Wednesday, February 7, 2024

দশভুজা: দুপুর মিত্র


দশভুজা



দশভুজা


দুপুর মিত্র


 


প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১২


 


কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোন অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই নকল ও পরিবেশন করতে পারবেন।


 


প্রকাশক


দুপুর মিত্র


 


প্রচ্ছদ


নির্ঝর নৈ:শব্দ


 


বইটি বিক্রির জন্য নয়


 


যাদের ভালবাসায় ঋদ্ধ


রুবাইয়াৎ আহমেদ,অদ্বৈত মারুত, সিদ্ধার্থ টিপু, বিল্লাল মেহেদী, অদিতি ফাল্গুনী, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, মেহেদী উল্লাহ,


হামীম কামরুল হক, আহমাদ শামীম, সঞ্জয় ঘোষ, সালাহ্উদ্দীন শুভ্র, মাহবুব মোর্শেদ এবং অন্যান্য লেখকদের যারা গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও সহযোগিতা করেছেন ও এর মুদ্রণ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে যে সমস্ত শ্রমিকেরা শ্রম দিয়েছেন




উৎসর্গ


রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যে লোকটি


গান করে টাকা তুলে সংসার চালায়


মাঝে মাঝে মনে হয়


সেই লোকটিই কেবল জানে


শিল্প আর জীবন


এক ও অদ্বিতীয়


…এইসব মানুষের করকমলে


 

পাঁচটি কিসসা 


গণতন্ত্র



সংসদ ভবনের পেছন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকগুলো লেক দেখলাম, সেই লেকের দুইপাশে অনেক মানুষ বসে আছে, গল্প করছে, প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত ধরে বসে আছে। ওদের বসতে থাকা দেখে আমারও মনে হল এখানে বসা দরকার। কারণ কোনো কাজ নেই আজ আমার, কারণ ওরাও বসেছে, কারণ এখানে আগে কখনই বসিনি। তাই বসে বসে কিছুণ বাদাম খেলাম, আশপাশের মানুষজন দেখলাম, একা বসে আছি বলে কেউ কেউ কয়েকবার করে আমার দিকে তাকাল, কেউ কেউ বোধহয় বিরক্ত হল। আমি বাদাম কিনলাম, বাদাম কিনে সবগুলো বাদাম বসে বসে খেলাম, সময় চলে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না বোঝা যাচ্ছিল না বা সময় কখনো যায় না, আমরা যাই। যাই হোক, এক পর্যায়ে টের পেলাম, একা বসে থাকতে থাকতে আমার কোমর ধরে গেছে। তাই দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করব। একটা খেলা মনে হল- চার কোণা বা তিন কোণার মাটির বা ইটের চাকতি দিয়ে কায়দা করে লেকের উপর ছুড়ে মারলে ওটি ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয়। আমার মনে হল এখন এই খেলাটা খেলব। কিছুণ চার কোণা বা তিন কোণা বিশিষ্ট এরকম মাটি আর ইটের চাকতি সংগ্রহ করলাম। আমি লেকে একবার এভাবে ছুড়লাম। প্রথমটা একবার কি দুইবার লাফাল। কেউ তেমন খেয়াল করেনি বা একজন কি দুইজন দেখেছে যে আমি এরকম করছি। আমি আরেকবার করলাম, ওটা দুইবার কি চারবার লাফাল। বেশ কয়েজন আমার দিকে তাকাল আমার এই খেলাটা দেখতে পেয়ে। কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কী খেলা। তেমন তো লাফাল না ইত্যাদি। আমি হেসে বললাম- আরও কয়েকবার করলে এটা আরও বেশি লাফাবে। ওদের আমার কাছে এসে কথা বলাতে বেশ মজা পেলাম। একটু সাহসও পেলাম। এবং আবারও আমি খেলার চেষ্টা করলাম। এবার অনেকণ লাফিয়েছে। এই খেলা দেখে বস্তির কয়েকটি ছেলেমেয়ে জুটে গেল। তারাও আমার মত করে চার কোণা বা তিন কোণা বিশিষ্ট মাটি বা ইটের চাকতি সংগ্রহ করল। এবং আমার মত খেলতে লাগল। ওরা দেখল কেউ আমার মত পারছে না।



বেশ কয়েকজন প্রেমিক-প্রেমিকাও আমার মত খেলা শুরু করল। কিন্তু ওরা শখের বশে খেলল। প্রেমিকটি তার প্রেমিকাকে দেখানোর চেষ্টাও করল যে, সে আমার চেয়ে বেশি চাকতি লাফাতে পারে। কিন্তু পারল না। এরকম করে অনেকেই লেকজুড়ে এই খেলা শুরু করল।


একজন আমাকে বলে বসল আচ্ছা চাকতিটি লেকের ওপারে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলে কী হয়। আমি একবার বিস্মিত হলাম, লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। এই খেলা খেললে কী হয়, এই জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন কখনও হইনি। তাও আবার যে লোকটি জিজ্ঞেস করেছে সে বয়সে অনেক বড়। আমি বলে ফেললাম, ওপারে ব্যাঙের মত লাফিয়ে নিয়ে যেতে পারলে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আসে। বুড়ো লোকটি আমার দিকে তাকাল আর আমার কাছ থেকে একটি চাকতি নিয়ে এমন ভাবে কায়দা করে ছুড়ল যে, ওটি অনেকণ লেকে ঘুরপাক খেতে খেতে লাফিয়ে লাফিয়ে একেবারে লেকের ওপারে গিয়ে হাজির হল। সবাই বৃদ্ধলোকটির এই কাজে বিস্মিত হয়ে গেল। কেবল আমি মনে মনে বললাম- বেটা পাগল।


 

মদ




লোকটা প্রতিদিন বারে আসত মানে মদের দোকানে। লোকটাকে ঘিরে প্রতিদিন কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার-আমলা, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-বাম নেতারা, আমলারা বসত। লোকটা কখনোই বারের ছেলেদের দিয়ে কাজ করাত না। একবার কবি, না হয় ডাক্তার, না হয় আমলা, না হয় আওয়ামী লীগের নেতা, না হয় বিএনপি নেতা, না হয় জামায়াত নেতা, না হয় বাম নেতাদের দিয়ে কাজ করাত। এই ধরুন যখন ছোলার প্রয়োজন পড়ত তখন কোন এক বাম নেতাকে বলত এই খানকির পোলা, ছোলা নিয়া আসস না কেন। পাছায় একটা লাথ্থি দিমু। আর অমনি সুড়সুড় করে নেতাটি ছোলা নিয়ে আসত। এরকম করে একবার আওয়ামী লীগ নেতাকে, একবার বিএনপি নেতাকে, জামায়াত নেতাকে। আর ওরা সুড়সুড় করে ওই কাজটি করে দিত। প্রতিদিন মদ খাওয়া শেষে পুরো টাকাটা দিয়ে সে বাসায় চলে যেত। অদ্ভুত একটা লোক- মনে হয় এইভাবে মদ খাইয়ে হুকুম দিয়ে সে একটা মজা লুটত। এইভাবে লোকটাকে ঘিরে আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, বাম, আমলা জড়ো হতে থাকলে লোকটার হুকুম বাড়তে থাকল আর লোকটা আরও বেশি মজা পেতে থাকল। এইভাবে মজা মজা পেতে পেতে লোকটা একদিন দেশের বিশেষ কেউ হয়ে উঠল আর এইভাবে লোকটার মজার পরিমাণ দিনকে দিন বাড়তেই থাকল।



প্রেম


 


একবার এক ছেলে এক মেয়ের প্রেমে পড়ল, এমন প্রেম যে ছেলেটি কখনোই মেয়েটিকে বলে না যে সে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে বা বলবে কি, কোনোদিন মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়নি পর্যন্ত, মেয়েটি ছেলেটিকে চিনে কি-না সন্দেহ; তারপরও ছেলেটি মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। মানে গোয়েন্দা পুলিশের মত মেয়েটি কখন বাসা থেকে বের হয়, কোথায় যায়, কী করে, কোথায় আড্ডা দেয় সবই ছেলেটির মুখস্থ। কেবল মেয়েটির সামনে দাঁড়ায় না সে, কেবল মেয়েটির সাথে কথা বলে না সে, কেবল মেয়েটিকে সে দূর থেকে দেখে। একদিন মেয়েটিকে না দেখলেই তার মন খুব খারাপ থাকে; কারণ সে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। তাই সে দূর থেকে মেয়েটিকে দেখে তবে বাড়ি ফিরে। এটাই তার প্রেম- এতেই তার আনন্দ।


