অথবা পাতাবাহার আমার মত না।


 


কিন্তু এখন যারা বাসে একা একা বসে আছে ওদের জীবনেও কি এরকম গোপন অ্যাকাউন্ট আছে, এরকম পাতাবাহার আছে, যে পাতাবাহার যে তারাই, তা কখনই বোঝাতে পারেনি। হয়তো আছে, হয়ত বা নেই।


 


হয়তো এই গোপন অ্যাকাউন্টগুলো এমনই যে সে কখনই মানুষের মত না, বাস্তবের মত না, কেবল স্বপ্নের মত, কল্পনার মত আর হয়তো তাই বাস্তবের কেউ তাকে মেনে নিতে পারে না। আজ এই বাসে সবাই হয়তো এই কারণে একা এক একটি সিটে বসে আছে, আমার মত নিজের সেই গোপন অ্যাকাউন্টের কথা, সেই পাতাবাহারের কথা ভাবছে।


 


 


 


 


দুপুর মিত্র বাংলাদেশে কপিলেফ্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত। বিশ্বব্যাপী কপিরাইট আইন স্বাধীন মত প্রকাশে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই প্রতিবাদ হিসেবে কপিলেফ্ট আন্দোলনের জন্ম। মূলত এই কপিলেফ্ট আন্দোলন ইউরোপে এখনো সফ্টওয়্যার কেন্দ্রিক। কিছু কিছু দেশে সংগীত শিল্পে এই কপিলেফ্ট আন্দোলনের চল রয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা জগতে কপিলেফ্ট আন্দোলন বাংলাদেশেই প্রথম। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দুপুর মিত্র প্রকাশ করছেন


http://www.copyleftwebjournal.tk নামের একটি ওয়েব জার্নাল। এই জার্নালেই প্রথম কপিলেফ্ট আন্দোলনের মেনিফেস্টো প্রচার করা হয়। এই জার্নালটি বাইলিংগুয়াল ( বাংলা ও ইংরেজি) হওয়ায় খুব দ্রুত একটি বিশেষ স্থান লাভ করেছে যেখানে বাংলাদেশ, ভারত, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং কপিলেফ্ট আন্দোলনের কারণে এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হয়েছে।


 


এছাড়া সম্প্রতি SOPA ও PIPA আইনের বিরুদ্ধে কপিলেফ্ট আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় তার অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো।


তার প্রথম কবিতার বই ৪৪ কবিতা (২০১০) বাংলাদেশের প্রথম কপিলেফ্ট কবিতার বই। “দশভুজা” গল্পের বইটিও কপিলেফ্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি বিক্রির জন্য নয়।


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 


 



 


 


 




দুপুর মিত্রের দ্বিতীয় কবিতার বই ত্রিকোণমিতি


দুপুর মিত্রের দ্বিতীয় কবিতার বই ত্রিকোণমিতি



ত্রিকোণমিতি


দুপুর মিত্র


প্রথম প্রকাশ


এপ্রিল ২০১৩


বইটি বিক্রির জন্য নয়। বইটি শুধুমাত্র ই-বুক হিসেবে প্রকাশিত হল।


কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোনও অংশ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই যে কেউ নকল ও পরিবেশন করতে পারবেন।


প্রকাশক: দুপুর মিত্র


প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু


কৃতজ্ঞতা: পরাগ রিছিল


উৎসর্গ


কপিলেফ্ট আন্দোলনকারীদের


                                                                                                  যাদের হাত ধরে শৃঙ্খলমুক্ত হচ্ছে জ্ঞান


 



পূর্বে প্রকাশিত বই


কাব্যগ্রন্থ: ৪৪ কবিতা, ২০১০


গল্পগ্রন্থ: দশভুজা, ২০১২


গল্পগ্রন্থ: চৌকাঠ, ২০১৩


সৃষ্টিপর্বের কবিতা


১.


ঝড় মানে সবসময়ই এতটা শক্তিশালী নয় যে,

যে কোনও ঝড়ে সবকিছু ওড়ে যাবে।

মানুষ মারা যাবে।

কিছু ঝড় আসে

তোমার ঠিক সমালোচনা করার মত,

তোমার হেসে হেসে কথা বলার মত,

অথবা কোনও সিনেমার মত।

ঠিক ঝড় নয়,

ঝড়ের মত কিছু একটা ঝড়।

আমি আসলে ব্যস্ত ছিলাম।

আমি আসলে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম

যে এই ঝড়ের ভেতরে আমি একটি দ্বীপের ওপর ছিলাম।

আর আমি আমার আবেগের গাছ বেয়ে উঠছিলাম।

আর সেই গাছে থাকা একটি সাপ আমাকে কামড়াতে চেয়েছিল।

এটা সত্যি,

এ রকম গাছ আছে,

আর সেই গাছে কেউ ওঠলে

সাপ তাকে কামড়াতে আসে।

আর জনমানবহীন দ্বীপও থাকে,


সেই দ্বীপে ঝড় এলেও কিছু হয় না।

মানে তোমার কথা বলার মত যে ঝড়,

তোমার সমালোচনা করার মত যে ঝড়,

সে ঝড়ে আমার কোনও ভয়-ডর করে না।

কেবল তোমার হাসি হাসি সমালোচনামুখর মুখে

তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

আর আমার আবেগের গাছ বেয়ে ওঠতে ইচ্ছে করে

যেখানে একটি সাপ কামড়াতে আসে।


২.


পদার্থবিদদের মতে

মহাবিশ্ব বড় হচ্ছে

এবং মহাবিশ্বের একটি উপাদান আরেকটি উপাদান থেকে

নির্দিষ্ট দূরত্বে ওড়ছে।

এবং সবকিছুই এক সময় ছোট হতে হতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে।

কাজেই তোমাকে যদি বলি

তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না;

তাহলে তা হবে আসলেই হাস্যকর।

কাজেই আমি তোমাকে বলছি

তোমার স্যুটকেস ও অন্যান্য জিনিসপত্রগুলো রাখ।

এটা তোমার শিকড়

আর আমরা দুজনে

মহাবিশ্বের দুইটি গাছ।

চা খাও।

আমি তোমার পছন্দের গানটা ছেড়ে দিচ্ছি,

আমার ক্রেডিট কার্ড তোমার হাতে দিচ্ছি,

আমি সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দেব,

আমি আমার ক্যান্সারের চিকিৎসা করাব,

আমি নিয়মিত মন্দিরে যাব,

বাচ্চাদের নিয়ে খেলব,

অফিস শেষে বাড়ি চলে আসব,

তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।


৩.


আমার ধারণা

আমার মৃত্যু হয়েছে

এমন কিছু কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।

কোনোভাবেই কেউ পারবে না।

এবং এটা আমার এক ধরনের মুক্তি,

বড় একটা মুক্তি।

এবং এই কারণে

আমি আমার মৃত্যুর একটা চিঠি লিখে রাখব।

আমি আমার পরিসমাপ্তির একটা কিছু লিখে রাখব।

আমি অনিশ্চয়তাকে রাখতে চাই না,

অযৌক্তিক কিছু রাখতে চাই না,

আমি আমার মৃত্যু হয়েছে

এটা লিখে রাখলে

অনিশ্চয়তা আর অযৌক্তিক বিষয়গুলো আর থাকবে না।

তবে আমার কষ্ট হচ্ছে,

কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে এরকম কিছু ঘটলে

একটা বড় ধরনের বিশ্বাসের ফাটল শুরু হবে।


৪.


আজ বৃষ্টির দিন

বৃষ্টির দিন মানে শুধু সাধারণত যে বৃষ্টি হয়ে থাকে

সেভাবে ভাবলে হবে না।

ঘরের টিনে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে আজ।

মনে হচ্ছে ঘরের টিন নয়,

বৃষ্টি দিয়েই তৈরি এই টিন।

আর তা নেচে বেড়াচ্ছে সেখানে।

ঘরের জানালা দেখলে মনে হবে

বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে রেলিংয়ের গায়।

আসলে বৃষ্টির ফোঁটা নয়,

বৃষ্টি দিয়েই গড়া এই রেলিং।

আর তাই চকমক করছে খানিক আলোয়।

অথবা গাছের দিকে তাকাও,

দেখ গাছগুলো গাছ নয়।

কেমন একবার নুয়ে পড়ছে,

আবার ওঠে দাঁড়াচ্ছে,

কেমন সাদা হয়ে উঠেছে বৃষ্টির জলে।

আসলে সাদা হয়ে ওঠেনি,

গাছগুলো বৃষ্টি দিয়ে তৈরি।

হাজার হাজার বছর ধরে

হোটেলে যে জল খাচ্ছ,

এটা আসলে জল নয়

বৃষ্টির জলই খাচ্ছ তুমি।

আর যে হোটেলের ছেলেটি তোমাকে জল এনে দিয়েছে,

তার চোখের দিকে তাকাও,

তারপর তাকাও তার পুরো শরীরে,

দেখ তার সারা শরীরে কেমন বৃষ্টি আর বৃষ্টির উল্লাস।

আসলে সে বৃষ্টির ছেলে।

হোটেল থেকে রাস্তার দিকে তাকাও

গাড়িগুলো কেমন বৃষ্টি-রঙা।

আসলে গাড়িটা বৃষ্টি-রঙা নয়,

গাড়িটা আজ বৃষ্টি-গাড়ি।

বৃষ্টির জলে কেমন মাছ উঠে এসেছে ডাঙ্গায়,

এটা আসলে মাছ নয়,

বৃষ্টিমাছ।

বৃষ্টির জলে উঠানে হেঁটে যাচ্ছে দেখ সাপ,

কেমন ভেজা শরীর আর নরম।

এটা আসলে সাপ নয়

বৃষ্টিসাপ।

সমস্ত দিন কেমন সুন্দর আর ঝকমকে হয়ে ওঠেছে দেখ,

আর তোমার শরীরের দিকেও একবার তাকিয়েছি গোপনে,

তোমার শরীর কেমন অন্যদিনের মত নয়,

আজ অনেক বেশি উজ্জ্বল আর সুন্দর।

তুমি আসলে শুধু প্রেমিকা নও,

বৃষ্টিপ্রেমিকা।

আর আমার শরীর ও ঠোঁটের দিকেও তুমি তাকাতে পার,

দেখ কেমন ভেজা ভেজা,

আর অন্যদিনের চেয়ে নরম ও উজ্জ্বল।

আমিও আসলে ঠিক আমি নই আজ,

আমিও কিন্তু বৃষ্টিপ্রেমিক।


৫.


সে হাঁটছিল।

তাকে তার পা নিয়ে যাচ্ছিল।

সে একটি নোংরা পথ দিয়ে হাঁটছিল।

তার পা ছুঁয়েছিল মাটি

আর মন ছুঁয়েছিল গভীর চিন্তা।

এত সুন্দর একটি মেয়েকে মানুষ জানালা দিয়ে হাঁটতে দেখছিল।

মেয়েটির চোখ ছিল পথের সামনে

অবশ্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।

কোনও লক্ষ্যও ছিল না মনে।

মানুষগুলো মেয়েটির সামনাসামনিই তাকিয়েছিল,

ভাবছিল মেয়েটি এভাবে কোথায় যাচ্ছে?

মেয়েটির হয়ত বিশেষ কোনও কাজ আছে।

তাই এভাবে এত দ্রুত

কোথাও কোনও দিকে না তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

মেয়েটি এতটা ব্যস্ত যে

সে হাঁটছিল।

কিন্তু মনে হচ্ছিল দৌঁড়াচ্ছে।

তার মুখ যদিও মলিন,

তার মন ছিল চাঞ্চল্যে ভরা,

চিন্তা আর অজস্র কথায় ভরপুর।


মেয়েটি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই,

মেয়েটিই জানে সে কোথায় যাচ্ছে,

মেয়েটিই জানে সে কি হতে চায়,

মেয়েটিই জানে সে কি করতে চায়,

মেয়েটিই জানে কোথায় তাকে থামতে হবে।


৬.


এমন কিছু জায়গা থাকে

যেখানে শুধুই অন্ধকার

এতটাই অন্ধকার তুমি তোমার হাতটা পর্যন্ত দেখতে পাবে না।

সেখানে কখনই সন্ধ্যা হয় না,

এই অন্ধকারে সবকিছুই শুনে শুনে বুঝতে হয়।

ধর তুমি মোম জ্বালাচ্ছ,

এই মোমটি অন্ধকারে দেখা যাবে না।

জ্বালানোর পরও

কেবল শব্দ শোনা যাবে।

শব্দে বোঝা যাবে যে তুমি মোম জ্বালিয়েছ,

তোমার শ্বাস কষ্টের শব্দ শোনা যাবে,

বোঝা যাবে তুমি খুব একটা কিছু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবছ।

এখানকার শূন্যতাকে তোমার মদের মত মনে হবে

বোঝা যাবে তুমি কখনই আমাকে চাও নি,

এখনও আমাকে চাও না।

এই অন্ধকার জায়গাটা আমি বানিয়েছি,

একদিন এখানে তোমাকে নিয়ে আসব।


৭.


পৃথিবী এতটা এগিয়ে গেলেও

এত এত যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও

দ্বীপগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ

ওরা কেমন নিঃসঙ্গ, একা।

পৃথিবী থেকে কেমন মনে হয় বিচ্ছিন্ন।

একই সূর্যের নিচে হলেও

কেমন অনিরাপদ,

সন্দেহজনক,

খারাপ,

এমন মনে হয়।

বড় কোনও ঝড় হলে,

এই দ্বীপই আক্রান্ত হয় বেশি।

এই দ্বীপ আসলে এই আমরা।

আমরা অনেক মানুষকে খেতে দেখেছি সমুদ্রের।

সমুদ্রের গর্জনে অনেক মানবতা গুড়িয়ে যেতে দেখেছি।

আবার দেখেছি

বড় বড় জাহাজ,

সেই জাহাজে করে গভীর রাতে অনেক ধনী লোককে যেতে দেখেছি।

তারা দুর্বিন দিয়ে আমাদের দেখে যেত

আর হাসত।

সমুদ্রের গর্জনে এই জাহাজ কেঁপে ওঠেনি।

কেবল প্রায়ই কেঁপে ওঠি আমরা।

কারণ সমুদ্রের গর্জন কেবল এই দ্বীপকেই

তছনছ করে যায়।


৮.


মাঝে মাঝে তোমার আঁকা ছবি

গ্যালারিতে দেখতে যাই।

গ্যালারিতে নয়,

মনে হয় আমার মনের ওপরই যেন অনবরত ছবি এঁকে গেছ তুমি।

যেন মনে হয় আমি ওড়ছি,

যেন মনে হয়

আমার চিন্তাগুলোই তুমি ছড়িয়ে দিচ্ছ তোমার রং তুলিতে।

এর ঘ্রাণ মনে হয় আমার ভাবনারই ঘ্রাণ।

আমি ওড়ছি

আর পাখনা দুইটি তোমার।

তোমার পাখনায় ভর করে মুক্ত হচ্ছি আমি,

বাতাসে নাচছি,

গান গাচ্ছি,

তুমি তোমার এক একটি রং তুলির রেখায়

আমাকে নিয়ে যাচ্ছ,

আমাকে ছড়িয়ে দিচ্ছ।

তোমার যা কল্পনা

আমার কাছে তা সত্যি ঘটছে।

আমি জানি না

আমি কেন মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলি

মাঝে মাঝে আমি কেন কাউকে না জানিয়ে চলে যাই দূরে।

এখন থেকে তোমার কাছে আসব।

তোমার রং তুলির রেখায় ওড়ে বেড়াব আমি।

মুক্ত হয়ে ওড়ব বাতাসে,

গান গাব।

আর কখনই কাউকে না জানিয়ে দূরে কোথাও যাব না,

একা একা হাঁটতে হাঁটতে কোথাও কেঁদে ফেলব না।


৯.


ব্যর্থতার ভেতরেও সৌন্দর্য থাকে,

ব্যথায় কুকড়ে যাওয়া জীবনও সুন্দর।

এই জীবনে আমাকে হয়ত কষ্ট করতে হয় অনেক,

কষ্ট করতে করতে শিখতে হয় বেঁচে থাকা।

সংগ্রাম করতে করতে জানতে হয় কাকে বলে ভাল করে বাঁচা।

মাঝে মাঝেই আমি ভেঙে পড়েছি,

মাথা নিচু করে সারা শহর হেঁটেছি,

কিন্তু জীবনই দেখিয়েছে

কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়।

আমি জানি আমি আমার চাওয়াগুলো হারিয়ে ফেলেছি,

আমার আশা থাকতে পারে

এমন কিছু ভাবতে দেয় নি কেউ।

কেবল এই একটু পরে কি করে বাঁচব

এই নিয়ে থেকেছি ব্যস্ত।


তবু আমিই সবচেয়ে ভালবাসা দেখেছি,

শুনেছি কত ভালবাসা নিয়ে বসে আছে প্রকৃতি।

দেখেছি পৃথিবী কিভাবে ভরে ওঠে লাল রঙে।

প্রকৃতিকে আমিই ভাল করে দেখেছি।

দেখেছি সূর্য কিভাবে ফুল ফুটিয়ে তোলে,

আর সমুদ্র কিভাবে একা একা হেলে দুলে নেচে ওঠে।

আমিই দেখেছি আকাশের সবগুলো রঙ

যা দেখে আমি ভুলে গিয়েছি

একজন ভাল প্রেমিকার কি প্রয়োজন।


১০.


আকাশ এতটা কালো

আর বাতাসও আসছে ঘনিয়ে।

খুব দ্রুত বেশ বড় একটা বৃষ্টি হবে।

অনেকক্ষণ ধরে হবে এই বৃষ্টি।

ঘরের বাইরের সব কিছু এবং আমরা সবাই মিলে চলে এলাম নিরাপদ আশ্রয়ে।

আমার পুকুর,

প্রিয়তম পুকুর,

আর পুকুরের মাছ,

কেমন লাফিয়ে উঠেছে আনন্দে।

বৃষ্টির ফোঁটার মত নেচে উঠছে মাছ।

এই আনন্দ আর সুখ নিয়ে আমরা চলে এলাম ঘরে।

রাতভর বৃষ্টি হল।

বৃষ্টির জলে ভরে ওঠল আমাদের পুকুর।

আমাদের পুকুরের জল উপচে আরও দূরে চলে গেল,

টইটুম্বুর এই পুকুর থেকে চলে গেল আমার প্রিয়তম সকল মাছ।


১১.


কোনও মানুষকে যদি কেউ পছন্দ না করে,

সেই মানুষটি যদি ভীষণ একা হয়ে যান

তাহলে তার মায়ের কথা মনে পড়ে।


কোনও মানুষকে যদি কেউ ফোন না করে

বা কেউ চিঠি না লেখে

তাহলে তার পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে।


এরপর তারা নিরবতার চাদরে ঢাকা পড়ে

এবং শেষপর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের খুঁজে পায়।


১২.


আমরা পরিবর্তিত হতে ভয় পাই।

কারণ হয়ত

আমরা ছোটবেলায় যে পাহাড়টিকে যেখানে দেখেছি,

সে পাহাড়টি এখনও সেখানেই আছে।

অথবা আমরা দেখেছি

সবুজ পাতাগুলো যখন হলুদ হয়ে ওঠে,

এবং হলুদ হতে হতে তা যখন শুকিয়ে যায়,

তখনই সে পড়ে যায়।

বন্যায় আমাদের বাগানে জল ঢুকে পড়েছিল,

থেকেছিল অনেকদিন।

জল চলে যাবার পর,

আমাদের বাগানের সবগুলো গাছ কেমন মলিন হয়ে ওঠেছিল।

তারপর ধীরে ধীরে তারা ঢুলে পড়েছিল মৃত্যুর কাছে।

আমরা পরিবর্তিত হতে চাই না।

এইসব আতঙ্কে আমরা প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়ি।

এভাবে একইভাবে আমরা প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়তে চাই।

অথবা ছোটবেলায় যেভাবে মার কাছে গল্প শুনে শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম,

সেভাবে এখনও ঘুমিয়ে পড়তে চাই।

পরিবর্তন কতকিছু যেন ছিনিয়ে নিয়ে যায়,

আর হু হু করে হাসে।

পরিবর্তন প্রতিদিন আমাদের ভেতরে আতঙ্ক তৈরি করে,

আর আমরা ভয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।


১৩.


ফুলকে বললাম,

ও ফুল

কেন বেঁচ আছ তুমি?

ফুল বলল,

আমি সুন্দর

এই কারণেই বেঁচে আছি আমি।


নদীকে বললাম,

ও নদী

কেন বেঁচ আছ তুমি?

নদী বলল,

আমি বহমান

বহে বেড়াবার জন্যই বেঁচে আছি আমি।


আকাশকে বললাম,

ও আকাশ

কেন বেঁচে আছ তুমি?

আকাশ বলল,

আমি বিস্তার

এই কারণেই বেঁচে আছি আমি।


বাতাসকে বললাম,

ও বাতাস

কেন বেঁচে আছ তুমি?

বাতাস বলল,

আমি উড়ে বেড়াই

এই জন্যই বেঁচে আছি আমি।


পাখিকে বললাম,

ও পাখি

কেন বেঁচে আছ তুমি?

পাখি বলল,

আমি গান গাই

এই কারণেই বেঁচে আছি আমি।


মানুষকে বললাম,

ও মানুষ

কেন বেঁচে আছ তুমি?

মানুষ বলল,

আমি বেঁচে থাকতে চাই না,

একঘেয়েমি জীবন আমার ভাল লাগে না।


১৪.


যখন প্রচণ্ড রোদ,

তুমি ঘরে থেকে বের হও ছাতা নিয়ে

রোদ তোমার গা ছুঁতে পারে না।


যখন প্রচণ্ড বৃষ্টি,

তুমি ঘর থেকে বের হও ছাতা নিয়ে

বৃষ্টি তোমার গা ছুঁতে পারে না।


যখন প্রচণ্ড কান্না পায় তোমার

তখনও তুমি ছাতা খোঁজ।

কিন্তু কান্না আটকানোর ছাতা নেই তোমার।


১৫.


আমাদের শেকড় প্রয়োজন। আমরা যেখানে জন্মেছি, যেখানে ভাষা শিখেছি, সেই শেকড়। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যেখানে ছিলেন, আমার মা যেখানে, আমার বাবা যেখানে থাকেন, সেই জায়গার প্রতি আমাদের অবশ্যই বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।


আমাদের ডানাও প্রয়োজন। ডানা আমাদের স্বপ্নকে প্রসারিত করে। আমাদের ভালবাসার জগতে নিয়ে যায়। ভালবাসার জগৎ তৈরি করতে সহায়তা করে। ডানা ছাড়া মানুষের সভ্যতা এত দূর এগুত না।


এই শেকড় ও ডানা এক সাথে কখনই কোনও মানুষের থাকে না। থাকা সম্ভব না। যাদের থাকে তারা মহাপুরুষ।


১৬.


একদিন একটি গরু কোথাও পথ খুঁজে না পেয়ে বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। গরুটি সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, কিছু গাছের পাতা-লতা খেয়ে খেয়ে তার নিজের ঘরে চলে এল।


সেই পথ দিয়েই একদিন একটি কুকুর আসল।


আরেকদিন মানুষ এই পথ দিয়ে খড়-কুটো নিয়ে যাওয়া শুরু করল।


কয়েকদিন পর থেকে শ্রমিকেরাও এই পথে হাঁটতে শুরু করল। এটি হয়ে ওঠল একটি সরু পথ।


অনেক অনেক দিন পর এই বন শহরে পরিণত হল। আর এই পথটি হয়ে ওঠল প্রধান সড়ক।


১৭.


আমি টানা সাতদিন পাহাড়ে কাটালাম।

এই সময়টাকে বলা হয় পাহাড়ি সময়।

তাহলে সময় কি?

আমি যখন যেভাবে থাকি,

কাজ করি,

ভাবি,

তা দিয়েই তৈরি হয় সময়?

যখন প্রায়ই বৃষ্টি হয়,

তখন তাকে বলা হয়

বৃষ্টির সময়।


যখন ঝড় হয়,

তখন বলা হয়

ঝড়ের সময়।


যখন ছোটবেলায়

বিকাল হতেই খেলতে চলে যেতাম,

এই সময়টাকে বলা হত খেলার সময়।


যখন প্রচুর ফল উঠে বাজারে,

সেই সময়কে বলা হয়

ফল-ফলান্তির সময়।


যখন তোমার হাত ধরে হাঁটছি

তখন তোমার এই হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময়টাকে বলা যায়

হেঁটে বেড়ানোর সময়।


একবার আমি দীর্ঘ এক মাস

ঘরের ভেতর ব্যাঙের মত শীতনিদ্রায় ছিলাম

এই সময়টা নিশ্চয়ই আমার সময়।


১৮.


বৃদ্ধাটি ঘর থেকে বের হয় না,

বৃদ্ধা সারারাত ঘরে বসে কাঁশে,

বৃদ্ধা ডাক্তারের কাছে যান না,

বৃদ্ধা গাছ, লতা-পাতার ওষুধ খান।

বৃদ্ধার কাছে কেউ জান না।

বৃদ্ধা একা একা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েন।

বৃদ্ধার সাথে কেউ কথা বলেন না,

বৃদ্ধা সারাক্ষণ নিজে নিজে কথা বলে ঘুমিয়ে পড়েন।

বৃদ্ধা দিনের বেলা ঘর থেকে বের হন না।

কেননা বৃদ্ধা মনে করেন,

দিনের বেলায় ঘর থেকে বের হলে

তাকে তার শরীরের ছায়া দেখতে হবে।

আর সেই ছায়ারূপী শয়তান

তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বলবে।


১৯.


আমরা যখন ইতিহাস পড়ি

বা আমরা যখন ইতিহাস লিখি

তখন আমরা কেবল মানুষের ইতিহাস পড়ি।

পড়ি কে ছিল রাজা,

তার কতজন রানী ছিল।

পড়ি কে ছিল জমিদার

সে কি কি করত।


লিখি আমাদেরকে সরকার কিভাবে দমিয়ে রাখে,

আর আমরা কিভাবে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে চাই।


কিন্তু আমরা কেউ পড়ি না

বা আমরা কেউ লিখি না

সেইসব মানুষের সাথে

এইসব মানুষের সাথে

প্রকৃতি কিভাবে ছিল?


তখন কি বৃষ্টি ছিল

না ঝড়?

আমাদের এই সব পড়া হয় না

কারণ এই সব লেখা হয় না।


আমাদের এইসব লেখা হয় না,

কারণ মানুষের ইতিহাসের সাথে প্রকৃতির ইতিহাস কিভাবে জড়িত

তা আমরা বুঝতে পারি না।

এইভাবে কেবল মানুষের ইতিহাস লেখা হয়

আড়ালে পড়ে থাকে প্রকৃতির ইতিহাস।


২০.


আমরা দিনে কতবার যে সিগারেট খাই,

কতবার সিগারেট খেয়ে ধোয়া ওড়াই

আর ভাবি,

আমার কথা

তোমার কথা

আমাদের ছেলে-মেয়েদের কথা।

কখনও কখনও সিগারেট খেতে খেতে তোমাকে ফোন করি।

খোঁজ খবর নেই তোমার

খেয়েছ কিনা

এখন কি করছ।


প্রতি মাসে

প্রতি বছরে

এইভাবে কতবার যে সিগারেট খাই

কিন্তু ঠিক কোন সিগারেট আমি সুখ ভরে টেনেছি,

কিন্তু ঠিক কোন সময়ের সিগারেট আমাকে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দিয়েছে

এই কথা ভাবছি আজ।


মনে হচ্ছে

হয়ত বা এই মনে হওয়াই ঠিক,

আমি যখন কিছু একটা লিখি

মানে কবিতা বা গল্প

বা উপন্যাস বা কোনোও একটা প্লট;

আমার ধারনা

আমি এইসব লেখার সময় যেসব সিগারেট খাই,

সেই সিগারেটগুলোই আমি সুখ ভরে টেনেছি।

সেই সিগারেটগুলোই আমাকে সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত করেছে।


হয়ত কারণ এই

আমি কোনোকিছু লেখার সময়ে যখন সিগারেট পোড়াই

তখন শুধু সিগারেট নয়

নিজেকেও পোড়াই।


কেননা আমার খেয়াল আছে

সেই সময়ে সিগারেট আমি বেশ জোরে জোরে টানি,

সেই সময়ে আমি অনেক বেশি বেশি সিগারেট খাই।


২১.


বাঁশের সাঁকো দিয়ে আমি একদম চলতে পারি না।

বাঁশের সাঁকো দিয়ে কোথাও পার হতে গেলেই

আমার শরীর কাঁপতে থাকে।

এমনভাবে শরীর কাঁপতে থাকে

যেন মনে হয় এখনই পড়ে যাব আমি।

এখনই পড়ে যাব আমি

পড়ে যাব সময়ের পঁচা-ডোবা নালায়।


শুধু বাঁশের সাঁকোতে নয়,

বড় কোনও সেতুর সামনে গেলেও

আমার পা কাঁপতে থাকে।

মনে হয় এই সেতুর ওপরে ওঠলেই,

মনে হয় এই সেতুর মাঝামাঝিতে পৌঁছলেই,

এটি ভেঙে পড়বে।

আর আমি পড়ে যাব

সভ্যতার নষ্ট সময়ের গর্তে।

সেখানে আমি মরে পড়ে থাকব।


কত লোক এই সাঁকো দিয়ে যায়

কত বড় বড় ট্রাক-গাড়ি

এই সাঁকোর ওপর দিয়ে যায়।

এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

ও প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত।


শুধু আমারই মনে হয়

এই বুঝি ভেঙে গেল সাঁকো

এই বুঝি পড়ে গেলাম আমি।


কেন যে মনে হয় এমন আমার

কেন যে ভয় হয় এমন আমার।

আমাদের সেতুটি ভেঙে পড়েছিল বলেই কি

আমাদের সাঁকোটি আর গড়া হয় নি বলেই কি

আমি আর তুমি দীর্ঘকাল আলাদা হয়ে আছি বলেই কি

ভয়ে আমার হাত কাঁপে,

কাঁপে পা।

আর মনে হয়

এই বুঝি গেলাম পড়ে

আমাদের দীর্ঘ হতাশার পঁচা-নর্দমায়

আমাদের দীর্ঘ বিচ্ছেদের প্রেম আর মায়ায়।


২২.


যা কিছু শিকার করে

তাই রাঙা হয়ে ওঠে

যেমন মাছরাঙা।

কেমন সুন্দর অদ্ভুত একটা ভালবাসার চেহারা নিয়ে

সারাদিন বসে থাকে নদীঘাটে।

সুযোগ পেলেই নদীতে ডুব দিয়ে ধরে নেয় মাছ।

তারপর উড়াল,

একা একা বসে বসে খায়,

খাওয়া শেষ হলে আবারও সে এসে বসে নদীরঘাটে।


তোমার নামও রাঙা

তুমিও মাছরাঙার মত সুন্দর

তুমি কি শিকার করবে আমাকে?


২৩.


তোমার পাশে যে চাঁদ বসে আছে

তুমি কি ভাবছ

এটা সেই একই চাঁদ।


ছোটবেলায় যে চাঁদ ছিল তোমার পাশে

সে চাঁদকে তুমি বলতে চাঁদমামা।

তুমি যখন সেই চাঁদমামার কথা ভাবতে

তোমার মামা চলে আসত তখন তোমাদের বাসায়।


এখন যখন তুমি তরুণ

পাশে বসা থাকা সেই চাঁদটিই

এখন তোমার প্রেমিকার মত দেখাচ্ছে

যেন চন্দ্রমুখী হাত ধরে বসে আছে তোমার।


যখন তোমার অনেক বয়স হবে

তখন এই চাঁদকেই মনে হবে তোমার বুড়ি।


২৪.


এই যে অজস্র পাথর

থরে থরে সাজানো এক একটি পাথর

ছোট

বড়

মাঝারি

রকমের পাথর

কতদিন ধরে

কত অজস্র বছর ধরে

পৃথিবীর পিঠের ওপর

শুয়ে আছে

বসে আছে

ঘুমিয়ে আছে

অথচ কোনও সাড়া নেই

অথচ কোনও শব্দ নেই।


এক একটি পাথর

নিজের মত করে

একা একা

পৃথিবীর ওপর

এত এত সময়

এত এত বছর

সাড়া-শব্দহীনভাবে

কিভাবে কাটায় সে?


এই জন্যেই কি সে পাথর?

এই জন্যেই কি মানুষও শোকে পাথর হয়ে যায়?


২৫.


কিছু কিছু ঘাস থাকে অনেক সবুজ আর সুন্দর।

সেখানে নীল নীল ছোট ছোট ফুল ফোটে,

ফুলগুলো এত ছোট

অথবা ছোট বলেই অনেক সুন্দর,

আর ছোট বলেই

কেমন মায়া মায়া মুখ।


কিছু কিছু ঘাস

শুষ্ক মরা রং নিয়ে বেঁচে থাকে।

এই ঘাসগুলো চোখেই পড়ে না আমাদের।


আর কিছু ঘাস ইট বা পাথরের চাপায় হলুদ হয়ে যায়,

এই বুঝি মরে গেল তারা।


আর কিছু ঘাস আমরা কেউ কেউ মাড়িয়ে যাই

পেছনে তাকালে বোঝা যায়,

মারিয়ে যাওয়া ঘাসগুলো কত কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।


২৬.


আমি জানি

তোমার মুখ তুমি অনেকবার করে ধোও

সাবান দিয়ে পরিষ্কার কর,

ফেসিয়াল লাগাও।

যেন তোমার এই মুখ দেখে

লোকজন হেসে ওঠে,

ভাললাগে মানুষের।

মানুষ তোমার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে

কথা বলতে চায়;

এটা তোমার ভাললাগে।

তাই তুমি তোমার মুখ

অনেক পরিষ্কার করে রাখ।


কিন্তু তোমার যখন খুব খারাপ লাগে,

যখন তোমার ব্যর্থতার কথাগুলো মনে পড়ে,

তখন তোমার মুখ কালো হয়ে যায়।


তুমি কি তোমার এই কালো মুখ সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে পার?


২৭.


আমি যখন বড়শি ফেলে মাছ ধরি

আমার ছেলে আমার পাশে বসে থাকে।

ছেলের চোখ তখন কেমন জ্বল জ্বল করে ওঠে,

এই বুঝি ধরা পড়বে একটি মাছ।

আর সেই মাছ লাফিয়ে উঠবে।

সেই মাছের সাথে সাথে লাফিয়ে ওঠবে আমার ছেলেও।


আমি যখন পুকুরে মাছ ধরি,

বড়শিতে মাছ যখন লাফাতে থাকে,

তখন মাছটির বাচ্চারা

জলের নিচ থেকে দেখে

তাদের মা হারানোর দৃশ্য।


২৮.