এভাবে প্রায় একবছর ছেলেটি মেয়েটির সাথে প্রেম করে। একদিন ভেজা বৃষ্টির দুপুরে কোনো এক পার্কে মেয়েটিকে তার এক বন্ধুর সঙ্গে চুমু খেতে দেখে ছেলেটি বুঝতে পারে- মেয়েটিকে সে আসলে ভালোবাসে না।


   

বশীকরণ


একবার এক লোক এক সাধুর কাছে গিয়ে বলল, আমার ব্যবসায়ী বন্ধুটি, যাকে নিয়ে আমি ব্যবসা করি; সে আমার কথা মানছে না। আমাকে এমন কোনো মন্ত্র দিন যাতে করে সে আমার কথা শুনে।


সাধুটি বলল, ঠিক আছে এই নে তাবিজ, এই তাবিজ হাতে রাখবি, দেখবি বন্ধু তোর কথা মানবে।


তাবিজ হাতে রাখার পর থেকে লোকটি বিস্ময়কর ফল পেল। বন্ধুটি তার কথার বাইরে এক চুলও এগোয় না। মানে সে যা বলে ব্যবসায়ী বন্ধুটি তাই করে কোনো বাকবিতণ্ডা ছাড়াই।

এমন অভাবনীয় ফল পেয়ে লোকটি আবারও সাধুটির কাছে গেল। বলল, আমার ব্যবসায়ী বন্ধুটি এখন আমার সব কথাই মন দিয়ে শুনছে ও কাজ করছে, আপনার অশেষ কেরামতি, এখন ব্যবসাতেও আমার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল কয়েক মাস ধরে আমার স্ত্রী আমার কথা শুনছে না, আমাকে এমন মন্ত্র দিন যাতে করে স্ত্রী আমার কথা শুনে।


সাধু বলল, ঠিক আছে এই তাবিজ নিয়ে যা, বিছানার নিচে রাখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে।


 


তাবিজটি বিছানার নিচে রাখার পর সত্যি সত্যি স্ত্রীও তার কথা শুনতে লাগল।


 



কয়েক মাস পর লোকটি আবারও সাধুর বাড়িতে গিয়ে হাজির। বলল, সবই ঠিক আছে, আপনার দেওয়া তাবিজে সবাই আমার কথা মানছে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি আমার কথা মানছি না। এজন্য কি কোনো তাবিজ আছে?


 


সাধু কিছুণ লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্য কোনো তাবিজ নেই। কেবল একটি মন্ত্র আছে, সেটি সারাণ জপ করতে হবে। লোকটি বলল, ঠিক আছে তাই দিন।


 


সাধু লোকটির কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল, আমি আমার কথা মানব, আমি আমার কথা মানব।


 


এরপর থেকে লোকটি শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু এই মন্ত্রই জপ করে- আমি আমার কথা মানব, আমি আমার কথা মানব।


 


দুই-তিন মাস পর কোনো এক দুপুরে লোকটি জানতে পারে তার স্ত্রী আর ব্যবসায়ী বন্ধুটি পালিয়ে গেছে।


  

শুভ পরিণয়


 এক দেশে বহু গুণে গুণান্বিত এক রাজপুত্র ছিলেন। তার গুণে রাজা-রানী-দেশবাসী সবাই সন্তুষ্ট। এমন রাজ পরিবারে এমন রাজপুত্রই চাই। কিন্তু রাজপুত্রটির একটিই দোষ ছিল- আর সেটা হল তার বিয়ে হচ্ছিল না। তাই রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দেওয়া হল, কে হতে চায় রাজপরিবারের বধূ। বধূ হবার জন্য কেবল একটিই শর্ত, কন্যাটির পূর্বে কোনো প্রেম থাকা চলবে না।


 


একদিন গেল, দুই দিন গেল এরকম করে এক মাস কেটে গেল রাজ্যজুড়ে এমন এক কন্যা পাওয়া গেল না, যার পূর্বে প্রেম ছিল না। রাজা-রানী-রাজপুত্র বেশ শঙ্কায় পড়ে গেলেন। তাহলে কি রাজপুত্রের বিয়ে হবে না?


রাজপুত্র কয়েকদিন পর সিদ্ধান্ত নিলেন এমন ঘোষণা দিতে যে পূর্ব প্রেমে সমস্যা নেই, কিন্তু কোনো পূর্ব যৌন সম্পর্ক থাকা চলবে না। যথারীতি রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দেওয়া হল। কিন্তু একদিন গেল, দুই দিন গেল, একমাস কেটে গেল রাজ্যজুড়ে কোনো কন্যা পাওয়া গেল না, যার পূর্ব যৌন সম্পর্ক নেই। রাজপুত্র কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। পরে সিদ্ধান্ত নিলেন এমন ঘোষণা দিতে যে, পূর্ব যৌন সম্পর্ক থাকলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এখনও যৌন সম্পর্ক আছে এমন কন্যা থাকলে চলবে না। রাজ্যজুড়ে তাই ঘোষণা দেওয়া হল। কিন্তু এবারও রাজপুত্রের ভাগ্যে কন্যা জুটল না। এই অবস্থায় রাজপুত্র একবার সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বিয়ে করবেন না, চিরকুমার থেকে যাবেন।


 


রাজা-রানীর মনে অনেক কষ্ট। রাজ্যবাসীরও মনে কষ্টের শেষ নেই। এমন রাজপুত্রের জন্য কোনো কন্যা নেই?


 


অনেকদিন পর কোনো এক সকাল বেলায় কোনো এক ফুলকুমারীর প্রেমে পড়ে গেলেন রাজপুত্র। রাজপুত্রের মনে হল, এই কন্যার যদি কোথাও প্রেম থেকেও থাকে, যদি কারও সাথে দৈহিক সম্পর্ক থেকেও থাকে, তবুও তাকে চাই, যে কোনোভাবেই তাকে চাই, তাকেই বিয়ে করতে হবে আমার।


 


এ নিয়ে রাজপ্রাসাদে কানাঘুষাও চলতে লাগল। একদিন রাজা উজিরকে ডেকে কন্যার সমস্ত বৃত্তান্ত জোগাড় করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। অতঃপর রাজপুত্রের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হল।


 


 


 


 




পাঁচটি গল্প 


মাকড়সা


কখনো কখনো মানুষের জীবনে কী এমন কিছু ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা নাই, বা যার কোনো কার্যকারণ নাই, বা ব্যাখ্যা করার মতা নেই বলেই বোধহয় মনে হয় এটি ব্যাখ্যাতীত; অথবা আসলেই কি কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা থাকে-এটা তো এমনও হতে পারে বিষয়টির উপর মানুষের চাপিয়ে দেওয়া অলীক কল্পনা। কিন্তু এটা ঠিক যে ঘটনাটি ঘটে, কখনো সাদা-কালো, কখনো বা রঙিন রঙে, কখনো টিভি পর্দায়, কখনো কম্পিউটার স্ক্রিনে, কখনো অট্রালিকায় কখনো বস্তিতে। সোমা কি প্রায়ই সেই ঘটনাটির দিকেই তাকিয়ে থাকে, দেখে তার চারপাশ দিন দিন কেমন স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠছে, দেখে তার আকাশ জুড়ে টেলিভিশনের রঙিন রঙ, দেখে এই শরীরটা শরীর নয়, কে যেন বানিয়ে রেখেছে। কে যেন তার শরীরে কিক করছে, আর সে হাঁটছে, দৌঁড়ুচ্ছে, কথা বলছে-কোন এক কম্পিউটার গেইমের সে যেন ব্যর্থ এক নায়িকা, তাকে বসে থাকতে হয় কারও অপোয় যে সোমাকে নিয়ে খেলবে।


 


সোমারা সবাই মিলে আজ যে বন্ধুটির বাসায় বেড়াতে যাবে, সে বন্ধুটিকে হয়তবা সে ভালোবাসে, হয়তবা এই কারণেই অন্য অনেকের উচ্ছ্বাসের চাইতে তার উচ্ছ্বাসটাই এত বেশি যে তাকালেই মনে হয় কখনও কখনও কেন মানুষ সবকিছু ছেড়েছুড়ে শুধু প্রেমের দিকে ছুটে চলে। বন্ধুর বাড়ি যাওয়া উপলে সোমার বাসায় দু’জন বান্ধবী এসেছে, যাদেরকে দেখলে বোঝার উপায় নেই পৃথিবীর কোথাও আজ কিছু ঘটতে যাচ্ছে কি-না, যে ঘটনায় এতটা বিস্ময়, এতটা রহস্য আর এতটা সৌন্দর্য ভেসে উঠে, তা কেবল সোমার দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। কোনো এক বান্ধবী বলেই বসল, এমন করে যে এতে সন্দেহ আর মশকরা এক সাথে, কোনো দিক বা বিদিক না ছুটে সেই বাক্যবাণ সোমার মুখের ওপর এসে পড়ল। কি রে আজ এত সেজেছিস?


 


দীর্ঘদিনের লুকিয়ে রাখা কোনো সম্পদ হঠাৎ করে কারও দেখা ফেলা বা জেনে যাওয়ার ভয়ে অনেকটা ঘাবড়ে গেলে মানুষের মুখ যেমন কিছুণের জন্য অন্য রকম হয়ে যায়, সোমারও তেমন হয়েছিল, যদিও সোমার মত চুপচাপ, একটু আলাদা রকমের মেয়ের ক্ষেত্রে এরকম প্রেম জাতীয় কোনো একটা বিষয় সন্দেহ করতে হবে- এই ধারণা কারও ভেতর বিন্দুমাত্র ছিল না। যে বান্ধবী প্রশ্নটি করেছে, সে আসলে বোঝেনি, এমন একটা বিশ্বাস ভিতরে রেখেই সোমা বলল- না রে, এমনি, মাঝে মাঝে সাজতে হয়; সব সময় কি একরকম থাকতে ভালো লাগে?


 


তিন বান্ধবী মিলে যে বন্ধুটির বাসায় গিয়ে হাজির, সে বাসায় একাই থাকে, মানে ঢাকায় পড়াশোনা করে, মা-বাবা দেশের বাড়িতে, যা কেবল তার আবাসস্থলে গেলেই টের পাওয়া যায়। ছেলেটি যতটা ফিটফাট, সুন্দর, হ্যান্ডসাম ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই আবাসস্থল যেন জানান দিচ্ছে ঘরের প্রতি কোনো মায়া নেই তার। এই মায়াহীন ঘরে যখন এত মায়ার আলো এসে হাজির, তখন এর ভার বইবার মতা আবাসস্থলটির যে নেই তাই ণে ণে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল ছেলেটি কী করবে না করবে তার ব্যাকরণ পাঠ দেখে। সোমার সমস্ত সৌন্দর্য যতটা না এই ঘরকে আলোকিত করল তারচেয়ে বেশি বাতাসে প্রদীপশিখার নিভন্ত অবস্থাই বারবার উঁকি দিচ্ছিল এবং শেষমেশ তাই হল। বারান্দায় এসেই সোমা চিৎকার দিয়ে উঠল মাকড়সা বলে, এত জোরে চিৎকার দিল যে আসলে কী হয়েছে এটা বোঝার আগেই কেউ কেউ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। আর প্রকৃত ঘটনা যখন সবাই জানল তখন কেউই মুখে হাসি লুকিয়ে রাখতে পারছিল না। কেউ কেউ সোমার মাকড়সাকে এত ভয় কেন এরকম হাজারো প্রশ্নে সমস্ত লজ্জা, বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল সোমার, যেন এই মুহূর্তে এই ঘরটি থেকে বের হলেই সে হারিয়ে যাওয়া প্রাণটিকে ফিরে পাবে।


 


দূর থেকে দেখলে মনে হবে অনেকগুলো অন্ধকারের দলা, তার মাঝে জোনাক পোকার মত ক্ষীণ কিছু বাল্বের আলোর ভেতর দিয়ে তিন বান্ধবী হেঁটে হেঁটে রিকশা ঠিক করল। সোমার মুখে কথা নেই, এতটা নিশ্চুপ যেন টের পাওয়া যাচ্ছে ভেতরে জগতের সমস্ত কান্না যেন এখনই বৃষ্টির মত ছড়িয়ে পড়বে।


 


গতকালের ঘটনার ভূতটাকে মাথায় নিয়ে, কী হতে পারে আজ কলেজে, কে কী বলতে পারে এমন কিছু ভাবতে ভাবতেই কলেজে ঢুকল সোমা। কাসরুমে ঢুকেই সবার মুখের হাসা-হাসি দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে তার দুই বান্ধবীর আজ আলাপের বিষয় ছিল সোমা।


 


কারও সাথেই আজ সে কথায় জড়াতে পারছিল না, পাছে মাকড়সার গল্পটা না সবাই জানতে চায় তার মুখ থেকে। একবার সে পুরো কাসরুমে তাকাল, যে বন্ধুটির বাসায় গতকাল বেড়াতে গিয়েছিল সে বন্ধুটি এসেছে কি-না দেখার জন্য। কাস শেষে বন্ধুটির কাছে মাও চাইল সে, যেন মাকড়সাই তার প্রেমের বাধা হয়ে উঠছে ক্রমাগত। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হল তার, নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হল, বিরক্তিকর হয়ে উঠল যেন তার সমস্ত পৃথিবী। অথচ তার এমন হওয়ার কথা নয়, বিশেষ করে সদা লাস্যময়ী সোমার জন্য তো এটা একেবারেই মানায় না। দীর্ঘ কান্ত অর্থহীন এক দুপুরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোমা।


 


যে মাকড়সা তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিল, এতটা নিঃসঙ্গ, এতটা অপাংক্তেয় সেই মাকড়সাকেই এবার যেন দেখে নেবার পালা সোমার। কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিল, পড়াশোনাও ভালো লাগছিল না তার, এর বদলে সে কিনতে শুরু কলল মাকড়সার আচরণবিদ্যা আর মনোবিজ্ঞানের বই।


 


সোমা ভাবে, রবার্ট ব্রুসকে নাকি যুদ্ধ করার প্রেরণা জুগিয়েছিল মাকড়সা, যে মাকড়সার ভয়ে আজ তার এই অবস্থা সেই মাকড়সা কীভাবে যুদ্ধ জয়ের প্রেরণা জোগায়। এই ভয়ঙ্কর, উদ্ভট একটা কীট ছাড়া রবার্ট ব্রুস কি আর কোনো পোকা খুঁজে পেল না এই রকম দম বন্ধ করা একটা জীবনে সোমা এতটাই অস্থির হয়ে পড়ে যে সে এখন চোখটাও বন্ধ করতে পারে না, চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে উদ্ভট সেই কীটটির চেহারা।


 


ভয় তাড়ানোর জন্য সোমা মাকড়সার আচরণবিদ্যা পড়ে আর ভাবে, অসামাজিক হিসেবে বিশেষ দুর্নাম আছে মাকড়সার, এমন দুর্নামের কারণ হলো, এরা একা একাই থাকে, একাই চলাফেরা করে, একাই খাবার সংগ্রহ করে ও একাই খায় এবং মূলত একাই জীবন কাটায়। সোমা আরও আঁতকে উঠে এই ভেবে যে, এই একা থাকার এই অস্বাভাবিক জীবনের প্রতীক তো সেও।


 


তবে ১৪ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে বসবাসকারী মাকড়সার গড় আয়ু মাত্র এক বছর জেনে সে আবার আশ্চর্যও হয় বটে, এত কম বয়সী একটি কীট অথচ তার ভয়ের বিষয়।


 


তবে একটি জায়গায় এসে সে কেন যেন মাকড়সার জীবনকে মেনে নিতে পারে না, তার অস্থিরতা বেড়ে যায়, কিছুটা মায়াও তৈরি হয় এই মাকড়সার প্রতি, তা হল মাকড়সা যখন গর্ভবতী হয়, তখন গাছের খোল অথবা পাথরের ফোকরের মধ্যে স্থান গ্রহণ করে এবং পেট থেকে ডিম বের হওয়া থেকে নিয়ে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সে বসে থাকে এবং বাচ্চারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই তারা মাকে খাওয়া শুরু করে দেয় এবং শক্তিশালী হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।


সোমার মনে হয় এই কীটটির প্রতি তার মায়া না হয়ে ভয় কেন হচ্ছে, তার একবার মনে হয় এই ভয়টা তার এক ধরনের ফোবিয়া, আবার মনে হয় ফোবিয়া হতে যাবে কেন; সে ভেতরে ভেতরে সাহস বাড়াতে থাকে।


 