আমি প্রতিবার যখন নিজের বাড়ি থেকে নগরের দিকে আসি,

বাসে চড়ে

বাসে ওঠার পর

বাস যখন চলা শুরু করে

তখন একটি গাছ পেছনে ফেলে চলে বাস

একটি গাছের ডাল পেছনে ফেলে চলে বাস

একটি গ্রাম পেছনে ফেলে চলে বাস

একটি শহর পেছনে ফেলে চলে বাস।


এইভাবে পেছনে ফেলে ফেলে বাসটি যখন নগরে চলে আসে

তখন আমার মা-বাবার কথা মনে পড়ে।

আমার পুরো শরীর কান্নায় ভেঙে পড়ে

মনে পড়ে বাসটি আমার মা-বাবাকেও পেছনে ফেলে এসেছে।


তখন আবার আমি বাসে চড়ে নিজের বাড়িতে চলে আসি।


২৯.


যখন বড় বড় ঢেউ নিয়ে সমুদ্র তোমাকে ডাকছে,

যখন সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছ সমুদ্র কত বিশাল,

যখন তুমি তোমার প্রেমিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছ,

আর ভাবছ দু’জনে মিলে আজ যদি ডুবে যাওয়া যেত সমুদ্রে,

যখন এক পা দু’ পা করে তুমি সমুদ্রের কাছা কাছি যাচ্ছ,

আর ছুঁয়ে দেখছ,

বিশাল এই সমুদ্রটি আসলেই কেমন;

তখন

প্রকাণ্ড সূর্যটাও ডুবে যাচ্ছিল সমুদ্রে।


৩০.


সেদিন আমার বন্ধু বলল-

আমাকে অমুক জায়গায় সে দেখেছে

অথচ সেদিন আমি যাই নি সেখানে।

তারপর সে বলল,

তাহলে হয়ত তোমার মত জামা পড়া কাউকে দেখেছি।


রাতে বাসায় এসে জামাগুলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম-

আমার জামা ক্রমশঃ আমি হয়ে ওঠছে।


তারপর আমি আমার সমস্ত জামা আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম।

আর এরপর থেকে প্রতিদিন একটি করে নতুন জামা পড়া শুরু করলাম;

এবং পুরুনো জামাগুলো পুড়িয়ে ফেললাম।


যাতে কেউ আমার জামা পড়ে আমাকে চুরি করে নিয়ে না যায়।


৩১.


শহরের গাছগুলো বড় হয় না

বা বড় হতে দেওয়া হয় না

ডাল ছেটে ফেলা হয়।

কখনও বেশি বড় মনে হলে কেটে ফেলা হয়।

শহরে বড় গাছ থাকে না

রাস্তার দুই পাশ সাজিয়ে রাখার জন্য গাছ লাগানো হয়।

এই গাছগুলো খুব বেশি বড় হয় না।

বাসা-বাড়িতে টবে গাছ লাগানো হয়,

এইগাছগুলোও ছোট ছোট গাছ।

শুধুমাত্র কিছু পার্কে বড় বড় গাছ থাকে।

সেখানে গাছের ছায়ার নিচে মানুষ বসতে পারে।


শহরে তাই বড় গাছ নেই বলে

গাছের নিচে তেমন ছায়াও থাকে না।


তাই শহরের মানুষের কাছে গাছ মায়ের মতন নয়।


৩২.


বাগানে হরেক রকম ফুল।

নানা রঙের

নানা আকৃতির

অসংখ্য ফুল।

বাতাসে হেলেদুলে হাসে,

প্রজাপতিরা এই ফুল থেকে অন্য ফুলে,

এই পাতা থেকে অন্য পাতায়,

এই শাখা থেকে অন্য শাখায় ওড়ে ওড়ে বেড়ায়।

তারাও নানা রঙের

নানা আকৃতির।

মাঝে মাঝে মনে হয়

ফুলগুলোই প্রজাপতি হয়ে ওড়ে বেড়ায়

উড়তে উড়তে যখন ওরা আমার হাতে বসে,

উড়তে উড়তে একটি প্রজাপতি যখন আমার হাতে স্থির হয়ে বসে থাকে,

তখন নিজেকে আমার ফুল মনে হয়।


৩৩.


বাগানি যখন চলে যায়

তখন একটি পাতা আরেকটি পাতার সাথে কানাকানি শুরু করে।

একটি ফুল আরেকটি ফুলের সাথে কানাকানি শুরু করে।

শো শো শব্দ শুরু হয়ে যায় চারপাশে।

একটি গাছ হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় অন্য প্রান্তে,

একটি পাতা হাসতে হাসতে চলে যায় গাছের সাথে,

একটি ফুল দুলতে দুলতে চলে যায় গাছের সাথে।


বাগানি যখন চলে যায়

তখন গাছগুলো সারা বাগান জুড়ে হাঁটে, দৌঁড়ায়।


কেবল গাছগুলো দৌঁড়িয়ে বাগানের বাইরে যেতে পারে না।


৩৪.


রাস্তার ধারে যেমন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে,

বিদ্যুতের খুঁটিও দাঁড়িয়ে থাকে তেমন।

এক একটি বিদ্যুতের খুঁটি দিয়ে চলে যায় বিদ্যুতের তার,

সেই তার দিয়ে আমাদের ঘরে চলে আসে বিদ্যুৎ।


সেই বিদ্যুতে আমাদের ঘর আলোকিত হয়

লাল-নীল-সবুজ

কত রঙের আলো জ্বলে ওঠে আমাদের ঘরে।


রাতে আমাদের ঘর আলোকিত করে রাখে বিদ্যুতের তার।


সেই তারে মরে মরে ঝুলে থাকে শত শত বাদুর।


স্থিতি পর্বের কবিতা


০১. মাঝে মাঝে ছায়াকে দেখে নেয় শরীর। দেখে শরীরটা যখন হেলান দেয়, তখন ছায়াও হেলান দেয়। ছায়াটা যখন দুলে ওঠে, শরীরটাও দুলে ওঠে। ছায়াটা যখন ভালবাসে, শরীরটাও ভালবাসে। তারপর ছায়া ও শরীর একসাথে ঘুমুতে যায় বিছানায়।


০২. একদিন বৃষ্টির সাথে দেখা হল গরমের। অঝোর ধারায় পড়তে থাকল বৃষ্টি। তবু গরম গেল না সরে। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, আর গরমও যাচ্ছে না কিছুতেই। আমি ছাদের ওপরে বৃষ্টি গায়ে মেখে ঘামছিলাম।


০৩. একদিন জ্যোৎস্নার সাথে পাল্লা দিয়ে শহরে জ্বলে ওঠল হাজার হাজার বাতি। লাল-নীল-সবুজ হাজার রঙের বাতি। শহরের মানুষেরা রাতে এই আনন্দে নেমে এল ঘরের বাইরে। বাজি ফুটাল। হৈ-হুল্লুর আর উল্লাস করতে লাগল। তারপর অনেকদিন এই শহরে জ্যোৎস্না আসেনি।


০৪. ট্রেন যখন আসতে থাকে, তখন সাইরেন বাজে। স্টেশন মাস্টার বাঁশি ফু দেয়। সবাইকে রেললাইন থেকে সরিয়ে দেয়, যেন কেউ ট্রেনে কাটা না পড়ে। পতাকা ওড়িয়ে ট্রেনকে জানিয়ে দেয়, এই পথ এখন তার। একদিন লোকজন অভিজ্ঞ, বুড়ো এই স্টেশন মাস্টারেরই থ্যাঁতলানো লাশ দেখতে পায় রেললাইনে।


০৫. আমি মাঝে-মধ্যে দৌঁড়াই। যেন পথে কারও সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করতে না হয়। যেন পথে কোনও খাবার দেখলে, খাওয়ার জন্য বসে না পড়ি, যেন পথে তোমাকে দেখলে আমার ভালবাসার কথা মনে না পড়ে। আমি মাঝে-মধ্যেই দৌঁড়াই। দুই হাত উর্ধ্বে প্রসারিত করে আমি দৌঁড়াতে থাকি। মনে হয় আমি ওড়ছি। আর ঘরে রেখে যাচ্ছি আমাকে।


০৬. যখন বন্যা হয়, তখন মাঠ-ঘাট, ঘর-বাড়ি সব ডুবে যায়। মানুষ মাচা বানিয়ে থাকে। যেন সেখানে জল না ঢুকে। মানুষ তখন নৌকা করে এ ঘর থেকে যায় ও ঘরে। যখন বন্যা হয়, তখন চারপাশে শুধু দেখা যায় জল আর জলরাশি। যখন বন্যা হয়, কোথাকার জল যে কোথায় যায়; কেউ জানে না।


০৭. দিন আর রাতের ঝগড়া কিছুতেই থামে না। যখন দিন আর রাত ঝগড়া থামিয়ে দুই জনের দুই মুখ দুই দিক করে রাখে, তখন গোধূলি আসে। গোধূলি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে, তোমরা সারাক্ষণ ঝগড়া কর কেন, অন্তত আমার জন্য হলেও তোমরা একটু চুপচাপ থাক। তবু তারা কথা শুনে না, কিছুতেই শুনে না। দিন চলে যায় বাপের বাড়ি। আর রাত চলে যায় অন্ধকারে।


০৮. একদিন কলিং বেলের শব্দে তোমার মা আসল, আমি কিছু একটা বলে চলে এসেছিলাম। একদিন কলিং বেলের শব্দে তোমার বাবা আসল, আমি কিছু একটা বলে কোনো রকমে চলে এসেছিলাম। একদিন কলিং বেলের শব্দে তুমি আসলে, আমি তোমাকে কিছুই বলিনি।


০৯. একদিন বিকাল বেলায় আমরা বেড়িয়ে পড়েছিলাম রাস্তায়। তুমি মেঘ ভেবে ঘরে চলে গিয়েছিলে। ভেবেছিলে এক্ষুনি হয়ত নামবে বৃষ্টি। তুমি হয়ত জানতে না, আকাশে মেঘ থাকলেই সব সময় বৃষ্টি হয় না।


১০. যেদিন লোকটা জুতা ভাল করে পায়ে দিয়ে বের হয় না, সেদিন লোকটার সারাদিন যায় অস্বস্তিতে। কারও সাথে ভাল ব্যবহার করে না, কারও সাথে কথা বলতে বিরক্তি লাগে তার। ঠিকমত হাঁটতে পারে না, বাসায় ফিরতে পারে না। যেদিন লোকটা ভাল করে জুতা পড়ে বের হয়, সেদিন তার সবকিছুই ভাল ভাবে হয়। তার ভেতরে ভাললাগা কাজ করে। তাই প্রতিদিন লোকটা ভাল করে জুতার যত্ন নেয়, আর বের হবার সময় জুতা ভাল করে পায়ে দিয়ে বের হয়।


১১. যখন পাল তুলে দেয় নৌকা, তখন বাতাস পাল ধরে চলে যেতে চায় দূরে। অনেক দূরে, অন্য কোনও নদীর কাছে। আর মাঝি বসে বসে এইসব খেলা দেখে, যেন কতদিনের বন্ধু, কত চেনা-জানা তার এই বাতাসের সাথে। মাঝির হাসির সাথে বাতাসের হাসি ওড়ে বেড়ায় সমস্ত নদীতে। একদিন এই বাতাস নৌকার পাল ছিঁড়ে মাঝিকে নিয়ে চলে যায় দূরে।


১২. এপার থেকে তুমি গাইছ রবীন্দ্রসঙ্গীত, ওপার থেকে আমি গাইছি রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওপারের ফোনে বাজছে এপার, এপারের ফোনে বাজছে ওপার। আমাদের প্রেম দেখ ওড়ছে হাওয়ায়।


১৩. মেয়েটি সুন্দর করে চিঠি লিখত। গুটি গুটি অক্ষরে চিঠি লিখত মেয়েটি। মেয়েটি প্রতিদিন একটি করে চিঠি পোস্ট করত। মেয়েটি জানত না, এইভাবে চিঠির সাথে নিজেকেও সে অল্প অল্প করে পাঠিয়ে দিত খামে ভরে। হঠাৎ একদিন মেয়েটি বাড়ি থেকে হারিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন মেয়েটি খামের সাথে চলে গেল কোথাও।


১৪. আইল তাকে নিয়ে চলে ধানের ক্ষেতে। এ ক্ষেত থেকে ও ক্ষেত, ও ক্ষেত থেকে এ ক্ষেত আইল তাকে ঘুরিয়ে বেড়ায়। ধান ক্ষেতের সবুজ বাতাস দেখায়, ধানের নাচন দেখায়। দেখায় কিভাবে একটি ধান ভালবাসে আরেকটি ধানের গাছকে। আইল তাকে ধানক্ষেতের স্বপ্ন দেখায়। ধান ক্ষেত থেকে সে আর বের হয়ে আসতে পারে না।


১৫. অনর্গল কথা বলে মেয়েটি। মার্কস-লেলিন-মাও সেতুং নিয়ে। রাশিয়া-চীন-লাতিন আমেরিকা নিয়ে। বলশেভিক বিপ্লব, মাওবাদী বিপ্লব আর হতাশা নিয়ে। প্রেম-দ্রোহ-ঘৃণা নিয়ে। আর যখন তার কথা শেষ হয়ে যায়, তখন সে একা হয়ে যায়।


১৬. রাতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেই সে নিজেকে খুঁজে পায়। আর তখনই সে বউ পেটায়,  না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরায়। একা একা কান্না কাটি করে। এ কারণে সে দরজা খোলা রেখে ঘুমায়।


১৭. আজকাল কেউ অপেক্ষা করে না। সবারই কত তাড়া। সময়মত এসে কথা বলে চলে যায়। অথবা ফোন করে নেয় আগে থেকে। যেন তাকে অপেক্ষা করতে না হয়। আমারও আসতে একটু দেরি হলেই তুমি কেমন যেন করে ওঠ। বারবার ফোন করো। দেখা হবার পর কত বার যে ধমকাও। আমার এসব ভাল লাগে না। তাই তুমি যে সময়ে আসবে তার এক ঘণ্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার জন্য অপেক্ষা করি। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে আমার ভাল লাগে।


১৮. বৃষ্টিতে কত কিছু ধুয়ে যায়। গাছের পাতার ময়লা সাফ হয়ে কেমন চকচক করতে থাকে। পিচঢালা পথগুলো মনে হয় নতুন করে বানানো। ঘরগুলো পরিপাটি হয়ে রয়। ওঠান পরিষ্কার আর ধবধব হতে থাকে। বৃষ্টিতে ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখছি, আমারও শরীর কেমন ফর্সা হয়ে ওঠেছে। কেবল বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল না তোমাকে বিদায় জানাবার দৃশ্য।


১৯. রোদ এসেই কত ফুল ফোটায়। কত শত ফুল। সকাল বেলায় কেমন হেসে হেসে হেলে দুলে ফোটে ওঠে ফুল। দুপুরে রোদের তাপে কেমন শরীর ছেড়ে দেয় তারা। বোঝা যায় খুব ক্লান্ত হয়ে ওঠেছে তারা। মনে হয় এই বুঝি শেষ। তবু কোনও অভিযোগ নেই তাদের। বিকালে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে ঝড়ে যায় ওরা। তবু কোনও অভিযোগ নেই তাদের।


২০. মোমবাতি যখন পোড়ে তখন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোড়ে। একটুও নড়ে না। একা একা দাঁড়িয়ে পুড়তেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে পুড়ে নিঃশ্বেস হয়ে যায়। মোমবাতি এইভাবে স্থির দাঁড়িয়ে পোড়ে; দেখিয়ে যায়, তার বেঁচে থাকা কতখানি সততা আর দৃঢ় সংকল্পের।


২১. হলুদ পাতা জমে জমে স্তুপ হতে হতে, গাছের ডালপালা শুকিয়ে যেতে যেতে, আবর্জনার পাহাড় হতে হতে একদিন বনের চেহারা পাল্টে যায়। একদিন একটি ডালের সাথে আরেকটি ডাল ঘষে ঘষে  নিজেরাই জ্বলে যায় আগুনে। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় মাইলের পর মাইল বন। কারণ বন জানে প্রকৃতি কত ভয়ানক।


২২. মাছের চোখ তো তাকে কাতর করে না, সে ভাবে। সে ভাবে যখন সে বাজারে যায়, কত মাছ সে কিনে আনে বাসায়। সে মাছ তার বউ কুটে, তারপর রান্না করে, তারপর বাসার সবাই মজা করে খায়। সে ভাবে কই মাছের নিষ্পাপ ও নিরীহ চোখ তো তাকে কাতর করে না।


২৩. একদিন রাজহাঁসের ডানা ঝাপটানোর শব্দে তোমাদের জানালা খুলে যাবে। তারপর রাজহাঁস তোমাদের হাঁসের রাজা হওয়ার গল্প শোনাবে। তারপর রাজহাঁসকে তোমরা দেবতা ভেবে দক্ষিণা দেবে। তারপর একজন একজন করে আরও রাজহাঁস আসবে। তোমরা তাদের থাকতে দেবে তোমাদের ঘরে। তারপর এতবেশি রাজহাঁস আসবে যে তোমাদের ঘরগুলো রাজহাঁসের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। তারপর তোমাদের এলাকাটি রাজহাঁসের এলাকা হয়ে যাবে।


২৪. শিমুল তুলোগুলো বালিশের ভেতর কেমন মরে পড়ে থাকে। তুলোগুলো কি বালিশকে কখনো বলেছিল কিছু। বলেছিল কি আমাকে ছেড়ে দাও। ওড়ে বেড়ানো ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্টের। মনে হয় নি বলেছে। বলেও হয়ত থাকতে পারে। তবে বালিশে কাত করে ঘুমানোর সময় মাঝে মাঝে টের পাই শিমুল তুলোর কান্না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। তাই একদিন বালিশ ছিঁড়ে শিমুলতুলোগুলো সব ওড়িয়ে দিয়েছিলাম।


২৫. একটি গাছ আরেকটি গাছকে বলছিল, তোমরা কি আমরা মত নিরব থাকতে পার? আরেকটি গাছ অন্য আরেকটি গাছকে বলছিল তোমরা কি আমার মত নিরব থাকতে পার? এইভাবে আরেকটি গাছ আরেকটি গাছকে, এইভাবে সমস্ত গাছ সমস্ত গাছকে বলেছিল তোমরা কি আমার মত নিরব থাকতে পার? একদিন সমস্ত গাছ মিলে পৃথিবীর মানুষদের শাসিয়ে গেল তোমরা কি একটু হলেও আমাদের মত নিরব থাকতে পার?


২৬. সমুদ্রের কোনও ছায়া থাকে না, থাকে চিহ্ণ। একদিন আমাদের গ্রামেও সমুদ্র এসেছিল। সে সময়েও কোনও ছায়া ছিল না। সমুদ্র চলে যাবার পর পড়ে ছিল শামুক আর ঝিনুকের খোসা, মাটির ওপরে দীর্ঘ আঁচড়ের দাগ ছিল। মাটি তবু মানতেই চাইল না। বিশ্বাসই করল না যে সমুদ্রের কোনও ছায়া থাকে না, থাকে চিহ্ণ।


২৭. কেবল অন্ধকারই পারে দৃষ্টিকে মেরে ফেলতে। তাই দৃষ্টি কখনোই অন্ধকারের কাছে যায় না। কোথাও মোম জ্বলতে থাকলে সে মোমের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথাও কোনও বিদ্যুতের আলো বা লণ্ঠনের আলো-এসবের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকার তবু দৃষ্টির পথ ছাড়ে না।


২৮. বোবা লোকটি গান গাইত। বোবা লোকটি গান শুরু করলেই রাস্তায় জড়ো হয়ে যেত হাজারও মানুষ। বোবা লোকটির গানের ক্যাসেট বের হল। হাজার হাজার ভক্ত বাড়তে থাকল তার। বোবা লোকটি এখন কনসার্টে গান করে। লাখ লাখ মানুষ থাকে এই কনসার্টে। কারণ বোবা লোকটি বোবা।


২৯. ঘড়ি আর ঘড়ির কাঁটার সংসারটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। ঘড়ি লক্ষ্মী বউয়ের মত সারাক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে। আর ঘড়ির কাঁটা দৌঁড়ায় যে শুধু দৌঁড়াতেই থাকে। বিরামহীনভাবে দৌঁড়াতে থাকে। এমন সংসারও জগতে হয়।


৩০. সরলরেখা আর বক্ররেখার সাথে কখনোই পারা যাবে না আর। সরলরেখা বলে-আমি তো সরল। জগত সংসারটা সরল হলে কতই না ভাল হতো। যতদোষ এই বক্ররেখাটার। আর বক্ররেখা বলে-পৃথিবীটা সরল বলেই তো এত পিছিয়ে আছে। দয়া করে পৃথিবীটাকে একটু এগোতে দাও।


৩১. ব্যাঙ যখন পুকুরে ঝাপ দেয়, তখন জল শব্দ করে ওঠে। ভয়ে নয়, উল্লাসে। এই উল্লাসে যে এখন অন্তত কেউ তার বুক জুড়ে দৌঁড়িয়ে বেড়াবে কেউ। কাউকে সে বলতে পারবে, এই এত দৌঁড়াদৌঁড়ি করছ কেন? কাউকে সে বলতে পারবে, অনেক দুষ্টামি হয়েছে। এবার ঘরে গিয়ে চুপচাপ ঘুমাও।


৩২. এমন এমন পথও থাকে যেখানে কেউ যান না। আগে হয়ত যেতেন। এখন কেউ এই পথ ব্যবহার করেন না। পথটি মৃত সাপের মত মরে পড়ে আছে। সাপটির মত এই পথও রোদের আলোতে ঝলসে ওঠে। পঁচে গন্ধ বের হয়। মানুষজন কেউ আর যান না সেখানে। তবু পথটির শেষ মাথায় সন্ধ্যা নেমে আসে। রাত হয়।


৩৩. এই যে নদী, এই যে শীতল নদী। ছোট ছোট স্রোত তার। মাঝে মাঝে পানকৌড়ি ওড়ে এসে বসে। ডুব দেয়। নদীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ওড়ে অজস্র পাখি। তার উপর একটি সেতু আছে। সেই সেতু দিয়ে গাড়ি যায়। ঘোড়া যায়। আমার ঘোড়াটি সেতু দিয়ে যাবে না। নেমে পড়ল নদীতে। সে সাঁতরিয়েই যাবে।


৩৪. কিছু কিছু বাতাস নাকি আসে পাতা ওড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য। কিছু কিছু বাতাস ওড়ে এসে এসে নাকি জিজ্ঞেস করে যায়, কে আছে বাকি আর তার সাথে যাওয়ার। তারপর সে একদিন হুট করে আসে। তারপর সে একদিন হুট করে এসে নিয়ে যায় পাতা। একদিন নাকি হুট করে এসে আমাকেও নিয়ে যাবে।


৩৫. একটি মাছ যখন সামুদ্রিক পাখির ঠোঁট ধরে ওড়ে, তখন মাছটি ওড়ে না। মাছটি প্রাণভয়ে ছটফট করতে থাকে। মাছটি পাখির ঠোঁটে ব্যথায় কাতরাতে থাকে। মাছটি সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই মাছটি হয়ত অর্ধমৃত অবস্থায় সমুদ্রে পড়ে যাবে নয়ত পাখিটি ওড়ে ওড়েই গিলে খাবে তাকে।


৩৬. পাখি যখন পাতায় পাতায় ওড়ে তখন শুধু ওড়ে না, খাবারও সংগ্রহ করে। কখনো কখনো পাতায় লুকিয়ে থাকে। যেন তার শক্ররা দেখতে না পারে। পাতা তাকে এমনভাবে লুকিয়ে রাখে যেন কেউ তাকে দেখতে না পায়। এভাবে পাখি আর পাতার খেলা চলতে থাকে।


৩৭. মাকড়সা তার জাল বানায় পোকা আটকে রাখার জন্যে। যেন এই পোকাটি আর কোথাও যেতে না পারে। যেন এই পোকাটি পরে সে আয়েস করে খেতে পারে। মাকড়সার এই জালে শিশিরও আটকে থাকে। কিন্তু মাকড়সা শিশির খায় না। একটু দূরে বসে চেয়ে থাকে। আর শিশির হেসে হেসে ওড়ে যেতে থাকে।


৩৮. শীতকালে যখন গাছের সব পাতা ঝড়ে যায়, একটিও পাতা থাকে না যখন, তখন গাছের ডালগুলো হাত ওপরে তুলে প্রার্থনা করতে থাকে। কী প্রার্থনা করে তখন গাছ।


৩৯. ছেলেটা যখন পাথর ছোড়ে মারে তখন শুধু পাথর ছোড়ে মারে না, একটি মেঘ সে ছোড়ে মারে। সেই মেঘ ওড়তে ওড়তে কোনও একটা জায়গায় গিয়ে অনেক কালো হয়ে যায়, আর তখনই ভারি হয়ে আসে বাতাস। তখন বৃষ্টি নামে। কেউ একজন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আর সেই বৃষ্টিতে সারারাত ভিজে।


৪০. ছেলেটি আদর-যত্ন করে ঘুড়িটি ঘরে রেখে দেয়। রাতে সে স্বপ্ন দেখে কত ওপরে ওড়িয়েছে সে ঘুড়িটি। সকালে ঘুম থেকে ওঠেই নাটাই আর ঘুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছেলেটি। ছেলেটি সুতা ছেড়ে দেয় আর ঘুড়িটি পাগলের মত ওড়তে থাকে। ঘুড়িটি ওপরে ওড়তে ওড়তে কোথাও চলে যেতে চায়। ছেলেটি ঘুড়ির সুতা ধরে টান দেয়। ঘুড়িটি যেতে পারে না। ছেলেটি শিখল নাটাইয়ের ব্যবহার। ছেলেটি জানল না ঘুড়ির গলায় সুতা বেধে যাকে সে ওড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সে ওড়ে ওড়ে চলে যেতে চায় অন্য কোথাও।


৪১. অনেক রাতে কখনও কখনও পাখির শব্দ শোনা যায়। এটি পাখির কান্নার শব্দ। রাতে যে পাখি শব্দ করে, তা গান নয় কখনই। মানুষও রাতে ঝগড়া-ঝাটি করে। কাঁদে। গভীর রাতে কান পেতে রাখলে এই সব শব্দ শোনা যায়।


৪২. কিছু কিছু আলো জলের গভীরে বাস করে। পুকুরের জল কিংবা নদীর জলে। তাকিয়ে দেখলে মনে হবে কত শান্ত আর ভালবাসার সংসার তাদের। এত স্থির-স্নিগ্ধ সংসারও হয়। এইভাবে দু’জনে এত বেশি মিলে-মিশে যাওয়া যায়। এতটা একাট্টা যে জল নড়ে উঠলে, আলোও নড়ে ওঠে তেমন করে।


৪৩. আজকাল কারও জন্য কেউ অপেক্ষা করে না এটা সে জানে। তারপরও কেন যে সন্ধ্যা বেলায় একা একা ডালে বসে থাকে লক্ষ্মী পেঁচা। কেমন স্থির আর মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এখনও তাহলে কেউ কেউ ভাবে- কেউ একজন অবশ্যই আসবে। কোনও অন্যমনস্ক মুহূর্তে পেছন থেকে চুপিচপি এসে কেউ একজন তার হাত ধরে জানতে চাইবে-কেমন আছ?


                                              প্রলয় পর্বের কবিতা


১.


বনলতা,


আমার প্রেমিকা,


আমি তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না তখন।


তুমি হয়ত অনেক কিছুই ভেবে বসে আছ।


এত কিছু কেন ভাবছ জানি না।


তোমার নাক দিয়ে পানি পড়ছিল বলেই


তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না তখন।


২.


এইখানে আকাশ এসে


মিশে গেছে বস্তিতে।


এইখানে একজন পাগলি


উলঙ্গ ছাই-কালো শরীরে


রোদ মাখাচ্ছিল।


৩.


একদিন আমেরিকার সেনা ছাউনিতে জেগে ওঠবে চাঁদ।


একদিন সেই চাঁদ থেকে জ্যোৎস্নার মত ঝড়ে পড়বে মার্কিন অপ্সরী।


একদিন আমার মত ছেলেকবিকে ধর্ষণ করে চলে যাবে নারী।


৪.


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের গায়ে আঘাত এলে আমরা ক্ষেপে ওঠি,


কারণ আমরা তা হতে চেয়েছিলাম।


কখনও হয়তবা হতেও পারি,


তাই চাই না এই পেশায় কারও আঘাত।


বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকের ওপর আঘাত এলে আমরা মেনে নেই,


কখনও বা হেসেও দেই।


কারণ আমরা তা হতে চাই না।


এই পেশা নিয়ে আমাদের কোনও চিন্তা নেই।


৫.


আমরা আমাদের নিজেদের গু নিজে পরিষ্কার করতে পারি।


কিন্তু একজন মেথরের সাথে বসে


ভাত খেতে পারি না।


মেথরের সাথে বসে ভাত খেতে ঘেণ্ণা লাগে আমাদের।


মেথরের মুখের দিকে তাকালে


কেবল আমাদের নিজেদের গুয়ের কথাই মনে হয়।


৬.


গায়ের রং সাদা


তাই মেয়ে


তোমার এত দেমাগ।


ইউরোপের লোকেরা কিন্তু


তোমায় দেখলে বলবে


ওই কালা যা


ভাগ ভাগ।


৭.


কবিতা লিখতে গেলে কি কি জানি করতে হয়,


কি কি জানি ভাবতে হয়,


আকাশ থেকে নামিয়ে আনতে হয় চাঁদ


আর সমস্ত রাত নাকি গোসল করাতে হয় পুকুরে।


আমার এই সব চিত্রকল্পে মন ভরে না,


কেবলই বিরক্তিকর মনে হয়।


বিরক্তিটা আরও বেড়েছে সেদিন থেকে


যেদিন তোমার শরীর চাঁদ ভেবে চাটতে শুরু করেছিলাম।


মধু নয়


মুখের ভিতরে টের পেয়েছিলাম


কেবলই তোমার দুর্গন্ধের ঘাম।


৮.


আজ একটি দৃশ্য আমাকে সারাদিন ভাবাচ্ছে,


আজ একটি দৃশ্য আমাকে সারাদিন চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে,


এই দৃশ্যটি হয়ত কোনও ফটোগ্রাফার তুলে ধরলে


আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতেন।


হয়ত কোনও কবি এই দৃশ্যটিকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন


এত সুন্দর আর নমনীয়তায়


যে কবিতা পাঠক মাত্রই কেঁদে ফেলতেন।


আমার এর কিছুই ভালো লাগছে না


দেখলাম একজন মধ্য বয়সী নারী


শাক-সব্জির মালের ওপর বসে এক হাতে সব্জির ঝাপি ধরে আছে


আরেক হাতে আকাশমুখী ধরে আছে তার শিশু সন্তানকে।


একহাতে তার বর্তমান


আরেক হাতে তার ভবিষ্যত।


এই দৃশ্যকে


এই দৃশ্যটিকে ঠিক কোন রং


ঠিক কোন প্রলেপ দিলে আরও সুন্দর হত আমি জানি না।


সে সব ভাবতেও পারছি না


কেবল চলন্ত রিক্সায় এক হাতে সব্জির ঝাপি আর


আরেক হাতে শিশু সন্তানকে ধরে যেভাবে শক্তমুখে যাচ্ছিলেন;


সেই মুখ


সেই শক্তমুখ


আমার বার বার মনে হচ্ছে।


কোনও শব্দ বা দৃশ্য সৌন্দর্যের মত কিছুই আর মনে আসছে না আমার।


কেবল মনে হচ্ছে এই নারী হয়ত একা নিজে নিজে সংগ্রাম করে


বেঁচে আছে।


ওর স্বামী হয়ত নেই


হয়ত ওর স্বামী কাজ করে না।


এইসব কথা মনে হচ্ছে শুধু।


৯.


এইভাবে এত কিছু কেন বলছ আমায়?


এত অলংকার


উপমা


এসব দিয়ে কি করব আমি?


তুমি কেন রাজপুত্রের আলাপ কর আমার সঙ্গে,


টিভিতে একজন মডেলকে যে শার্ট পড়তে দেখেছ,


সেই শার্ট কেন পড়তে বল আমায়?


সেই ভাবে কেন হাসতে বল,


কথা বলতে বল?


তুমি তো জান


আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান।


আমার নায়িকা হল ঘরের দেবী।


ঘর থেকে বেরুবার সময় একবার তাকে প্রণাম করে বেরুব


ঘরে ফেরার পর আরেকবার তাকে প্রণাম করব।


তোমাদের কোনও অলংকার


তোমাদের কোনও উপমা


একদিন বুঝবে


আমার সাথে এর কিছুই যায় না।


কষ্টটা তোমার বেড়ে যাবে খুব তখন।


এরচেয়ে বরং জান আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান


পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।


এখানে প্রেমিকা যে অলংকার দিয়ে গান গায়


সেই অলংকারে থাকে খাটি কষ্ট।


কোনও ভান থাকে না।


এইখানে প্রেমিকা যে উপমা দিয়ে গান করে


সেই উপমায় নিঁখুত ব্যথা থাকে


কোনও আড় থাকে না।


যে ব্যথা


যে কষ্ট থাকে


পিছিয়ে পড়া মানুষ ছাড়া তা কেউ বুঝতে পারে না।


এইভাবে এত কিছু বল না আমায়,


এত অলংকার


এত উপমা।


গরীবেরা এত বেশি অলংকার পড়ে না,


অথবা গরীবের কোনও অলংকারই থাকে না,


গরীবের শরীরটাই কেবল তার অলংকার।


১০.


এইখানে


আমার হাতে হাত রাখ,


দেখ


তুলতুলে নয়।


ভেবেছিলে হয়ত নরম


তা কিন্তু নয়।


ভেবেছিলে সারাদিন কলমে লিখে


কম্পিউটারে কী বোর্ড চাপে


সেই হাত কি আর শক্ত হবে?


ব্যথায় ফোলা


খসখসে হাত হবে?