সমস্ত লজ্জা, সমস্ত ভয়, সমস্ত একাকিত্ব ভেঙ্গে একদিন সে সিদ্ধান্ত নেয় এই মাকড়সার কাছে সে যাবেই, ভয়টা তার ভাঙ্গাতেই হবে। তাদের বাড়ির বাগানে সে মাকড়সার জাল খুঁজে বের করে কিছুটা দূরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যাতে করে মাকড়সা লাফ দিয়ে তার কাছে আসতে না পারে। ধীরে ধীরে সে কাছে আসে আর মাকড়সার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোনো অসতর্কতায় কোনো বিপদই না হয়। আরও কাছে এসে সে জালকে স্পর্শ করে, জালটা তার হাতে জড়িয়ে যায় আর মাকড়সা দূরে পালাতে শুরু করে। তার মুখে তখন বিজয়ের হাসি যেন এই মুহূর্তে তার সেই বন্ধুটির মুখ, দিগন্তবিদারী আকাশ আর একটা অদ্ভূত হাওয়া একসাথে খেলা শুরু করে তার সাথে। এই বিকেলটা কেমন সংগীতের মত বেজে উঠে, গুনগুন করে তারও কণ্ঠে বাজে গান, যেন আর কোনো ভয় নেই, আর কোনো বাধা নেই, জীবনের একটা ণ কী করে এত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে এক মুহূর্তে তাকে তখন না দেখা গেলে বোঝাই যেত না।


 


সোমার আনন্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এতটা যে এই কথা কাউকে না বলতে পারা পর্যন্ত তার আনন্দ যেন পূর্ণতা পাচ্ছে না। রাতে সে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমুতে যায় আর ভাবতে থাকে কাল সবাইকে দেখাবে মাকড়সাকে দেখে সে ভয় পায় না। সে পরিকল্পনা করে মনে মনে যে প্রথম এই সংবাদটি দেবে তার বন্ধুটিকে উপহার হিসেবে, তারপর তার সেই দুই বান্ধবীকে, যারা সমস্ত কলেজ তার মাকড়সা ভয়ের কথা বলে বেড়িয়েছে, তারপর তাদের সামনেও কোনো একটা মাকড়সাকে হাতে নিয়ে আদর করবে আর বোঝাবে এই মাকড়সাটির প্রতি আসলে আমাদের মায়া করা উচিত, এরা মাত্র ১ বছর বাঁচে। এসব ভাবতে ভাবতে সোমা কখন ঘুমিয়ে পড়ে একটা দীর্ঘ দিনের ভয়কে দূর করতে পারা জয়ের হাসি মুখ নিয়ে তা সে নিজেই জানে না। রাত তিনটা বা চারটার দিকে ভোর রাত সে সময় হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠে আবার মাকড়সা বলে। ভয়ে তার গা কাঁপতে থাকে আর কঁকিয়ে উঠতে থাকে, সে অন্ধকারে তাকালেই তার মনে হয় এই বুঝি এখানেই কোথাও ওঁত পেতে আছে একটি মাকড়সা। কেননা স্বপ্নে সে দেখেছিল, মাকড়সার বাচ্চারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই তারা মাকে খাওয়া শুরু করে এবং শক্তিশালী হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।


 


 


চা বাগান


 


 


নিয়তি বলে কোন কিছু কি আসলেই নেই- ভাগ্য-অদৃষ্ট-নসিব বলে আসলেই কি কিছু নেই, তাহলে আমরা যা চাই তা করতে পারি না কেন, আমরা যা স্বপ্ন দেখি তা পাই না কেন, আমাদের কেন কেবলই মনে হয় আমরা নিয়ন্ত্রিত- আমাদের চোখের সামনে তাহলে কেন এসে দাঁড়ায় কোন না কোন নিয়ন্ত্রণ কর্তা। আমাদের ইচ্ছেমত কিছু হয় না -আমাদের ইচ্ছেমত আমরা কাউকে ভালবাসতে পারি না- কথা বলতে পারি না- হাসতে পারি না- কোন এক নিয়ন্ত্রণকর্তা যার বাগানে আমরা কাজ করি সেই আমাদের নিয়তি- সেই আমাদের ভাগ্য-অদৃষ্ট-নসিব।


 


এই যে নিপুণ হাতে ছেঁটে রাখা চা গাছগুলো, যে কাউকে স্বীকার করতে হবে এসব কোনো মহৎ, সৎ শিল্পীর কাজ; এসব ভালো মানুষের ভালোবেসে করা কোনো কাজ। উঁচু উঁচু টিলা ধরে এত সবুজ আর সবুজ, মনে হয় একটি সবুজের দীর্ঘ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে কত শত পাহাড়-টিলা, যেন হাজার হাজার বছরের দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে ঢেকে রেখেছে এই সবুজের শিল্প, যেভাবে কবি সমস্ত কষ্টকে পুড়িয়ে গড়ে তোলেন কবিতা।


এই যে সুভাষ আর ফুলমতি, ওদের দেখে কি মনে হয় ব্রিটিশদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় চা শ্রমিকরা প্রায় ৯০ বছর আগে মুল্লুকে চলো বা বাড়িতে চলো আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল, ওদের দেখলে কি মনে হয় ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনী বন্দুকের নল চেপে ধরেছিল সেই আন্দোলনকে, চাঁদপুর জাহাজঘাটে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়েছিল শত শত চা শ্রমিককে।


সুভাষ আর ফুলমতিকে দেখলে মনে হয় ওরা শুধু মাথা নুইয়ে কাজ করতে জানে, কষ্টগুলো দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে জানে চা বাগান, প্রলম্বিত সবুজের কারুকাজকে। হয়ত এই কারণে যে, ও জানে শত চেষ্টা করেও একজন শ্রমিক সারা দিন কাজ করে ৫০ টাকার বেশি পাবে না, হয়ত এই কারণেই যে সে জানে তিন বেলা খাওয়া জোগাড় করতে পারে না, হয়ত এই কারণেই যে সে জানে ব্রিটিশরা এলো, পাকিস্তানিরা এলো, আবার চলেও গেল। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো কিন্তু তাদের জীবন তেমনই রয়ে গেল।


ভাবছিলাম কত শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন ওদের আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে, ভাবছিলাম ফুলমতির কথাও। ফুলমতিও জানে চা বাগানে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবের আগের দিনেও কাজ করতে হয়, কাগজে-কলমে হয়তবা গর্ভকালীন ছুটি ছ’সপ্তাহ মঞ্জুর আছে, তা তারা কাজের চাপে ভোগ করতে পারে কি-না কে জানে, আরও ভাবছিলাম এই কারণে যে ফুলমতি নামের যে মেয়েটিকে এখন আমি দেখছি সে গর্ভবতী।


 


তবে বেশ কিছু দৃশ্য আজও আমার স্মৃতিতে শিউরে উঠে, সেসব দৃশ্য মনে পড়লে নিজেকেও কেমন বন্দি বন্দি মনে হয়। লম্বা লাঠি হাতে সরদাররা একেকটি শ্রমিক লাইনে ঘুরে ঘুরে সুর করে হাঁকেন, এর ঠিক কিছুণের মধ্যেই দেখা যায় সারিবদ্ধভাবে চা বাগানের নারী-শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য লাইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আমার সেই দাসযুগের কথা মনে পড়ে, মনে হয় ওদের হাতে-পায়ে যেন বেড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাজে।


এরা সকাল ৯টায় বের হয়ে চা বাগানে নির্ধারিত সেকশনে যায়, রোদ-বৃষ্টি-খরা মাথায় নিয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চা পাতা তুলে, মাঝে যতটুকু সময় পায় তা শুধু খাবার খাওয়ার জন্য। এ সময় এরা গাছের ছায়ায় বসে শুকনো রুটি অথবা কচি চা পাতা দিয়ে বানানো খাবার অথবা চিড়া খেয়ে নিয়ে আবার কাজে যায়। সারাদিনের পাতা তোলার পর চা পাতাগুলোর মাপ শেষে পাতিঘরে পাতা জমা দিয়ে তবে বাড়ি ফেরে।


 


 