হবে,


হয়।


এই হাতও


ব্যথায় ফুলে যায়।


খসখসে,


অমসৃণ,


শক্ত হাত হয়।


এই হাতও


তোমার হাতে রাখবার নয়।


এই হাত ধরে পার্কের পর পার্ক হাঁটতে পারবে না তুমি।


এই হাত তোমার মুখ ছুঁয়ে বলতে পারবে না


তুমি সুন্দর।


কেবল যদি কখনও একা হয়ে যাও,


যদি কখনও তোমায়


বাস থেকে হঠাত পড়ে যেতে দেখি-


ভয় নেই,


জেনো কেবল তখনই এই হাত দেখতে পাবে


তোমার পাশে।


তখন বুঝবে


এই শক্ত হাত তোমাকে ভালবাসতে পারে না


কেবল বাঁচাতে পারে।


১১.


যে শিশুটি রেললাইনের ধারে বসে


ড্রাগ নিচ্ছে,


তাকে তুমি কোন উপমা দেবে কবি?


কোন উপমায় বলবে


এ দেবশিশু


শিশুস্বর্গ দেখলাম আজ।


পারবে না


কোনও উপমা নেই তোমার কাছে জানি।


এই কালো কুচকুচে


অজস্র বছরের ময়লা জমা শরীরের


এই শিশুকে কোনও ভাবেই


উপমিত করতে পারবে না তুমি।


কিম্বা তুমি হয়ত বলতে পার


একটি শিশু ডুবে গেল অন্ধকারে।


তোমার পবিত্র শুচিবায়ুগ্রস্ত মন


ছুঁতে পারবে না তাকে।


শুধুই ঘেণ্ণা লাগবে


আর এড়িয়ে যাবে তুমি।


কখনই জানতে পারবে না


এত কম বয়সেই


শিশুটি কেন ড্রাগ নেয়।


কেন সে চুরি করে।


পাগলের মত হন্যে হয়ে


ঘুরাঘুরি করে।


কেন সে বাবা বলে ডেকে ওঠার মত


চোখ তুলে তাকায় না।


যে শিশুটি রেললাইনের ধারে বসে


ড্রাগ নিচ্ছে,


তার জন্য কোনও উপমা নেই।


তার জন্য আছে শুধু শহরের সমস্ত গালি।


একটু খেয়াল করলে


তুমি শিশুটির মুখে থেকেই


শুনতে পারবে তা।


১২.


বিরহ ভাল লাগে না আর


তুমি ফিরে যাওয়ার কথা বলে


বারবার আসতে পার না আমার কাছে।


কবিরা এক একটি বৃক্ষের মতন দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভেবে


আপ্লুত হতে পারে।


পেতে পারে নিঃসঙ্গতার ভেতর আনন্দ।


বলতে পারে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষেরও


পরাগায়ণ হয়।


আমি পারি না।


এরকম শখ আর আহ্লাদ আমার নেই।


এরকম পুতুপুতু আবেগ আর আমার ভাল লাগে না।


বরং দেখ


তোমার ক্লাসের সবচেয়ে অনুজ্জ্বল ছেলেই আজ সুখে আছে।


পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী বউ আজ তার ঘরে।


সেরকম অনুজ্জ্বল হও,


নিভে যাও,


কোনও দৃশ্য কল্পনা নয়


সত্যিকারের দৃশ্য হও।


কল্পনা চিরকালই কল্পনা


সেখানে সত্য নেই,


সত্য থাকতে পারে না।


চিত্রকল্প চিরকালই চিত্রকল্প,


সেখানে সত্য নেই,


সত্য থাকতে পারে না।


ওটা মিথ্যার জগত।


কবিতা মিথ্যার জগত নয়।


রক্তের মত কবিতায় ফিনকি দিয়ে ওঠবে সত্য,


রক্তের মত ফিনকি দিয়ে ওঠবে বিরহ তোমার,


এইভাবে ভাব-


এরকম বিরহ ভাল।


১৩.


খুব ভোরে রাস্তায় হাঁটলেই দেখা যায়


মাটিকাটা মানুষদের।


মাটিকাটা মানুষেরা খুব ভোরে ওঠেই চলে যান মাটি কাটতে।


মাটিকেটে যা পান


তা দিয়ে আজকের দিনের খাবার যোগান।


একদিন মাটিকাটা নেই


তো একদিন খাবারও নেই।


মাটিকাটা আর নিজেদের খাবার


একে অপরের কাছে এত বেশি নির্ভরশীল যে,


মাটিকাটা মানুষের চেহারা মাটির মত।


চোখগুলো কেমন স্যাঁতস্যাঁতে,


ভেজা।


চামড়াগুলো বালুর চরের মত,


ছুঁলেই যেন ঝুড়ঝুড় করে ভেঙে পড়বে।


মাটিকাটা মানুষেরা মাটির মত।


অথবা মাটির মত মাটিকাটা মানুষেরা।


জানি না মাটিকাটা মানুষদের মাটি উপমা দেওয়া ঠিক হল কিনা।


মানুষ তো মানুষই।


মানুষ কি আর মাটির মত হয়?


তবে মাটিকাটা মানুষেরা অন্যরকম মানুষ।


যে মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে সমস্ত জগত-সংসার,


সেই মাটি যারা কেটে বেড়ান,


সেই মাটি কাটাই যাদের পেশা;


তাদের আমার অন্যরকম মানুষই মনে হয়।


অনেকগুলো মানুষ একসাথে বের হন মাটি কাটতে।


নারী-পুরুষ মিলে সারাদিন ধরে তারা মাটি কাটেন।


একদিন তাদের আর দেখা মিলে না।


কোথাও যেন হারিয়ে যায় তারা।


আমি মাটিকাটা হচ্ছে এরকম একটি জায়গায় ভেবেছিলাম


আজ কেউ মাটি কাটছে না তারা।


পরে গিয়ে দেখি গর্ত করে মাটি কাটতে কাটতে


নিচে চলে গেছেন তারা।


সমতল থেকে দেখা যাচ্ছিল না তাদের।


আরেকদিন গিয়ে অবশ্য দেখেছি


সত্যি সত্যি কেউ নেই তারা।


এরপর একদিন


দুইদিন


অনেকদিন তাদের দেখি না।


মানে হারিয়ে গেছে কোথাও,


অথবা দেবে গেছে।


মাটিকাটা মানুষেরা কি মাটি কাটতে কাটতে মাটির নিচে দেবে যায়?


১৪.


গাছকাটা মানুষেরা নাকি গাছের মত?


গাছের ডালে বসে থাকে,


শুয়ে থাকে,


কেউ কেউ নাকি গাছের ডালে বানিয়ে রাখে ঘর।


গাছের সাথে মিশে যায় ওরা।


গাছকাটা মানুষেরা আসলে নাকি মানুষ না,


গাছকাটা মানুষেরা নাকি এক একটি গাছ?


আমি তো দেখি,


গাছকাটা মানুষেরা দিব্যি এক এক মানুষ।


গাছ কাটে,


বিক্রি করে,


খায়-দায়-ঘুমায়।


কেউ কেউ খুবই চরা দরে বিক্রি করে এক একটি গাছ।


এরা অনেক ধনী লোক হয়।


কেউ কেউ অনেক রাতে চুরি করে গাছ কাটে।


কেউ কেউ বনের ভিতরে গাছ কাটতে গিয়ে


মারা পড়ে পুলিশের গুলিতে।


গাছকাটা মানুষেরা নাকি গাছের মত?


চুপচাপ বসে থাকে ঝোপঝাড়ে,


ফিসফিস করে কথা বলে,


আস্তে-ধীরে হাওয়া ছাড়ে নাকের।


আমি তো দেখি গাছকাটা মানুষেরা


ধপাস ধপাস শব্দ করে


ডাল ফেলে গাছের।


চুলের মত প্রথমে ছাটাই করে নেয় ডালপালা।


তারপর গুড়িটা কেটে দেয় গাছের।


কখনও কখনও কেমন ভয় লাগে,


যে গাছে চরে আছে গাছকাটা মানুষ,


সেই গাছই কেটে ফেলছে সে ঠাণ্ডা মাথায়


ধীরে ধীরে


একটু পরে।


তারপরও অনেকে বলেন,


গাছকাটা মানুষ নাকি আসলে গাছ।


মৃত্যুর পর ওরা নাকি গাছ হয়ে জন্মায়।


কেউ কেউ নাকি দেখেওছেন,


দু’ হাত ওপরে ডালের মত সাজিয়ে


দু’ পা মাটির নিচে পুতে রেখে


কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন গাছ।


১৫.


আমরা ধর্ষণ ধর্ষণ বলে চিৎকার করতে পারি


ধর্ষণের বিরুদ্ধে কাঁপিয়ে দিতে পারি রাজপথ,


কিন্তু সেক্স ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ করতে পারি না।


কারণ সেক্স ইন্ডাস্ট্রির নায়িকারা অনেক সেক্সি থাকে


এটা ছাড়া চোখ পূর্ণতা পায় না।


বাংলাদেশে দারিদ্র্যতাও এক ধরণের বাণিজ্য বলে


বিপ্লবে ঝাপিয়ে পড়তে পারি,


কিন্তু বিপ্লবও বাণিজ্য


এটা মেনে নিতে পারি না।


বস্তির ঘর-বাড়ি


ছেড়া ময়লা কাপড় পড়া


অভুক্ত মানুষের ছবি রঙিন টিভিতে বেশ রঙিন দেখায়


কষ্ট খুঁজে পাই না।


পৃথিবীর রাজারা আসবে বলে রাস্তার দু’ধারে


ফুলের গাছ লাগিয়ে রাখি


যেন এই দারিদ্রতা তোমার চোখে না বিধে।


আমরা কত কিছু পারি না,


কতকিছু হয় না আমাদের।


তোমাদের সব হয় বলে


আমাদের ঘরের মেয়েরা এখন


গভীর রাতে মোবাইলে কথা বলে চলে যায়।


সকালে পুলিশ এসে ঘর থেকে বের করে বাবার লাশ।


তোমাদের সব হয় বলে


গভীর রাতে তোমাদের কেউ এসে ডেকে নিয়ে যায়


আমাদের ঘরের ছেলেকে।


সে আর বাড়ি ফেরে না।


আমরা কিছুই পারি না,


রাতে উঠোনে বসে


আকাশের তারা খসে পড়া দেখা ছাড়া।


কেননা এই তারারা এখানকার পিতৃপুরুষ।


আমাদের ব্যর্থতাকে আর দেখতে চান না বলে


তারা হয়েও জ্বলতে চান না নাকি পিতৃপুরুষেরা।


১৬.


এভাবে নয় সেভাবে,


সেভাবে নয় ওভাবে,


ওভাবে নয় ওইভাবে,


করতে করতে


কেমন জানি হয়ে গেল চকমকি জীবন।


কত কত রঙ দেখালে,


বললে এই রঙে ভেসে ওঠে আকাশ।


কত শত স্বপ্ন দেখালে,


বললে এই স্বপ্নে ভেসে ওঠে আশা।


আমি হাত পেতে দিলাম,


শরীর পেতে দিলাম,


শরীর ভাসতে ভাসতে


এ নদী থেকে ও নদীতে,


এ সমুদ্র থেকে ও সমুদ্রে,


যেতে যেতে কত কিছুই তো দেখল।


কি দেখল,


কি দেখে ক্ষেপে গেল,


কি দেখে হেসে ওঠল,


ব্যথায় কুকড়ে গেল সমস্ত জীবন।


আহা


কি ব্যথা চারদিকে


ব্যথায় ব্যথাময় পুরোটা নাকি আকাশ।


ব্যথাও বিক্রি হয়


আকাশে-বাতাসে।


বিক্রি হয়ে হয়ে


কোথায় যেন যায়।


মানুষেরা সেসব ব্যথাও নাকি কিনে,


কিনে কিনে


নিয়ে যায় ঘরে


আর আড়ালে আবডালে সেসব নিয়ে নাকি


নিজেরাও কান্নাকাটি করে।


আহা হাস্যকর ব্যথা আমাদের,


ব্যথাও হাস্যকর হয়।


সারাদিন কেটে যায় চাকরিতে,


সারারাত কেটে যায় চাকরিতে,


ঘরে এসে শুনতে পাও


তোমার বউ নেই ঘরে।


সারাদিন কেটে যায় একা একা ঘরে,


সারারাত কেটে যায় একা একা ঘরে,


একদিন জানতে পার


তোমার স্বামী নাকি চলে গেছে


হাওয়া হয়ে ওড়ে।


এই সব ব্যথা নাকি ছাইপাস,


হরদম বিক্রি হয় আজ।


আর তুমি আড়ালে-আবডালে কাঁদো,


কেঁদে কেঁদে কার কথা ভাব।


ঘাসফুল আঁক নাকি ছেলের ড্রয়িং খাতায়?


ঘাসফুল কেন আঁক,


তোমাকে আঁকাও।


এভাবে নয় ওভাবে


সেভাবে নয় ওভাবে


ওভাবে নয় ওইভাবে


আঁকতে আঁকতে হেরে যাও।


হেরে যাও না ঠিক


কেউ তোমাকে ঠকায়।


খেলা শেষে মাঠে থাকে কেবল মাঠ আর পরাজিতরা


আর সব চলে যায় বিজিতের সাথে।


তুমি বরং মাঠ হও


মাঠ তো হওয়া যায় না,


মাঠের মত হও


মাঠের মতও হওয়া যায় না


তোমার মত হও।


চল আমরা আমাদের মত হই


কোন রঙে আর ভাসব না বিজ্ঞাপনের কথায়।


একা একা চলে যাব


একা একা থেকে যাব।


আহা


একা একা থাকাতেও কেমন সুখ সুখ থাকে।


কেমন নাকি কষ্ট কষ্ট সুখ।


এইসব বাদ দিই


এই সব বাদ দিয়ে চল যাই অন্য কোথাও,


আরেকটি দল চাই পরাজিতের।


১৭.


তুমিই নাকি সব?


তোমাতেই নাকি পরিভ্রমণ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের?


তোমাকে না পেয়ে


হাজার হাজার ছেলেরা


মরে ইঁদুরের বিষ খেয়ে।


তুমি কত কী যে করে গেলে


কত কী যে দেখালে


চুলে বেয়ে নামল তোমার


রজনীগন্ধার ঘ্রাণ


ছেলেদের যায় নাকি প্রাণ।


তুমিই তো পার তাহলে কত কী যে


শত শত রাজপুত্রদের নিয়ে


দেশ থেকে দেশান্তরে


পার তুমি ছুটতে


এক এক দেশে জিরিয়ে নেবে তুমি


আর এক একটি দেশ হয়ে ওঠবে তোমার


তুমিই পার


কারণ


তোমার পেছনেই ছুটেছে হাজার ছেলে


না পেয়ে মরে যাচ্ছে ইঁদুরের বিষ খেয়ে।


তোমাকে ছাড়া


পুরো পৃথিবীটা নাকি অন্ধকার তার?


আর সে নাকি একা


ভীষণ একা


ভুলে গেছে মাকে তার।


ভুলে গেছে


বাবা তার আজও বসে থাকে খাবার নিয়ে।


এই সব ছেলেরা


কতকিছু করতে রাজি


শুধু নাকি তোমার জন্য


তাকে তুমি বুকে নাও।


তার হাতে হাত


রাখবে নাকি তুমি?


ও মেয়ে তাকে তুমি


আদর দেবে নাকি?


নাকি খেলা খেলা ভেবে


চলে যাবে দূরে।


নাকি খেলা খেলা খেলবে


দিন-রাত-মাস-বছর।


এইসব ছেলেরা


সবকিছু ছেড়েছুড়ে নাকি তোমার কাছেই আসে


বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে,


সে পথ থেমে গেলে নামে


রাস্তায়।


পকেটে পকেটে নাকি তখন অনেক টাকা ওড়ে।


হৃদয়ের ছিনতাই করতে গিয়ে নেমে যায় টাকা ছিনতাইয়ে।


আরও নাকি কত কিছু করে।


শেষমেষ তোমাকে না পেয়ে


নিজেকেই খেয়ে ফেলে।


নিজেকে তো খেতে পারে না


কাউকে দিয়ে খাওয়ায়।


অন্য কোনও নেশায় দিয়ে দেয় তাকে।


ভুলে যায়


মা তার আজও বসে আছে টেবিলে খাবার নিয়ে,


ভুলে যায় বাবা তার কান পেতে বসে আছে।


বকাঝকা করে-


কই ছেলে তো আসে না


ছেলে তো আসে না।


এইসব ছেলে


তোমাকে ছাড়া নাকি ওরা মরে যায়


ইঁদুরের বিষ খেয়ে।


রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে


সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়


তোমাকে না পেয়ে।


তাহলে তো তুমিই তো সব


তুমিই তো পার তবে কত কিছু করতে।


এইসব রাজপুত্রদের তো কতজনই চায়


কতভাবে চায়।


ভিনদেশ থেকে লোক আসে


নিয়ে যায় প্লেনে করে।


তার হাতে রাখবে না হাত


তাকে তুমি দেবে না তোমার হৃদয়?


তুমিই তো সব।


তুমিই নাকি সব?


১৮.


এত কেন রহস্য করো


কি জানি বলে কেন


শ্বাস ফেল দীর্ঘ দীর্ঘ?


এই দীর্ঘ শ্বাসে আশা এসে মিশে নাকি?


ভেবেছ কেউ এসে নিয়ে যাবে তোমায়?


এই শহরে তুমি আছ কত দিন হলো-


কেউ কি নেই এমন কেউ,


এখনও কি নেই,


সত্য এই-ই।


কোনও দিন কারও কেউ হয় নি এ শহরে


ভেবো ধীরে ধীরে।


যে রাস্তায় হাঁট তুমি


একা একা প্রায়ই,


যে রাস্তার দোকানগুলো খুব খুব চেনা তোমার


আজ তারা চিনল না তোমায়।


মাঝ রাস্তায় শুয়ে আছো এই ভেবে,


মাঝ রাস্তায় শুয়ে কেউ ভাবে না তো


আজ মরেছিলে প্রায়।


কত জনকে ডেকেছ


কত জনকে বলেছ


বিপদে পড়েছ তুমি


কেউ এসে নিয়ে যাক।


কেউ তো আসে নি,


আসবে না তো কেউ,


এ শহর এমনই


এমন ছিল আগেও।


বাস ধাক্কা দিয়ে ফেলে গেছে তোমায়,


এত রাতে একা একা মাঝ রাস্তায়,


ব্যথায় যাচ্ছ মরে


করছ চিৎকার।


কেউ তো আসছে না আর


কেউ তো আসবে না আর।


এই শহরে এত রাতে তুমি একা


আগেও একা ছিলে,


চিরকালই ছিলে একা।


বোঝনি কখনও


এ শহরে যে আসে সে এরকমই ভাবে।


ভাবে এত এত মানুষ


চারপাশ কত রঙিন-ঝলমল;


তারপর ঢুকে যায় একটি ম্যানহোলে,


দেখে মনে হয় এইতো আছি বেশ।


কোনও দিন বুঝতে পারে


এই যেমন আজকে বুঝলে তুমি,


অনেক কিছুই তোমার হয়ে গেছে শেষ।


বুঝ নি কি আজ


বুঝছ তো ঠিক।


কে এনে দিয়ে গেল তোমাকে বাসায়।


এইই সেই লোক অফিস তাড়ার ভেতর


যার সাথে কখনই কথা হয় না তোমার।


যাকে তুমি কতবার কতশত বার


কম টাকায় ঠকিয়ে গিয়েছ অবলীলায়।


এই সেই রিক্সা ওয়ালা


মনে কি পড়ছে তোমার ঠিক,


কাল ঠিকই ভুলে যাবে তুমি তাকে


ম্যানহোলে ঢুকে যাবে নিশ্চিত।


১৯.


একটি ঘরের ভেতর কত কিছু থাকে,


একটি ঘরের ভেতর কতকিছু লাগে,


দক্ষিণ পাশে লাগে খোলা জানালা


আর বিশাল বড় দরজা লাগে তাতে।


সেই দরজাতে থাকা দরকার অনেক দামী কাঠ


জানালায় থাকে লাগা নকশা করা রেলিং।


ঘরের ভেতর থাকতে হয় আরও কত ঘর


এক ঘরে করতে হয় রান্না


আরেক ঘরে থাকতে হয় মেহমানখানা।


এক ঘরে রাখতে হয় ঘুম


আরেক ঘরে করতে হয় গোসলখানা।


তারপর এক ঘর থেকে যেতে হয় আরেক ঘরে


যখন যা দরকার করে নিতে হয় যেয়ে।


ঝড়-বৃষ্টি এলে ঘরের ভেতর থাকতে হয় আমাদের।


ঘরের ভেতর একে অপরকে জড়িয়ে থাকি।


ঝড় আসে


বৃষ্টি আসে


ধাক্কা দিয়ে চলে যায় ওরা


আমাদের পায় না খোঁজে।


তাই আমাদের মত করে ঘর বানিয়ে রাখি।


আমাদের মত করে সাজিয়ে রাখি ঘর


ড্রয়িং ঘর বানাই


সেখানে লাগিয়ে রাখি বাহারি গাছ


বাহারি গাছে গাছে ভরে ওঠে টব।


সেখানে ফুল ফোটে


ঘরে ফোটে ফুল


তাই সুবাস ছড়ায়।


আর আমরা নাচি-গাই


ঘরের ভেতরের গাছে ফুটেছে ফুল


যেন আমরাই ফুটে ওঠলাম সহসাই।


কখনও সুগন্ধি কিনে আনি


ঘরের কোণে কোণে ছড়িয়ে রাখি তা


সুগন্ধে সুগন্ধে ভরে ওঠে ঘর


আমাদের নতুন বাসর।


আমি আর আমার বউ শুয়ে থাকি ঘরে


চুপচাপ চেয়ে দেখে ঘর


চোখ বন্ধ করে।


সারাদিন সারারাত ঘরের বাইরে যা পাই


একসময় ঘরে তা নিয়ে এসে জমাই।


একসময় টাকা-পয়সাও রাখা হত ঘরে


চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায়


ব্যাংকেই রাখে এখন সবাই।


এইভাবে জমাতে জমাতে


এইভাবে দিন যেতে যেতে


আমাদের ঘরে কতকিছু আসে।


খাঁচায় খাঁচায় ভরে পাখিও নিয়ে আসি


পাখিরা মরে যায় খাঁচার ভেতরে।


কারণ ওটা নাকি ঘর নয়


ওদের ঘর নয়


আমাদের বানানো ঘর।


আমরাও তো ঘরে থাকি


এমনই খাঁচার পাখি।


খাঁচার মত ঘরের কারণে আমারও কি মরে যাই?


কে বানিয়েছে তবে আমাদের ঘর


আমাদের ঘর তবে আমাদের নয়?


২০.


মানুষ কেন ফুল পাশে রেখে ছবি তোলে?


মানুষ কি ফুল হতে চায়


নাকি থাকতে চায় ফুলের মত?


নাকি ফুলের মত হেসে হেসে


মরে যেতে চায় দ্রুত?


ফুল কখনও নাকি কাঁদে না,


জন্ম থেকেই যে হাসি নিয়ে জেগে ওঠে।


মৃত্যুর সময় শুধু খানিকটা ম্লান হয়,


বয়সে ম্লান হয়,


আর কিছু নয়।


মানুষও কি এরকম কিছু চায়


তাই ফুল পাশে রেখে ছবি তোলে।


তাহলে ফুল কেন কিনে নিয়ে আসে,


তুলে দেয় প্রেমিকার হাতে?


তারপর একটি একটি করে পাপড়ি তার ঝড়ে যায়


প্রেমিকার হৃদয়ে।


প্রেমিকা কি খুশি হয় ম্লান ফুল দেখে।


খুশিই তো হয়


খুশি হয় বলেই ফুল দেখে জড়িয়ে ধরে তার প্রেমিককে।


এমন তো হওয়ার কথা নয়,


এমন তো হওয়া উচিতও নয়,


মনে হয় বোঝে না সে।


মনে হয় জানে না সে


ছেঁড়া ফুলের হাসি


ক্রমশঃ ম্লান হয়ে আসে।


মানুষ তো ফুলের দোকানও দেয়।


জন্মদিন-বিয়ে-শ্রদ্ধায়


সে সব মরা ফুল কিনে নিয়ে যায়।


মরা ফুল দিয়ে আসে শিশুর হাতে,


মরা ফুল দিয়ে আসে বিবাহিতের কাছে,


মরা ফুল দিয়ে আসে শ্রদ্ধায়


মৃত মানুষকে।


এমন মরা মরা ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া


ফুলগুলো কেন দেয় তাদের হাতে?


হয় তারা বুঝে না


হয় তারা জানে না


ছেঁড়া ফুলের হাসি ক্রমশঃ ম্লান হয়ে আসে,


এই অভিশাপে


মানুষের হাসিও কি মরে যেতে থাকে?


মানুষের হাসি কেমন কষ্ট কষ্ট


মরা মরা ইদানিং


মানুষ যেন ভুলে গেছে কাকে বলে হাসিমুখ।


হাসলেও মনে হয় কষ্ট করে হাসে


হাসলেও মনে হয় আসলে হাসতে চায়নি সে।


না হাসলেই নয় তাই হাসে মাঝে মাঝে।


মানুষ তবুও ফুলের কাছে যায়,


গাছে ফোটা হাসিমাখা ফুলের সাথে ছবি তোলে।


মানুষ হয়ত ফুলের কাছে যায়,


নিজের হাসি মরে গেছে বলে।


২১.


স্কুলগুলো যেন মায়ের মতোন।


মায়ের মতন কি আসলে যেন মা।


এখনও দাঁড়িয়ে ডাকে


এখনও নিতে চায় কোলে


আর যেন বলে


তুই কিন্তু বড় হলি না।


সেই কবে ছেড়েছি স্কুল


স্কুলটা যেন আজও তেমনি আছে।


সকাল সকাল ঘুম ভাঙলেই


চলে যেতাম তার কাছে।


কত কিছু শেখাত


কত কী যে বলত


কত কী যে খেলতাম


দৌঁড়ে দৌঁড়ে পালাতাম


স্কুল ঠিক স্নেহ নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকত।


এখনও দাঁড়িয়ে আছে


মনে হয় বারবার ডাকে


আর ফিসফিস করে বলে


কেন আমি এখন আর আসি না তার কাছে।


কতদিন হয়ে গেল


যাই না তো স্কুলে।


স্কুল তবু ভুলে নাই


স্কুল কি কখনও ভুলে


আমরা ভুলে যাই।


স্কুল ঠিকই তার মত


সবকিছু মনে রাখে।


আসলেই তো পার হলো কতশত দিন,


কখনও কি ভেবেছি স্কুলের কথা


স্কুল কি আছে কি না আগের মতন?


আজ ঠিক কেন যেন


স্কুলের সামনে বসে


চোখে জল চলে এল।


জল কেন চলে এলো চোখে


আমি তো হয়েছি বড়।


আমি কি হইনি বড়


বড় হলে কেউ কি কাঁদে?


তবু যে কান্না আসে


কি জানি কি ভেবে


স্কুল কি ঠিক বুঝতে পারে আমার কথা?


স্কুল তো মায়ের মতোন


মায়ের মতন কি আসলে যেন মা


ঠিক ঠিক বুঝে আমাদের কথা।


এখনও দাঁড়িয়ে আছে


মনে হয় বারবার ডাকে


আর ফিসফিস করে বলে


তুই তো ঠিক রয়ে গেছিস আগেরই মতোন।


আমার যে কান্না আসে


কীসব বলে ফেলি শেষে


আর তাই চুপচাপ বসে থাকি পাশে।


স্কুলের আঁচল ধরে


হেঁটে হেঁটে হেঁটে


কই যেন যাই আমি;


এখনও কোথায় যাই


স্কুলের দিকে নয়


যেন মায়ের দিকেই তাকাই


অনেক অনেক দিন পর


মা যেন হেসে ওঠলেন সহসাই।


২২.


আমার বিপ্লবী বন্ধু দুইজন।

আরও বিপ্লবী বন্ধু আছে

তবে ঘনিষ্ঠ এই দুই।

একজন ছেলে আর আরেকজন মেয়ে।

একজন এখন ব্যাংকার আর আরেকজন এখন এড ফার্মে।

একজন থাকেন টাকার পাহাড়ে আরেকজন তা দিয়ে বানান বিজ্ঞাপন।

এখন তাই শহরের দেয়ালে দেয়ালে হাজার হাজার চার রঙা বিজ্ঞাপন।


বিপ্লবের রঙিন বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যায় ঢাকা শহর।

আমাদের ভেতর কেমন কেঁপে ওঠে

এই বুঝি এল ভাই সত্যিকারের দেশ

এই বুঝি এল ভাই সত্যিকারের স্বদেশ।


ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে হেসে ওঠে ঢাকা

আমাদের হৃদয় তো বিপ্লবেই আঁকা।

কেমন রঙিন করে হেসে ওঠেন মার্কস

হেসে ওঠেন আরও কতজন

আমাদের রাষ্ট্র হাসে কেবল কাঁদে মানুষের মন।


কই এল না তো কিছু, আসে না তো কিছু,

এত কেন দেরি ভাই বিপ্লবের?

রঙিন কান্না দেখে ভিখারিও হাসে

ভাবে বুঝি আহারে।

বড় বড় লোকেরা কাঁদতেও পারে না

তাই বুঝি চোখ দিয়ে জলের বদলে ঝড়ে

চোখের জলের বদলে কতশত রঙ।


এমনই তো বিপ্লব, এমন কি বিপ্লব?

মানুষের কেন হুঁশ আসে না

মানুষ কেন এত বেশি বেঁহুশ

মানুষের কি কোনোদিন ঘুম ভাঙবে না?


আসবে না মিছিলে, বলবে না তাদের কথা?

খেতে পায় না দু’বেলা

খেতে তো চায় দু’ বেলা

এই কথা কেউ কি বলবে না?


বলে না কেন কথা, আসে না কেন মিছিলে

কতশত রঙিন পোস্টার

নজরে কি পড়ে না তাদের?

নজরে ঠিকই পড়ে

নজরে ঠিকই পড়ে

আমাদের থেকে হয়ত তারাই বেশি জানে

আসে না হয় না তাই তাদের মিছিলে

ভাবে বুঝি এসব বড়লোকের কাম-কাজ

কি করব আমরা এসে।

আমাদের কথা ওরা ঢং করে বলে বলুক

আমরা ঘুমাতে চাই দু’বেলা ভাত যদি

আমাদের পেটে ঢুকে।


আমার বন্ধু আর কত টাকা খোয়াবে বল

আমার বান্ধবী আর কত বিজ্ঞাপন দেবে?

কেউ যদি না চায় নিজেদের মিছিলে আসতে

তাকে কি জোর করে নিয়ে আসা যাবে?


২৩.


তুমি মুক্ত তুমি স্বাধীন

এটা গণতান্ত্রিক দেশ।

গণতন্ত্রের চর্চাই স্বাধীনতার চর্চা

তবে তুমি কখনোই গাড়ি চালানোর সময় ডান দিকে যেও না।

তবে তুমি কখনোই হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ডান দিকের রাস্তায় চলে যেও না

রাস্তায় গাড়ি চালাতে হলে তোমাকে প্রথম নিয়ম জানতে হবে

হাঁটতে হলে জানা চাই নিয়ম।

নিয়মের বাইরে গেলে তুমি নিজেই ডেকে আনবে তোমার বিপদ

কোনও দুর্ঘটনায় হয়ত পড়ে থাকতে হবে তোমাকে।


তুমি মুক্ত তুমি স্বাধীন

এটা গণতান্ত্রিক দেশ।

তাই বলে রাস্তার ছেলে-মেয়েদের রুটি বানানোর হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে

ভাবতে পারো না কয়েকটি রুটি তো থাকতে পারে দাম ছাড়া

কয়েকটা রুটি তো কেউ আশা করতে পারে বিনামূল্যে।

এটা তুমি পারো না।

নিউমার্কেটে হাঁটতে হাঁটতে এত এত পছন্দের জিনিস দেখে দেখে আর

দাম করে করে তুমি যখন ক্লান্ত আর ভাবছ কোনও কিছুই কেনা হবে না তোমার

এত টাকা তো নেই তোমার

তোমাকেও কিন্তু একজন দোকানদার বলেছিল

এই পৃথিবীতে কোনও কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না।

তুমি চাইলেও আশা করতে পার না তা।


তুমি মুক্ত তুমি স্বাধীন

এটা গণতান্ত্রিক দেশ।

গণতন্ত্রের চর্চাই স্বাধীনতার চর্চা।

তাই বলে তুমি পুলিশকে ঘুষ খেতে দেখে কিছু বলতে যেও না

ওরা নিয়মের পাহারাদার।

যারা নিয়মের পাহারা দেয়

তাদের কাছে সবই নিয়ম,

ঘুষ খাওয়াও নিয়ম।

কিন্তু তুমি তো আর নিয়মের পাহারাদার নও

তোমার জন্য অনেক নিয়ম করে দেওয়া আছে,

তা পালন করো

কারণ পালন করাই তোমার নিয়ম।

নিয়মের পাহারাদারকে নিয়ম শেখানো নিয়ম নয় তোমার।


স্বাধীনতার চর্চা মানে গণতন্ত্রের চর্চা

এই গণতন্ত্রের কিছু নিয়ম থাকে

এই গণতন্ত্রের কিছু পাহারাদার থাকে

পাহারাদার পাহারাদার মিলে অনেক কিছু করে

অনেক কিছুই তারা করতে পারে।

কিন্তু তুমি তা পারো না।

গণতন্ত্রও একটি তন্ত্র

সেই তন্ত্রেও কিছু তান্ত্রিক থাকে

তুমি তো তান্ত্রিক নও

তাই তোমার তান্ত্রিকের মত আচরণ করতে মানা।


২৪.