মাঝারি উচ্চতার, কালো কিন্তু অসম্ভব সুন্দর মুখাবয়বের অধিকারী সুভাষ, যাকে বলা যায় সুপুরুষ, এই বাইশ বছরের যুবকটিই এক বছর আগে বিয়ে করেছিল ফুলমতিকে। ওদের শরীর থেকে এখনও যায়নি ভালোবাসার গন্ধ, দাম্পত্য সুখের রঙ যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওদের সমস্ত শরীর জুড়ে। অথবা এই রং, এই গন্ধ কি কখনও হারিয়ে যায়? যায় হয়তবা। সুভাষ ভাবছিল খুব বেশি দিন হয়নি ওদের বিয়ের। এই এক বছরেই কত কিছু হয়ে গেল। মা-বাপ মরা ছেলেটি যে মাকে পেয়েছিল মানে ফুলমতির মাকে, সে মা-ও মারা গেল মাস তিনেক আগে। তার স্পষ্ট মনে পড়ে মা তাকে মরার আগে বলেছিল এই ফুলমতিকে দেখে রাখিস বাবা। ও খুব ভাল মেয়ে। এরপর থেকে সুভাষের দায়িত্ব যেন আগের চাইতে আরও বেশি বেড়ে গেল, এত বেশি সতর্ক হয়ে গেল যে নিজে দুঃখ-কষ্ট পাই পাব কিন্তু ফুলমতিকে কোনো কষ্ট দেওয়া যাবে না।


 


আর ফুলমতির কাছে সুভাষ যেন শুধু স্বামী নন, সাক্ষাৎ দেবতা, এই পতিদেবতার কাছে যেন কোনো কিছু আবদার করতে নেই, নিজের দুঃখ-কষ্ট বলতে নেই, কেবল স্বামীর সেবা করে যাওয়া। সুভাষও জানে, সে এমন একজনকে ঘরের লক্ষ্মী পেয়েছে যার জন্য সবকিছুই স্বামী হিসেবে করা উচিত। কিন্তু অভাব এমন এক জিনিস যে প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি কোনো কিছুই মানে না, কোনো কিছুই তার সামনে দাঁড়াতে পারে না, সমুদ্রের মত হাঁ করে থাকে, সবকিছু খেয়ে ফেলতে চায়, আপাদমস্তক। সুভাষও তাই অভাবকে নিয়তি হিসেবে মানতে নারাজ, আবার অভাবের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসবে তাও নয়, যেন একটু সময় নিয়ে অল্প অল্প করে বুঝেশুনে এগুতে হবে- তাড়াতে হবে অভাব। শুধু অভাবের বিরুদ্ধ তার লড়াইয়ের ধরন এমন তা কিন্তু নয়, সবেেত্রই সে ঠাণ্ডা সুস্থির স্বভাবে কাজ করে এগুতে চায়। তাই গর্ভবতী বউকে নিয়ে তার যে ভাবনা, ছুটি চাওয়ার হিসাব-নিকাশ সেটাও সে করে রেখেছে নিখুঁতভাবে, যদিও জানে না ছুটি আদৌ পাওয়া হবে কি-না।


 


দিন যতই যায় ততই ফুলমতির প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে, সুভাষেরও স্থির সিদ্ধান্তে আসার সময় আসতে থাকে সে কাকে কখন কীভাবে বলবে ছুটির কথা। কেননা এই ছুটি চাওয়ার সাহস কোনো চা শ্রমিকই করতে চায় না- কখনও কখনও এমন হয় যে ছুটি চাইতে গেলে বলে দেওয়া হয় কাল থেকে চা বাগানে আর না আসতে, কখনও কখনও নয়, যারা ছুটি চেয়েছে তাদের অনেকেরই এমন কিছু হয়েছে। কাজেই সুভাষের এমন কিছু করা যাবে না যাতে তাদের চাকরি যায়, বা এমনভাবে ছুটি চাইতে হবে যেন চাকরিটাও থাকে, ছুটিটাও পাওয়া যায়। সুভাষ ভাবে, এর আগে যারা ছুটি চেয়েছে সবাই সরদারকে অনুরোধ করেছে। সুভাষের ধারণা সরদারকে নয়, ম্যানেজার স্যারের কাছে ছুটি চাইলে সে কখনও না করবে না, সুভাষ অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তই স্থির করে যে সে ম্যানেজার স্যারের কাছেই ছুটি চাইবে আর পরিকল্পনা করতে থাকে কীভাবে, কখন ম্যানেজার স্যারের কাছে ছুটিটা চাওয়া যায়।


 


এরই মাঝে একদিন ফুলমতি সুভাষের সাথে আলাপ করছিল যে তার কাকীরা তাকে বলেছে চা বাগানে বাচ্চা প্রসব করলে নাকি মরা বাচ্চা হয়। তার কাকীরা এরকম এক ঘটনার প্রত্যদর্শীও বটে। ফুলমতি যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন সুভাষও টের পেয়েছিল তারা কথার ভেতরে কোথায় যেন একটা ভয়, একটা হতাশা, একটা কান্না শিউরে উঠছিল।


সুভাষ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে কালই ম্যানেজার স্যারের বাসায় যাবে এবং যেভাবেই হোক ছুটি তাকে নিতেই হবে। সুভাষ ভাবে, ম্যানেজার স্যারের বাড়িতে হয়ত তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না, কিন্তু খুব ভোরে সে বাগানে হাঁটতে বের হয় সেই সময়টাই তার জন্য ছুটি চাওয়ার মোম সময়।


 


ফুলমতি কি জানে না তার বাচ্চার জন্য ছুটি কেন, চাকরিও যদি চলে যায় তাতে তার কিছু যায় আসে না, তার বাচ্চা, তার শিশু সন্তান পৃথিবীর যাবতীয় সুখ-দুঃখের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু সেও পারে না এমন সিদ্ধান্ত নিতে যে সিদ্ধান্তে হয়ত তাদের না খেয়ে থাকতে হবে, হয়ত তাদের ভিটেহারা হতে হবে, হয়ত তাদের সামনে তখন শুধু খোলা আকাশ আকাশের নিচে দিন কাটানোই হবে ভবিষ্যৎ। তাই সে আবার এগুতেও চায় না, ভাবতেও চায় না বা অভাব এমন এক সমুদ্র যা শুধু গ্রাস করতেই জানে, কিছু দিতে জানে না, এ কথা ফুলমতিও জানে।


 


এক একটা দিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে দেয় ফুলমতি, এক একটা দিন চাপা কান্না, আর পেটের ভেতরের বাচ্চার কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় দিন। দিন যে যায়, আসে এই পৃথিবীতে কোনো কিছু যায় না, বরং আসে। কেউ তার জন্য প্রস্তুত থাকে, আবার কেউ তার জন্য প্রস্তুত থাকে না। ফুলমতিরও দিন আসছে, এতটা ফুটফুটে বাচ্চা, ঘর-সংসার আলো করে দিয়ে একটি দিন হেসে উঠবে ঠিকই তাদের জন্য। তাই ফুলমতি চা বাগানে যায়, আস্তে ধীরে কাজ করে, আর সতর্ক থাকে, মনে মনে ভাবতে থাকে যদি প্রচণ্ড প্রসব ব্যথা উঠে সে দৌড়ে চলে আসবে ঘরে, তারপরও বাগানে প্রসব নয়। কিন্তু এই কথা তার মাথায় আসে না প্রচণ্ড প্রসব ব্যথা উঠলে সে দৌড়াবে কীভাবে। সে হয়ত কয়েকজনকে বলেও রাখে তাকে যেন বাচ্চা প্রসবের ব্যথা উঠলে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, সে এও বলে রাখে যে এই গল্প তো সবার জানা চা বাগানে বাচ্চা প্রসব করলে বাচ্চা মৃত হয়। ফুলমতি চায় না সে মৃত বাচ্চা প্রসব করুক, ফুলমতি কেন কোনো মা-ই চান না যে মৃত বাচ্চা প্রসব করতে। কোনো মা-বোনই চান না কারো মৃত বাচ্চা হোক।


 


ফুলমতি কখনও কাজ করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর তখন একটু কান্তি, একটু অবসাদের দৃষ্টিতে এই সবুজ পাহাড়, এই থরে থরে সাজানো সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, তোরাও কি আমার সন্তান না, কত যত্ন, কত কষ্ট, কত স্নেহ, কত প্রেম দিয়ে এই যে তোদের বড় করে তুলি তোরা কেন তোদের ভাইকে এই অভিশাপ দিবি। ফুলমতি কিছুতেই মানতে পারে না এই অভিশাপ, এই পাহাড়ের এই অভিশাপ এই সবুজের, এই অভিশাপ এই সন্তানের মত করে ধীরে ধীরে বড় করে তোলা চা বাগানের কিংবা ফুলমতি হয়ত জানে না এই পাহাড় এভাবে থাকতে চায়নি, চেয়েছিল হেলেদুলে, নেচে-গেয়ে তার সমস্ত শরীর ফুটিয়ে তুলবে জংলি ফুল, ফুলমতি হয়ত জানে না এই সবুজ চা বাগানে এভাবে থাকতে চায়নি, সে চেয়েছিল যে তাকে ভালোবাসে তারাই যেন পায় তার আশীর্বাদ, অথবা ফুলমতি হয়ত জানে না সে যে কাজ করছে এটাও সে করতে চায় না, তাকে দিয়ে অন্যায়ভাবে করানো হচ্ছে, যে ভালোবাসার ভাগ তার পাওয়া দরকার তাকে এই চা বাগানের মালিক কখনও তা দেয় না।


 


সুভাষ খুব ভোরে উঠে চলে এলো চা বাগানের এমন এক পথে যেখানে ম্যানেজার স্যার মর্নিং ওয়াক করেন। চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে থাকল যেন কোনোভাবেই ম্যানেজার স্যার তার চোখ এড়িয়ে না যেতে পারেন। এক ঘণ্টা হয়ে গেল ম্যানেজার স্যারের আসার নাম নেই, দুই ঘণ্টা হল, সুভাষের সন্দেহ হল হয়ত তার এই পথে আসার আগেই ম্যানেজার স্যার রাস্তা ধরে চলে গেছেন। কিন্তু ফেরত পথে তো আসবেন আটটা বেজে গেল তারপরও উনি বাড়ি ফিরছেন না, নয়টা বেজে গেল তারপরও উনি বাড়ি ফিরছেন না, দশটা বেজে গেল তারপরও উনি বাড়ি ফিরছেন না। এদিকে খুব ভোরে না খেয়ে বেরুনোয় প্রচণ্ড খিদে লেগে গেল তার, কিন্তু আজ যে তাকে দেখা করতেই হবে, ছুটি তাকে নিতেই হবে। ম্যানেজার স্যার গতকালই ঢাকা থেকে ফিরেছেন, হয়ত আজই হিসাব-নিকাশ দেখে চলে যাবেন।


সুভাষ সাহস করে ম্যানেজার বাবুর বাগান বাড়ির দিকে এগুতে লাগল। গেটের সামনে আসতেই এক দারোয়ান তাকে জিজ্ঞেস করল কার কাছে সে এসেছে। সুভাষ বলল ম্যানেজার স্যারের কাছে। দারোয়ান জানাল ম্যানেজার স্যার গতকালই ঢাকা চলে গেছেন। সুভাষের মাথায় যেন বাজ পড়ল। কী করবে ভাবতে ভাবতে দেখল শেষ ভরসা চা বাগানের সরদার, তাকে হাতে-পায়ে ধরে হলেও ছুটি নিতেই হবে। নিজের ছেলের চাইতে কি মান-সম্মান, লাজ-লজ্জা বড়? সে বুদ্ধি আঁটল ছুটি না দেওয়া পর্যন্ত সে সরদারের পা ধরে বসে থাকবে।


 


সকালে উঠে আজ স্বামীকে না দেখতে পেয়ে, তাকে না জানিয়ে সে কোথায় চলে যেতে পারে এরকম ভাবতে ভাবতে সরদারের বাঁশি ফুঁ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগানের কাজে যেতে বাধ্য হল ফুলমতি। কী যেন একটা হয়েছে কোথাও। আবহাওয়াটাও কেমন খারাপ মনে হচ্ছে তার, অন্যদিনের মত নয়, অন্যদিনের চেয়ে আজ যেন একটু বেশি গরম, বা রোদের তীব্রতা যেন আজ একটু বেশিই বোধ হয় তার। অন্যদিন এত ঘামে না ফুলমতি, আজ যেন একটু বেশিই ঘামছে, ফুলমতির কি তাহলে শরীর খারাপ। ফুলমতি একবার সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত কোমরে চেপে দৃষ্টিটা দিগন্তের দিকে নেবার চেষ্টা করে। এরপর আবার কাজ। হঠাৎ ফুলমতি বসে পড়ে, ব্যথাটা ক্রমশই বাড়ছে বলে মনে হয়, ফুলমতি বুঝতে পারে এটা প্রসবেরই ব্যথা, এবং এটাও বুঝতে পারে যে সে এখন চা বাগানে। তারপর সে একবার চা বাগানেই কাজ করে কাকীর দিকে তাকায়, কিছু একটা বলতে চেয়েছিল সম্ভবত সেই গল্পের ইঙ্গিতটা, চা বাগানে বাচ্চা প্রসব করলে মৃত বাচ্চা হয় কিন্তু বলতে পারেনি। ব্যথায় সমস্ত শরীর তার অবশ হয়ে পড়ে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখন তার চারপাশে চা বাগানের শ্রমিক মেয়েরা দাঁড়িয়ে, কাকী এসে ফুলমতির মুখটি কোলে নেয়, আরেক কাকীর কোলে তখন ফুটফুটে ছেলে-বাচ্চা।


 


ফুলমতির যখন জ্ঞান ফিরে, তখন দেখে সে তার ঘরের বিছানায়, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর একটি কুপি জ্বলছে, সে বাঁ হাত দিয়ে একবার বাম পাশে কিছু একটা আছে কি-না বোঝার চেষ্টা করে, তারপর ডান হাত নাড়াতেই টের পায় তার ফুটফুটে বাচ্চার অস্তিত্ব। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকে, তখন খুব দূরে একটা শেয়াল চিৎকার করছিল আর তার বাড়ির পাশের কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল। এর কিছুণ পর টের পেল তার বিছানার পাশেই একটি ভাঙা চেয়ারে বসে আছে সুভাষ।


 


 


 


 


মার্কসবাদ ও প্রেম


 


বালিকাকাণ্ড


 


মেয়েটির বাসায় ওর আপার অনেক বন্ধু-বান্ধব আসত, ওদের সব সময়ের খাওয়া-দাওয়া ছিল লাল চা আর পাশের দোকানের বিস্কুট। তারপরও তারা আসত। ওরা তার মাকে খুব পছন্দ করত। আপা না থাকলে ওরা ওর সাথেই আড্ডা দিত। বন্ধুরা ওকে পছন্দ করত খুব। ওদের বাসাটা ছিল নদীর তীরে । সেখানে ও সাঁতার শিখেছে। গামছা দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরেছে।


 


ও বলছিল, একদিন আপার এক বন্ধু আমাকে ওদের ক্যাম্পাসে বেড়াতে নিয়ে গেল। সেখানেই হঠাৎ আমাকে বলল সে আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আমি সে দিনই বুঝি আমি অনেক বড় হয়েছি। কী যে অবস্থা ছিল সেদিন। আমি তখন নবম কি দশমে এ পড়ি। ক্যাম্পাসের সবাই জেনে গেল আমাদের প্রেম। আমি বাসায় এসে আপাকে বলার পরই সে ক্ষেপে গেল। আপার বন্ধুরা ওকে হলে গিয়ে ধমক দিয়ে আসল। ওর আমাদের বাসায় আসা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ও বাম সংগঠনে যোগ দিল। একদিন বাসায় তাকে ডেকেও আনা হল। বলা হল, তোমাকে আমরা কত স্নেহ করতাম। আর তুমি এটা কী করলে। আসলে ওদের জায়গা থেকে এটা তো ঠিকই। এরপর শুনতাম এইদিন শিবির ওকে পেটাচ্ছে। সে কেমন হয়ে গেল। এর মধ্যে আমরা চিঠি লিখতাম। কী যে অবস্থা ছিল। আমি বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে সেসব চিঠি পড়তাম। একদিন আপা ধরেও ফেলল। কী যে করল সে দিন আমাকে। অথচ এই আপার শরীরের স্পর্শ ছাড়া, তার গায়ের সাথে গা না লাগানো ছাড়া আমি ঘুমাতে পারতাম না।


 


আপার চাকরি হয়ে গেল। আপা এতটাই মেধাবী ছিল যে সে সেখানে প্রথম ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়েই তার চাকরি হওয়ার কথা ছিল। একটা পলিটেকনিকে চাকরি হল। আপা চলে যাবে। আমার যে কী কান্না। তারপর আপার বিয়ে হল। ওদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছেলের সাথে। সেই বিয়েটি আমিই ঠিক করেছি। ওই ছেলে নাকি কে না পেয়ে কান্নাকাটি করত। ভাবলাম কাছের ছেলের সাথেই বিয়ে হওয়া ভালো। বিয়ে হল। বিয়ের পর এক সপ্তাহের মধ্যেই ওদের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হল। কী যে অবস্থা হল। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য জোর করা হল। সে সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দিল। ওরা ওকে খুবই নির্যাতন চালাত। এমনও হত না খেয়ে রাখত। আমাদের বাসার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। যা হোক এখন ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে। যদিও বাচ্চাটার ঠোঁট একটু কেমন যেন। কিন্তু এটা হওয়াতে ওদের ভালো হয়েছে। আমার মনে হয় নির্যাতনের কারণেই বাচ্চাটা এমন হয়েছে। সেলাই করলেই আস্তে আস্তে অবশ্য ঠিক হয়ে যাবে। যাই হোক এই কারণে এখন অবশ্য এদের সম্পর্কের গাঢ়ত্ব তৈরি হয়েছে।