তারা জানে না যে আমি যখন চিন্তা ছোঁড়ে দেই

তখন শুধু চিন্তাই ছুঁড়ে দেই

কোনও বন্দুকের গুলি বা

কোনও ষণ্ডা-পাণ্ডা নিয়ে কারও দিকে এগোই না।

বা সবাই আসলে আমাকে বুঝতে পারে না

অথবা বুঝতে পারে বলে চায় মেরে ফেলতে

বা আমাকে আঘাত করতে যেন আমি উবে যাই

চলে যাই চুপ হয়ে যাই কথা বন্ধ করে দেই


কিন্তু তারা কেউই বুঝতে পারে না

আমার কোনও শত্রু নেই।

আমি পৃথিবীর কাউকে শত্রু মনে করি না

আমার শত্রু শুধু চিন্তা।

সেই চিন্তা বা সেই ভাবনা যা মানুষকে চালায়

মানুষ জানে না বা অনেক মানুষই বুঝতে পারে না।

তার পছন্দ-অপছন্দ, ভাল লাগা-মন্দ লাগা

তার হাতে নেই বা তার মনে হচ্ছে এটাই আমার ভালোলাগা

এটাই আমার পছন্দ কিন্তু আসলে তা না।

সে একটি চিন্তা বা ভাবনা দ্বারা পরিচালিত

সেই চিন্তাই তার নিয়তি বা সেই চিন্তার চালিত যন্ত্রে তার অবস্থান নির্ধারিত।


কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারে না

বা তারা এটা বুঝতে চায় না

বা তাদেরকে এটা বিশ্বাস করানোই কেন যেন সম্ভব না।

আমি ক্ষেপে ওঠি এক একটি চিন্তার বিরুদ্ধে

আমি ক্ষেপে ওঠি এক একটি দর্শনের বিরুদ্ধে

আমি ক্ষেপে ওঠি কারণ আমার মনে হয় তখন ক্ষেপে ওঠাই উচিত।

আমি সেই চিন্তা আর দর্শনের বিরুদ্ধে বলি

কারণ আমার মনে হয় আমার এভাবেই বলা উচিত।


কিন্তু তারা মনে করে আমি তাদের মত না

তারা মনে করে সে ক্ষতিকর

তারা মনে করে আমার উদ্দেশ্য খারাপ

তারা মনে করে আমি তাদের ক্ষতি করছি

তাই আমাকে তাদের মেরে ফেলতে হবে

তাই আমাকে তাদের চুপ করিয়ে দিতে হবে।

অথচ আমার সেই কথা বলার সাথে কোনও বন্দুকের গুলি থাকে না

সেই কথা বলা সাথে সেই শব্দের সাথে কোনও ষণ্ডা-পাণ্ডা থাকে না

সেখানে কেবল একটি শব্দের বিরুদ্ধে থাকে আরেকটি শব্দ

একটি বাক্যের বিরুদ্ধে থাকে আরেকটি বাক্য

একটি চিন্তার বিরুদ্ধে থাকে আরেকটি চিন্তা

একটি দর্শনের বিরুদ্ধে থাকে আরেকটি দর্শন।

আমি তো কাউকে মেরে ফেলতে চাই না

আমি তো কাউকে আঘাত করতে চাই না

আমি তো কারো বিরুদ্ধে ষণ্ডা-পাণ্ডা ভাড়া করি না

আমি কেবল একটু চিন্তা করি

আমি কেবল একটি শব্দ উচ্চারণ করি

আমি কেবল একটি বাক্য উচ্চারণ করি।

তবু আমিই তাদের প্রতিপক্ষ

তবু আমিই তাদের শত্রু

তবু আমাকেই তাদের মেরে ফেলতে হবে

অথবা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করতে হবে

যাতে আমি থেমে যাই চুপ হয়ে যাই

যাতে আমি আর আমি থাকি না

তাদের মত হয়ে যাই।


২৫.


দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেল

ও মেয়ে একটু ঢেকে ঢুকে চলিস

দিন কাল যা পড়েছে

মেয়েটা শুনল আর ব্যথায় কুঁকড়ে গেল।


মেয়েটা কলেজে ওঠেছে

একদিন কলেজের টিচার বললেন,

সবসময় কলেজের ড্রেস পড়েই আসলেই হবে,

মাঝে মাঝে অন্য ড্রেসও পড়ে এসো।

মেয়েটা শুনল আর ব্যথায় কুঁকড়ে গেল।


মেয়েটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকেছে

একদিন বস বললেন,

শুধু কাজ করলেই হবে

মাঝে মাঝে হাসতে হবে

সুন্দর করে আসতে হবে শাড়ি পড়ে

তা না হলে অফিস কি আর অফিস থাকে

অফিসেও ভাল লাগা না লাগা থাকে না?

মেয়েটা শুনল আর ব্যথায় কুঁকড়ে গেল।


তাহলে কাজ করে কি হবে

যদি শরীরই লাগে

যদি শরীরই লাগে সব জায়গায়

নানাভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে

নানাভাবে দরকারি হয়ে ওঠে সবার স্বার্থে

তাহলে এত ভাল রেজাল্ট

পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস দিয়ে কি হবে?

খাব মুড়ি ভেজে ভেজে?


শরীরই তো লাগে

কাজও করতে হবে আবার হেসে হেসে দেখাতে হবে শরীরও,

মেধাও লাগে আবার সেজেগুজে দেখাতে হবে শরীরও,

তবে মেধা আর কাজ দিয়ে কি হবে

আহা শরীরই তো সব।

তবে মা কেন এত ভুল শাসন করে

বাবা কেন রাতে ঘুমান না ভয়ে

সবই তো এমন এমন করে সাজানো

মুখে মুখে বলবে সবাই কাজ করো ভাই করো কাজ

মেধাটাই আসল

আসলে ওসব সব দেখানো বুলি

আওড়াতে হয় তাই আওড়ায় সবাই

ভেতরে ভেতরে ঠিক জানে

শরীরও তো চাই

আসলে তো মেয়েদের শরীরটাই আসল

আর কিছু নয়।

মেয়েদের কি তবে শরীরটাই আসল?

আর কিছু নয়?

এইসব ভেবে ভেবে কার কাছে যায় মেয়ে

যায় না তো কোথাও

কেমন একা একা লাগে তার

দিন-মাস-বছর যায়

আর কত ক্ষণ

ঘরে সে এখন শুয়ে বসে কাটায়

কি ভাবে মনে মনে

আসলে কি এটাই মেয়েদের জীবন?


২৬.


রাস্তার ধারে কিভাবে শুয়ে থাকে মানুষ?

রাস্তার ধারে শুয়ে কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ?

ঘুম কি আসে

আসে না কি ঘুম?

ঘুম আসে বলেই তো শুয়ে থাকে এভাবে

কিভাবে শুয়ে থাকে রাস্তার মানুষ

হাজার বছরের ধুলো বালি আর ময়লা জমা একটি কাঁথা

সে কিভাবে মুড়িয়ে থাকে?

এভাবে মুড়িয়ে থাকে

একেবারে মাথা ঢেকে

বাইরে থেকে বোঝা যায়

এমনভাবে সে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়

কানটাকেও বন্ধ রাখে

যেন কোনও শব্দও না যায় তার মাথায়

যেন কোনও মশা মাছি নাগাল না পায় তারে

এমনভাবে এমনভাবে শুয়ে শুয়ে থেকে কার কথা মনে করে সে?

এমনভাবে শুয়ে আছে

যেন জগতের সবকিছু থেকেই যেন আলাদা সে

অথচ সে শুয়ে আছে রাস্তার ধারে

কত মানুষের চলাফেরা

কতশত শব্দ গাড়ির

তবু কোনও কিছুই যাচ্ছে না তার কানে।

এইভাবে শুয়ে আছে

এইভাবেও শুয়ে থাকা যায়

এইভাবেও শুয়ে থেকে আলাদা হয়ে থাকা যায়

সবকিছুর

তাহলে আলাদা হয়ে হয়ে এই শুয়ে থাকা চোখের ভুবনে কে এসে বাজে

কেউ কি আসে না চোখের কোণে তার

রাস্তার মানুষের কি থাকে না কেউ আপন?

কেউ তো আছে

কেউ তো থাকে

অবশ্যই কেউ।

কে আসে বাজে তার চোখের কোণে

কে এসে নাচে তার চোখের কোণে

কোনও স্বপ্ন কি থাকে

কোনও আশা কি থাকে

রাস্তার মানুষের হারিয়ে যাওয়া মানুষেরও কি কোনও স্বপ্ন থাকে?

নাকি অপেক্ষা করে

খুব করে অপেক্ষা করে

মৃত্যু এসে বরং আজ নিয়ে যাক তাকে।

যার ঘর থাকে না

সংসার হয়ত বা ছিল আজ আর নেই কিছু

এমন এমন মানুষের চোখে কি স্বপ্ন থাকতে পারে?

হয়ত থাকে

মরতে পারছে না বলে কাল ঘুম থেকে ওঠে কিভাবে খাবার পাবে

এইকথা ভাবে।

এও তো ভাবনা

এও তো স্বপ্ন

কাল জুটবে খাবার তবে।

এইকথা কি তবে চোখ বুজে ভাবে?

নাকি অন্যকিছু?

এইসব বেঁচে থাকা আর ভাল লাগে না তার

এইসব ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া

মরে যাবার কথাই সে ভাবে নাকি

মৃত্যুই কি তার এখন একমাত্র চাওয়া?


২৭.


হঠাৎ পথে কোনও নারীর সুন্দর হাসি যেভাবে আমাদের মোহিত করে

যেভাবে কখনও কখনও একটি নারীর জন্য মনে হয় পুরো জীবনটাই দিয়ে দেব

যেভাবে কোনও নারীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অভিমানে নীল হয়ে ওঠে জীবন

যেভাবে কোনও নারীর হাত ধরে ভাবা যায় এই বিশাল সমুদ্রও আজ আমাদের সাথে।


সেভাবে কোনও দেশের প্রেমে কি পড়া যায়

সেভাবে কোনও দেশকে হাসাতে পারে মোহিত করতে পারে আমাদের

সেভাবে কোনও দেশকে না পেয়ে কি অভিমানে নীল হয়ে ওঠে জীবন

সেভাবে দেশের হাত ধরে কি ভাবা যায় এই বিশাল সমুদ্রও আজ সাথে রয়েছে আমাদের?


ভাবা কি যায়

এই ভুখা নাঙ্গার দেশে

এই দারিদ্র হতাশ যুবক নেশা আর বেকারত্বের দেশে

এই হত্যা,গুম,ধর্ষনের দেশে?


এই দেশ কি হাসতে পারে প্রেমিকার মতো

যা দেখে মনে হয় না জীবনের একটা মানে আছে।

মানে আছে বেঁচে থাকার।

এই দেশ কি আবার ফিরে আসতে পারে

যেভাবে প্রেমিকা আসে

অভিমানে নীল হয়ে ওঠা জীবনে।

এই দেশের কি হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় সমুদ্রের পারে

যেভাবে প্রেমিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায়।


জানি না

মাঝে মাঝে ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি

ভেবেছি দেশের আঁচলকে প্রেমিকার আঁচল ভাবা যায় কিনা

খুব ভোরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে রাখা যায় কিনা তার আঁচলে?

ভেবে ভেবে মেলাবার চেষ্টা করেছি

এই দেশ কি আমাকে সেরকম আবেগী করে তোলে

এই দেশ কি আমাকে সেরকম স্বপ্নের নেশায় ফেলে

এই দেশ কি আমাকে উদ্যমী করে তোলে

উৎফুল্ল করে তুলে

উদ্বেলিত করে তুলে?

জানি না

একবার আমার প্রেমিকাকে বলেছিলাম

চল পালিয়ে যাই

যত কষ্টই হোক

যত পরিশ্রমই করার দরকার পড়ুক না কেন

তোমাকে নিয়েই আমি ঘর বাধব

চল যাই পালিয়ে যাই।

ভাবছি প্রেমিকা তোমাকে নিয়ে আমি যেভাবে ভেবেছি

সাহস করেছি

সিদ্ধান্ত নিয়েছে

দেশকে নিয়ে আমার ভেতরে তেমন কিছু কাজ করে কিনা?

তেমন কিছু কাজ করে কি?

কি জানি

কেবল কিছু গান আমার ভেতরে দেখেছি রক্ত দুলিয়ে যায়।

কেবল কিছু গান আমার ভেতরে দেখেছি তোলপাড় শুরু করে দেয়,

মনে হয় না দেশ বলে কিছু একটা আছে

দেশ বলে ভালবাসার স্বপ্ন দেখার কিছু আছে,

দেশ বলে এমন কিছু আছে যা এখনও আমাকে আবেগী করে তোলে

আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠি

খালি পায়ে হাঁটতে থাকি

কি একটা গান মনে পড়ে-

সম্ভবত দেশকে ভালবাসার দেশ প্রেমের সেই গান।

এই হত্যা-ধর্ষণ-জ্যাম-বাজে রাজনীতি-বিস্ফোরণ-চাঁদাবাজি-হঠকারিতা-বেকারত্ব-অভুক্ত মানুষ-ধাপ্পাবাজ-মুখোশ পড়া মানুষ- আদর্শহীন- মানুষের দেশে

সেই গানে এখনও কি এমন প্রাণ আছে

যা আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করে

প্রেমে পড়তে বাধ্য করে

হাত ধরে সমুদ্রের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য করে

একটি দেশের।


২৮.


কতবার যে বললাম

কতবার যে জানালাম

কতবার যে ফোনে কথা হলো

চলো একবার শাহবাগে দেখা করি

আসবে আসবে বলে কতদিন কেটে গেলো

আজকাল খেয়ালও বোধহয় করো না তুমি।


এতটা অখেয়ালে থেকে থেকে

ভুলেই তো গিয়েছিলে সব

মনে কি আছে আমায়

মনে কি ছিল তোমার

এই আমিই তোমাকে কতবার বলেছি

চলো একবার চলো শাহবাগ চলো

একবার অন্তত দেখা করি

দেখা হয় নি আর।

দেখা হতেও পারত

কতবার কত শত বার

দেখা হয় নি আর।

দেখা না হলে কি এতকিছু পাল্টে যায়

দেখা না হলে কি পাল্টে যাওয়াটা সহজ

দেখা না হলে কি ইতিহাসও পাল্টায়?

পাল্টালোই তো

এভাবেই পাল্টে যায় তাহলে সব

তোমার-আমার মত কতশত জীবন

এভাবেই তাহলে পাল্টে গেলে তুমি।


তবে সেই শাহবাগ কিন্তু পাল্টায়নি একদম

তোমাকে ঠিক যে উত্তাল সময়ে ডেকেছিলাম

আজ অনেকদিন পর

এখনও সেই উত্তাল সময়।

এত এত উত্তেজনা এখনও আমার

তোমাকেও তো দেখলাম বেশ স্লোগান দিচ্ছ

গলা ভাঙেনি একদম

সেই টগবগে কণ্ঠ এখনও তোমার

তুমি পাল তুলেছ

আমি সুর মেলে দিয়েছি

শাহবাগ কেমন হেসে ওঠেছে

দেখনি হয়ত।

শাহবাগ

এইসব রাগ-অনুরাগ-ব্যথা-হতাশা-ভালবাসার কথা

সবই জানে কিন্তু

সেও জমিয়েছে আবেগ বিন্দু বিন্দু

শুধু আমার আর তোমার কথা নয়

এখানে দাঁড়ানো

দাঁড়িয়ে স্লোগান দেওয়া সব মানুষকেই চেনে শাহবাগ।


অনেক দিন পর

আবার ধরেছ স্লোগান

তুমি পাল তুলেছ

আমি সুর মেলে দিয়েছি

দেখা কিন্তু হয়েই গেলো

না হয় হলো অনেকদিন পর

তোমার কণ্ঠে মিলেছে আমার কণ্ঠ

এও এক প্রেম।

আমাদের শাহবাগ

আমাদের বেদনা আর দ্রোহের ঘর।


২৯.


তুমি যখন কথা বল

কখনও কখনও ঠিক নয় প্রায় সব সময়েই

আমি কেবল শুনেই যাই

শুনেই যাই।

তার মানে এই নয় যে আমার তোমার কথায় মনোযোগ নেই

মনোযোগ অবশ্যই থাকে

এবং সেসব আমি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারি

বা পরে কখনো স্মরণও করতে পারি।

কিন্তু তোমার সেসব কথার আমি কোনও বিচার-বিবেচনা করি না।

তোমার সেসব কথার আমার কোনও পূর্বধারণা থাকে না

তোমার সেসব কথা নিয়ে আমার কোনও হতাশাও কাজ করে না।

কিন্তু আমি সে সব শুনি।

তোমাকে কোনও ধরণের প্রশ্ন না করেই শুনি

তোমাকে কোনও ধরণের বিরক্তি না করেই শুনি

তোমাকে আমার এইসব বিষয়ে বুঝতে না দিয়েই শুনি

এবং সেসব শুনতে আমার বরং ভালই লাগে।

একেবারে একটার পর একটা গল্প

একটার পর একটা কাহিনী

একটার পর একটা ঘটনা

সেসব আমাকে বেশ মজা দেয়।

এটা তুমি আমার বন্ধু বা প্রেমিকা বলেই নয়

আমি যে কারও কথাই শুনি

বলা যায় একেবারে মনোযোগ দিয়েই শুনি

এবং সেসব কথা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে

এসব কথার ভেতরে প্রায় সময়েই আমাদের ইচ্ছেগুলো এক মনে হয়।

কখনও আমাদের স্বপ্নগুলো

কখনও আমাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো

কখনও আমাদের দাবি-দাওয়াগুলো

সত্যিকার অর্থে মিলেই যায়।

মনে হয় আমার কথাগুলিই তুমি অনর্গল বলে যাচ্ছে

মনে হয় আমার ভাবনাগুলিই তুমি অনর্গল বলে যাচ্ছ

মনে হয় আমার স্বপ্নগুলিই তুমি অনর্গল বলে যাচ্ছ

আর সে কারণে আমার সেসব কথা শুনতে খুবই ভাল লাগে।

এটা একেবারেই তুমি আমার বন্ধু বা প্রেমিকা বলে নয়

যে কারও কথার ক্ষেত্রেই আমার এরকম হয়।

বলতে পার আমি একদম একেবারে ভালো একজন শ্রোতা

বেশ মনোযোগী শ্রোতা

কোনও বিচার বিবেচনা ছাড়া

কোনও পূর্ব ধারণা ছাড়া

কোনও ধরণের হতাশা ছাড়া

আমি কথা শুনে যাচ্ছি

আর তুমি বলে যাচ্ছ

বলা যায় আমাদের প্রায় সব পথই এক।

বলা যায় সব পথই আমাদের পথ

বা আমাদের যাওয়ার পথ একটাই

বা আমাদের লক্ষ্য, আমাদের গন্তব্য একটাই

এবং সেটা যে কোনও কিছুতেই

কেবল

কখনও

হঠাৎ

মাঝেমাঝে

তোমার পথের সাথে মেলে না আমার পথ

অথবা আমার পথের সাথে মেলে না তোমার পথ

অথবা আমরা আলাদা হয়ে যাই।


৩০.