 


কলেজে আমি কিছুই পড়িনি। পরীক্ষার দুই মাস আগে মা বাবার তোড়জোড়। ওরা শুধু কান্নাকাটি করত। আমার মেয়েটার কী হল। তখন তসলিমা নাসরিন পড়েছি। হুমায়ুন আজাদ পড়েছি। আমি তখন বাসায় একা। এসব পড়তে পড়তে আমার মনে হল আমাদের প্রেমে ধর্ম কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এক প্রকার জেদ করেই আমি পাড়ার সবচেয়ে নষ্ট ছেলেটির সঙ্গে আমি মেলামেশা শুরু করি। লোকজন যা বলে বলুক, আমি কাউকেই মানতাম না। একদিন ওদেরই একজন আমাকে ধর্ষণ করে। এরকম ঘটনাও ঘটেছে আমি টেবিলে বসে শুধু নিচের দিকে চেয়ে থেকেছি। শুধু নিচের দিকেই তাকিয়ে থেকেছি। এটা দেখে বাবা কেঁদে ফেলতেন। সে সময় তসলিমা-হুমায়ুন পড়ার কারণে বখাটেদের সাথে মিশতাম। পাড়ার ছেলেরা যারা টিজ করত তাদের সাথে মিশতাম। যাই হোক, রেজাল্ট দেওয়ার পর সবাই অবাক, আমি এ প্লাস পেয়েছি। কেউ বিশ্বাসই করেনি। এরপর ভার্সিটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম। যদিও কাস একটাও করেনি। এটা অবশ্য বাসায় জানে না। সে সময় একজনের প্রেমে পড়ি। ওর সাথেই সারাণ থাকতাম। সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম। মনে হত রিকশায় যখন ঘুরতাম ওর সাথেই শুধু ঘুরি। এক পর্যায়ে আমার বুয়েটে চান্স হয় না। ওর হয়ে যায়। ও আমাকে এভয়েড করতে থাকে। সে বলে যে তোমার সাথে আমার আর মেশা হবে না। ও ছিল হিন্দু। এর আগের যিনি তিনিও ছিলেন হিন্দু। এরপর আমাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান হল। মা-বাবার অনেক আশা। এটা আমাকে পূরণ করতে হবে। একটা পার্টিতে ঢুকেছি। মার্কসবাদী পার্টি। আমি এখানেই জীবন দিয়ে দেব। এর মধ্যে এক বড় ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে আমাকে একদিন ফোন করে। সে এক সময় পার্টি করত। এখন বিবাহিত। তার একটা মেয়ে আছে। সে একদিন আমাকে বলে এই ধরনের মেয়েরা সাধারণত ফ্রি সেক্সে বিশ্বাস করে। সে আমাকে অফার করে। আমি অবাক হয়ে যাই সে কীভাবে এটা বলতে পারল। সে বলে যে সে বিবাহিত জীবনে সুখী না। এরপর সে আমাকে ফোন করলে আমি তার ফোন ধরি না।


 


এই পার্টিতে এসে আমি আরেকজনের প্রেমে পড়ে যাই। সে অবশ্য অনেক বড়। আমাকে পাত্তা দেয় না। যে ছেলেটির সাথে আমার প্রথম প্রেম, তখনকার প্রেম। ইস এই যে দেখছেন হাতে দাগ, আমার মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে আমি কম্পাসের কাঁটা এখানে এই হাতে ঢুকিয়ে দিতাম। যে ছেলেটিকে ছোটবেলায় ভালোবাসতাম, সেই ছেলেটি এখন ফার্মগেটেই থাকে। সে এখন পিএইচডি করে। সে পার্টিতেই তার জীবন দিয়ে দিবে। আমিও পার্টিতেই জীবন দিয়ে দিব।


 


 


বালককাণ্ড


 


পৃথিবীতে কখনও কখনও কারও কারও জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যার জন্যে সে অপো করে না, কিন্তু ঘটে যায়; আবার কারও কারও জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যার জন্য সে অপো করে এবং ঘটেও আবার কিছু কিছু সময় এই দুই ঘটনাই একইসাথে এমনভাবে ঘটে, যার একটির জন্য সে অপো করে ছিল আরেকটির জন্য সে অপো করেনি। আমার জীবনে এই দুই ঘটনা এমনভাবে একই সাথে ঘটল যে মানুষ যে কেন কখনও কখনও তালগোল পাকিয়ে ফেলে, মানুষ যে কেন কখনও কখনও সত্যি অসহায় হয়ে পড়ে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম এবং অবশ্যই এটি একটি মেয়েকে নিয়ে।


 


আমি বুঝতে পারছিলাম না সে কেন আমার সঙ্গে প্রেম করতে চায়, আমি তাকে এও বলেছি আমি অন্য আট-দশজনের মত না যে হাজারজনের সঙ্গে প্রেম করব আর একজনকে বিয়ে করব-আমি এমন মানুষ নই। আবার এও ভাবছিলাম এত সব কাহিনী তার আমাকে শুনানোর মানে কী, সে যদি প্রেম করতেই চায় তাহলে এসব তো তার লুকানোর কথা ছিল। আমার ভেতরে ভেতরে ওকে নিয়ে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে, আবার ভয়ও লাগে এই ভেবে যে ও কি এমন কেউ যে আমাকে চেখে দেখতে চায়। একবার আমার মনে হয় হতেও পারে মার্কসবাদ, প্রগতিশীল, তসলিমা নাসরিন এরা তো সবাই ফ্রি সেক্সে বিশ্বাসী, অমূলক কিছু নয়। এছাড়া সে এও বলল আমার কোনো এক বড় ভাই তাকে সেক্সের অফার করেছে, একটা মানুষের মধ্যে নিশ্চয়ই সে এমন কিছু পেয়েছে যে কারণে সে এই অফার করেছে, সে নিশ্চয়ই যে কাউকে অফার করে না। কিন্তু ও এইসব বলার পর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে এত তোড়জোড় করছিল যে আমি বুঝে ফেলি ও আসলে ভালো মেয়ে নয়। আমি ভাবতে থাকি, এরকম একটি মেয়ের সঙ্গে আমি প্রেম করব, যে মেয়ে কলেজে থাকতে একবার ধর্ষিত হয়েছিল, যে মেয়ে ভার্সিটিতে এসে কয়েকজনের সঙ্গে শুয়েছে, ঘৃণায় নিজেই নিজেকে সামাল দিতে পারছিলাম না। আমার ভেতরে যে গোপন স্বপ্নগুলো ফুটে উঠছিল হেলেদুলে, যে বালিশের নিচে রেখে দিয়েছিলাম আমার গোপন স্বপ্ন, সেসব হঠাৎ করে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে উঠল যে আমার মনে হল বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমি। বোধহয় এইখনই সেই ডাইনি মেয়েটা আমার দিকে তেড়ে আসছে, বোধহয় সে আমাকে খেয়ে ফেলবে, তার মুখ আমার মনে পড়ছিল, তার হাসি আমার মনে পড়ছিল, এসবের মধ্যে আমার সেই স্বপ্নবালিকাটি নেই, যেন তার মুখ তার হাসি এক রাসীর। আর যখনই এসব মনে পড়ে বুঝতে পারি আমি যেন অসুস্থ এক মানুষ, আমাকে কে যেন আঁচড় দিয়েছে, যেন আমার সেই সহজ, সরল, স্বাভাবিক জীবনে কোথাও একটা আঘাত লেগেছে, এতটাই জোরে আঘাত যে সেদিন হঠাৎ রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে মরতেই বসছিলাম, যা আমার জীবনে এই প্রথম স্পষ্টত মনে করিয়ে দিচ্ছে এতটা অসচেতন আমি কখনোই ছিলাম না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এই ডাইনি, রাুসী মেয়েটি আমাকে অবচেতনেও খেয়ে ফেলছে, আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে, পিষে খাওয়ার জন্যে অপো করছে। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে কোনোভাবেই হোক ওর থেকে আমাকে দূরে থাকতে হবে, ও যেন কখনই আমার কাছে না আসে সেরকম কিছু একটা করতে হবে, ও যেন কখনই আমার চোখের সামনে না পড়ে সেরকম কিছু একটা করতে হবে। আমি ওকে মোবাইল করা বন্ধ করে দেই, ও ফোন করলে আমি ব্যস্ত বলে মোবাইল বন্ধ করে দেই, ও কোথাও আসতে বললে আমি সেখানে যেতে পারব না বলে জানিয়ে দেই। যেন ও বুঝতে পারে ওকে চাচ্ছি না, যেন ও বুঝতে পারে আমি ওকে ঘৃণা করছি, যেন ও বুঝতে পারে আমি তার জন্য নই। এইভাবে প্রায় একমাস আমি স্বাভাবিক হতে থাকি আর ওর মোবাইল করা, কোথাও যেতে বলা, দেখা করতে বলা বন্ধ হতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসি, আমি সত্যিই ভুলে যেতে পেরেছি তাকে, আর সেও বুঝে সরে যেতে পেরেছে।