সাহেবরা এসে আমাদের খুব সমাদর করলেন।

অনেক দামী আর অপূর্ব সুন্দর গাড়ি নিয়ে তারা আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়েছিল।

সচরাচর এই ধরনের গাড়ি নিয়ে কোনও সাহেব আমাদের গ্রামে ঢোকেন না।

তারা ঢুকেছেন।

গাড়িটি এত সুন্দর আর আমাদের গ্রামের মাটি আর কাঁদা রাস্তায় এটি কেমন কালো হয়ে ওঠেছে।

গ্রামের লোকেরা কালো হয়।

কারণ তাদের সারাক্ষণ রোদে রোদে থাকতে হয়

ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়াতে হয়।

গ্রামের লোকেরা তাই দেখতে অসুন্দর।

গ্রামে শহরের গাড়ি ঢুকলেও কেমন হয়ে ওঠে অসুন্দর।

সেইসব সাহেবেরা আমাদের সমাদর করলেন খুব।

আমরা আমাদের গরিব হওয়াটাকে মেনে নিতে পারছিলাম না।

ভেতরে ভেতরে লজ্জা লাগছিল

আর সমাদর করার কথা আমাদের

কিন্তু উল্টো সমাদর করছেন সাহেবেরা।

আমরা একটি পুকুরের পাড়ে সাহেবদের সাথে নানা কথা বললাম-

এই গ্রামটি তাদের অনেক ভাল লেগেছে বলল তারা।

এই গ্রামের ধানক্ষেত তাদের ভাল লেগেছে

গ্রামের চারপাশে তাকালেই সবুজ

সবুজ আর সবুজ যেন পাহারা দিয়ে রাখে এই গ্রাম।

তারা এই সবুজের প্রশংসা করলেন আর শহরে যে কোনও সবুজ থাকে না এই কথা বললেন

কোনও কোনও সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

সাহেবরা আরও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলেন।

এই গ্রামে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কত

এই গ্রামে কয়টি স্কুল আছে

এরকম কত রকম প্রশ্ন।

তারপর সাহেবরা বললেন,

তারা এই গ্রামে আসতে চান

মানে তারা এই গ্রামে একটি কোম্পানি দেবেন।

এতে গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি থেকেই একজন করে চাকুরি পাবে

এতে গ্রামে বিদ্যুৎ চলে আসবে

এতে গ্রামের মানুষ আরামে-আয়েশে দিন কাটাতে পারবে।

আমরা তো অনেক খুশি

এই সব সাহেবেরা তো শুধু সাহেব নয়

আসলে ফেরশতা।

আমরা তাদের কি করে ধন্যবাদ জানাব

পেলাম না খুঁজে।

একদিন সাহেবেরা সত্যি সত্যি গ্রামে এলেন

একদিন সাহেবেরা সত্যি সত্যি কোম্পানি দিলেন

একদিন সাহেবেরা সত্যি সত্যি গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে এলেন

একদিন সাহেবেরা সত্যি সত্যি গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে একজন একজন করে চাকুরি দিলেন

আর গ্রামের পাহারাদার সবুজ রঙটি কেমন কালো হয়ে ওঠল।

আমরা কেমন কালো থেকে আরও কালো হয়ে ওঠছি,

কালো হওয়া তো খুব খারাপ।

আর ধানক্ষেতও ভরে ওঠছে কোম্পানির কালো জলে।

আর আমাদের দাদা সেই ধানক্ষেতের এক কোণায় সারাদিন বসে থাকেন

কারও সাথে কোনও কথা বলেন না।

বাসায় এসে ভাতও খেতে চান না।

কেবল ধানক্ষেতের এক কোণায় প্রতিদিন সকালে গিয়ে বসেন

রাতে কখনো ফেরেন অথবা কখনো ফেরেন না।


৩১.


জেলেরা সারাদিন ঘুমায় আর মাছ ধরে সারারাত

একদিন বের হয় মাছ ধরতে

আর ফিরে আসে পনের-বিশ দিন পর।

যখন সে ফিরে আসে তখন টাকা নিয়ে আসে

খাবার কিনে আনে

ছেলের জন্য খেলনা কিনে আনে

বউয়ের জন্য ভালবাসা আনে।

আর যখন সে মাছ ধরতে যায়

তখন সে বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে

কিছু বলে না

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে

কিছু বলে না

ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে

কিছু বলে না।

একবার তার ব্যাগ ঠিক আছে কিনা দেখে

দৌঁড়ে চলে আসে নৌকার কাছে

ফিরে তাকায় না।

ফিরে কেন তাকায় না

ফিরে তাকালে কি কান্না পায়?

ফিরে তাকালে কান্না পায় কেন?

এতকিছু ভাবে না সে

এতকিছু ভাবলে খাবার জুটবে না পেটে।

নৌকায় গিয়ে আর সব জেলেদের সাথে গল্পে জড়িয়ে নেয়

যেন কিছু করে নি সে

যেন কিছু ভাবে নি সে

যেন কিছু ঘটেনি আজ

মাছ ধরার গল্প নিয়ে নৌকা এগিয়ে চলে

ভাসতে ভাসতে নৌকা চলে যায় সুদূর সমুদ্রে।

রাত ভর গান আর ভালবাসায় নেচে ওঠে মাছ

মাছেরা ভরে ওঠে নৌকায়।

যেন মাছ নয়

কতশত স্বপ্ন জমে ওঠেছে চোখে

বউ হাসছে যেন

ছেলে হাসছে যেন।

মাছেরা সব জানে

মাছেরা জানে কখন জেলেদের জালে ধরা দেবে সে

কখন জেলেরা খুশি হবে ধরা পড়লে

কখন জেলেরা নিজেরাই মাছ হয়ে ওঠবে।

এইভাবে ফিরে আসে জেলে

ঘরে ফিরে আসে অনেক খাবার আর ভালবাসা নিয়ে।

ছেলেকে মাছ ধরার গল্প বলে

গল্প বলে কিভাবে মানুষও হয়ে ওঠে মাছ

আর সেইসব মাছ কি করে জানে

জেলেদের জালে তাকে কখন কিভাবে ধরা দিতে হবে

ছেলে চুপচাপ শুনে আর বাবাকে বলে

তাকেও যেন তার বাবা একদিন মাছ ধরতে নিয়ে যায়।

এইভাবে একদিন সব জেলেরা মাছ ধরতে গেল

মায়েরা অপেক্ষা করতে থাকল জেলেদের ফিরে আসার

ছেলেরা অপেক্ষা করতে থাকল তাদের বাবাদের ফিরে আসার

একদিন রেডিও জানাল

সেই গ্রামের সমস্ত জেলে সমুদ্রে মাছ হয়ে ভাসছে।


৩২.


মেয়েটি প্রচণ্ড মেধাবী ছিল

কথা-বার্তা, চলনে-বলনে মেধার ছাপ ছিল স্পষ্ট।

ওর স্বপ্নগুলোও ছিল দুর্দান্ত।

সে স্বপ্ন দেখত যে তার বর এমন কেউ হবে

যাকে দেখলেই মনে হবে দেশের সেরা একজন মানুষের সাথে কথা বলছি।

তার চেহারা হবে রাজপুত্রের মত।

সে স্বপ্ন দেখত এরকম একজন বরের হাত ধরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশ থেকে দেশ।

সে স্বপ্ন দেখত একদিন নারী আর পুরুষের সমতা আসবে।

ছেলেদের মত নারীরাও সব কিছু করতে পারবে।

সে স্বপ্ন দেখত গ্রামে সে একটি মেয়েদের স্কুল দেবে

সেখানে হাজার হাজার মেয়েরা পড়াশুনা করবে

অনেক বড় হবে।

স্বপ্নগুলো দেখেও তো মেধা বোঝা যায়,

এই স্বপ্নগুলো সেই সব মেধার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বিষয়টা বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের নয়

একেবারেই নির্জলা সত্য

একেবারেই সত্যি এ কথা

ক্লাসে সে কখনও সেকেণ্ড হয় নি।

ক্লাসে সে সব শিক্ষকের প্রিয় ছিল

শুধু ক্লাসের পড়াশুনা নয়

বিতর্ক-নাচ-গান-কবিতা পাঠ সব বিষয়েই সে ছিল পারদর্শী।

সামাজিকভাবে মানুষের মেধা থাকলেই হয় না

পুঁজিবাদী সমাজটা এমন যে তার চেহারাও ভাল থাকতে হয়,

সেদিক দিয়েও মেয়েটি ছিল অনেক এগিয়ে।

শুধু এগিয়ে নয় ঈর্ষা করার মতই ছিল

একদিকে পড়াশুনা,আরেকদিকে সামাজিক যে কোনও কাজ

সবদিক দিয়েই কি কারও পক্ষে এগিয়ে থাকা সম্ভব?

এতটা এগিয়ে থাকা সম্ভব?

এটা বিশ্বাস করার মত নয়।

তবে কখনও কখনও অবিশ্বাস্য কিছু বিষয় বিশ্বাস করতেই হয়

না করেও উপায় থাক না।

কারণ এটা বানানো নয়

একেবারেই সত্য

নির্জলা সত্য।

মেয়েটির এইসব স্বপ্ন শুনে যে কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত

আর বলত তুমিই পারবে।

আমরা অবাক হয়ে থাকতাম

একটি মেয়ের ভেতর ঠিক কি এমন থাকলে সে এতটা এগিয়ে যেতে পারে।

সত্যিই মেয়েটা মেধাবী ছিল

এবং তা ছিল ঈর্ষা করার মত।

কিন্তু এই ঈর্ষা অনেকটা মেয়েটার প্রেমে পড়ার ঈর্ষা

অনেক বেশি ভালবেসে ফেলার ঈর্ষা।

একদিন সেই মেয়েটিকেই আর খুঁজে পাওয়া গেল না

খুঁজে পাওয়া গেল না যে গেলই না।

সারা শহর মাইকিং করা হল

সারা শহরের মানুষের মুখে মুখে সেই মেয়েটিকে নিয়ে করুণ আহাজারি

আহা কি হল এই মেয়ের

এমন মেয়ে আর হয় না

কোথায় গেল এই মেয়ে।

যথারীতি একদিন ভুলেও গেল সবাই এই মেধাবী মেয়েটির মুখ।

অনেকদিন পর একদিন হঠাৎ টিভিতে সেই মেয়েকেই দেখলাম

একজন সুন্দর ছেলের হাত ধরে নাচছে।


৩৩.


আমি যখন ছোট ছিলাম

তখন আমার নখ বড় হলেই

আমার বাবা আমার নখ কেটে দিতেন।

যতবার নখগুলো বড় হতো

ততবারই বাবা আমার নখগুলো কেটে দিতেন।

কিন্তু আমার বাবা কি জানতেন

তখন আমার আবেগও বড় হচ্ছে।

আমার মা আমার বাবা

তাদের প্রতি আমার আবেগ বাড়ছেই ক্রমশঃ।

হয়ত জানতেন

জানার কথাই তো

আমার বাবা যখন ছোট ছিলেন

তখন আমার দাদা নিশ্চয়ই

যত্ন করে কেটে দিতেন তার হাত ও পায়ের নখ

এই এখন যেমন তিনি আমার হাত-পায়ের নখ কেটে দিচ্ছেন।

তখনও তার তার আবেগ বড় হচ্ছিল।

কিন্তু সেই আবেগ তো আর কাটা যায় না

আমার আবেগও তো কাটতে পারবেন না আমার বাবা।

কাজেই এটি বড় হচ্ছে

ধীরে ধীরে ক্রমশঃ বড় হচ্ছে

আর ভাললাগা-ভালবাসা বাড়ছে তাদেরকে নিয়ে

আরও অনেককে নিয়ে।

ঠিক আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার পায়ের পাতাও ছিল ছোট

আমি সেই পায়ের পাতার ছাপ মাটিতে দেখে বলতাম

মা দেখ লক্ষ্মীর পা।

মা হাসতেন,

কিন্তু আমার মা কি জানতেন আমার পায়ের পাতাও বড় হচ্ছে ক্রমশঃ

জানতেন তো বটেই

এই কারণেই হয়ত মাঝে মাঝে বলে উঠতেন

মানুষ বড় হলে তার মা-বাবাকে ভুলে যায়।

মানুষের পায়ের পাতা যত বড় হতে থাকে

ততই নাকি মানুষ অনেক বড় হতে থাকে

আর বড় হতে থাকা কি মা-বাবাকে ভুলে যাওয়া?

আমি জানি না

কখনও এভাবে ভাবিনি।

তবে ভেবেছি যে আমার আবেগ আর আমার পায়ের পাতা এক সাথেই বড় হচ্ছে।

আর তাই আমি বড় হচ্ছি

এবং আবেগ ততই তীব্র হচ্ছে আমার মা-বাবাকে নিয়ে।

একদিন আমার আবেগ আরও বেশি আবেগী হয়ে ওঠল একটি মেয়েকে নিয়ে।

আমি জানতাম না এই আবেগের কথা

এই আবেগ সবকিছু ভুলিয়ে দিল আমায়।

খেয়াল করলাম

মা-বাবার চাইতেও এই মেয়েটি কিভাবে যেন আমাকে বেশি আবেগী করে তুলছে।

আমি অনেক কিছুই ভুলতে বসেছি যেন

আমার শৈশব- বাবার নখ কেটে দেওয়া- মাকে লক্ষ্মী পায়ের কথা বলা

আমার মা-বাবাকে নিয়ে আবেগ

একদিন বড় হলে

তোমাদের কষ্ট করতে হবে না আর


তাহলে কি মানুষের নখের মত আবেগও কেটে যায়?


৩৪.


আমার দাদীমা আমাকে শিখিয়েছিলেন

কিভাবে হাঁটতে হয়।

আমি তার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি।

আমি যখন পৃথিবীর ওপর দু’ পা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাতাম

তিনি হাসতেন আর হাততালি দিতেন।

আমি যখন পৃথিবীর ওপর এক পা দু’ পা করে এগুবার চেষ্টা করতাম

তিনি হাসতেন আর হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতেন।

আজ আমি সেই হাঁটি হাঁটি পা দিয়ে কতদূর চলে এসেছি

আমার দাদীমা জানেন না।

আমার দাদীমা না জেনেই চলে গেলেন

কিছু না বলেই চলে গেলেন

কিন্তু আমি যখন মাঝে মাঝে ইদানিং একদমই হাঁটা হয় না


এরকম কিছু ভাবি

আমি যখন ভাবি যে প্রতিদিন সকালে আমার অন্তত আধা কিলোমিটার হাঁটা উচিত

তখন আমার দাদীমার কথা মনে পড়ে।

মনে পড়ে তার সেই হাসিমাখা মুখ

আমি পৃথিবীর ওপর এক পা দুই পা করে এগুচ্ছি

আর উনি হাততালি দিচ্ছেন।


আমার দাদীমা আমাকে শিখিয়েছিলেন কথা

আমি যখন একেবারেই ছোট

কোনও কথাই পারি না বলতে

তখন আমার দাদীমা আমাকে শিখিয়েছিলেন মা ডাক বাবা ডাক।

তারপর আস্তে আস্তে কত কথা শিখেছি

এখন আমি কত কথা শিখেছি

কথার ছলাকলা শিখেছি

কথা গুছিয়ে বলা

কথা সাজানো

কথা দিয়ে কবিতা লেখা

কথা দিয়ে গল্প লেখা উপন্যাস লেখা

কতকিছু শিখলাম।

আমার দাদীমা আমার এত কথা শিখে ফেলার কথা জানেন না

জানেন না আমি এখন সেই সব কথা দিয়ে কবিতার বই বের করি

জানেন না আমি এখন সেই সব কথা দিয়ে গল্পের বই বের করি

আমার দাদীমা এসব কিছু না জেনেই চলে গেলেন।

প্রায়ই যখন আমি চুপচাপ বসে থাকি

যখন কারও সাথে কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করে না

যখন একা একা চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে

তখন আমার দাদীমার কথা মনে পড়ে।

মনে পড়ে আমার সেই প্রথম মা ডাক বলে ওঠার সময়

যেভাবে উনি শেখানোর আনন্দে চমকে উঠেছিলেন

মনে পড়ে আমার সেই প্রথম বাবা ডাক বলে ওঠার সময়

যেভাবে উনি শেখানোর আনন্দে চমকে উঠেছিলেন

মনে পড়ে আমার প্রথম দাদীমা ডাক বলে ওঠার সময়

যেভাবে উনি শেখানোর আনন্দে চমকে উঠেছিলেন

মনে হচ্ছে আজ হঠাৎ

একা

চুপচাপ

বসে থাকার এই সময়ে

কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে না করার এই সময়ে

আমি বলে উঠছি

দাদীমা।