 


এর বেশ কিছুদিন পর আমি রাস্তার আইল্যান্ডে বসেছিলাম, তখন হঠাৎ ওকে দেখতে পাই এমনভাবে যে প্রথমে মনে হচ্ছিল সুমি না, আমি আবারও তাকাই, কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি আবারও তাকাই হ্যাঁ, ও সেই সুমিই, অবিকল সুমির মত দেখতে, মানে সুমিই একটি ছেলের হাত ধরে নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছে, যেন একটি স্বপ্ন হাতে নিয়ে হাঁটছে, যেন এই স্বপ্নটির হাত ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে কোথাও, তাই অনেক দৃঢ় করে ধরে রেখেছে হাত, যেন এই হাতটির মধ্যেই তার সকল নিরাপত্তা, সকল প্রেম, সকল আবেগ, সকল দ্রোহ, সকল কিছু লুকিয়ে আছে।


 


আমার ভেতরে কোথা থেকে যেন কান্নার বুদবুদ উঠতে থাকে, যেন রক্তের ভেতরে ফিনকি দিয়ে উঠতে থাকে কান্নার জল, যে মেয়েটিকে আমি ডাইনি ভেবেছিলাম, যে মেয়েটিকে আমি রাসী ভেবেছিলাম, যে মেয়েটিকে আমার জীবন থেকে যে কোনোভাবে মুছে ফেলতে পারলেই আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠব ভেবেছিলাম, সেই মেয়েটিকেই, সেই ডাইনিকেই- সেই রাসীটিকেই এতদিন পর হঠাৎ কারও হাত ধরে হাঁটা দেখে এভাবে কান্নার ফোয়ারা উঠল কেন বুঝতে পারছিলাম না। কেবল কেউ এই কান্না দেখে ফেলবে, কেবল হু-হু করে কেঁদে ফেলার ভয়ে, এই সকল মানুষের মধ্যে, সকল ভিড়ের মধ্যে আর মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে এই ভেবে আমি যেন পালাতে চাইলাম, কচ্ছপের মত আমি যেন লুকিয়ে ফেলতে চাইলাম মুখ, আমি যেন দৌড়ে পালাতে চাইলাম এই মানুষের ভিড় থেকে- আমার নিজেকে প্রচণ্ড একা মনে হতে লাগল, নিজেকে দূর থেকে দেখা একা একটি গাছের মত নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরর্থক, পৃথিবীর সবচেয়ে অসিদ্ধ মানুষ মনে হতে লাগল। তাহলে কি এই রাসীই আমার প্রেমিকা যাকে দেখে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে কি এই ডাইনিকেই আমি চাই যাকে দেখে অস্বাভাবিক হয়ে উঠি, তাহলে কি সেই আমার প্রেমিকা যাকে ভালোবাসা মানে আমার মৃত্যু।


 


এর অনেকদিন পর আমি জানতে পারি ও আমাকে তাকে নিয়ে যা যা বলেছিল সবই তার বানানো, ওর যেসব বন্ধুর কাছ থেকে ওর সম্পর্কে শুনেছি সবাই আসলে ধারণা থেকেই কথাগুলো বলেছিল। আর যখন আমি এসব জানতে পারি তখন আমি সদ্য বিবাহিত এক যুবক আর শুনেছি সে এখনও বিয়ে করেনি।


 


 


 


 


ভাদরকাটানি


 


বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে আসলে পার্থক্যটা কি, কেউ কিছু বিশ্বাস করে মানে এটা আছে- এটা সত্য, কেউ কিছু বিশ্বাস করে না মানে এটা নেই, এটা অসত্য। কিন্তু যে জিনিস প্রমাণ করা যায় না, তাকে নিয়ে কেউ যদি বলেন আমি বিশ্বাস করি এটা সত্য আর আরেকজন যদি বলেন আমি বিশ্বাস করি না এটা অসত্য তখন আমরা কি করব। এরকম প্রমাণঅযোগ্য কোনো ঘটনা নিয়ে আমরা কতটুকু বচসায় যেতে পারি, এরকম ভাবতে ভাবতে পঞ্চগড়ের খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।


 


এখানে মাঠের পর মাঠ, দিগন্তের পর দিগন্ত, সবুজের পর সবুজ আর তার সাথে আকাশ এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে পঞ্চগড়ের যে কোনো গ্রামের দিকে তাকালে মনে হয় এখানকার মানুষগুলো যেন আকাশ দূর থেকে এতদিন যে সহজ, সরল রঙিন কাল বাহারি রকমের মেজাজ দেখে এসেছি এসব মানুষের সামনে দাঁড়ালে যেন মনে হবে সেই তারই হুবহু এক ছবি। আর তাই প্রকৃতির ছক বাঁধা স্বভাবের বাইরে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠে, তাকে চেনাটা একপ্রকার মুশকিল হয়েই পড়ে। যদিও অন্য সব অঞ্চলের মতই এখানে যেমন কান্না, বেদনা, ত রয়েছে; তেমনি রয়েছে হাসি, উচ্ছ্বাস, উৎসব। ভাদরকাটানি নামের একটি উৎসবের কথা এ অঞ্চলে বেশ বিশ্বাসের সাথেই পালন করা হয় বলে শুনেছি, যে উৎসব সেখানকার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বেশ বিশ্বাসের সাথে পালন করে, যে উৎসবে নববধূকে ভাদ্র মাস শুরুর আগেই স্বামী-শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। উৎসব উপলে কোনো নববধূ তিন দিন, কেউ সাত দিন, আবার কেউ কেউ পুরো মাসটাই থেকে যান বাবার বাড়িতে। তবে অধিকাংশ নববধূই ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন বা সাত দিন কাটিয়ে ফিরে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। আর এ সময় নববধূরা স্বামীর মুখ দেখতে পারবেন না বা দেখতে দেওয়া হবে না! দেখা-সাক্ষাৎ হলে তাদের স্বামীরা অন্ধ হয়ে যেতে পারেন, সংসারের অমঙ্গল হবে, নয়তো অপঘাতে স্বামীর মৃত্যু হতে পারে! আমার কাছে যদিও এটি কুসংস্কার বা অপবিশ্বাস কিন্তু লক্ষ্মীর কাছে এটি একেবারেই বিশ্বাস, যে বিশ্বাস একটুও এদিক সেদিক নড়তে পারবে না। পাখ-পাখালির যেমন ছিমছাম একটা সংসার থাকে, সুখ থাকে, মনের আনন্দে গান গাওয়া থাকে, ওদের ঘরটিকে দেখলেও যে কারও তাই মনে হবে, মনে হবে এমন সংসারটিই যেন সবাই মনের ভেতর পুষে রাখে কিন্তু হয় না। লক্ষ্মী সেই সকালে উঠে, রান্না করে, স্বামীকে ডাকে, নাস্তা খাওয়ায় তারপর স্বামী কাজে চলে যায়। লক্ষ্মী সারাদিন ধরে এটা করে, সেটা করে, সংসার নামক রাজ্যে যে কত কাজ থাকতে পারে তা একদিন লক্ষ্মীকে না দেখলে টের পাওয়া মুশকিল। রাতে স্বামী ঘরে ফিরে, ভাতটাত খেয়ে ঘুম, আবার সকাল- এভাবেই কাটছিল ওদের জীবন।


 


এই সংসারটিকেই একবার দেখতে আসেন লক্ষ্মীর মা, যেন পরীক্ষা নিতে এসেছেন উনি, পরখ করে দেখতে এসেছেন তার মেয়ে, মেয়ের জামাই কি আদৌ পারবে এই কঠিন রূঢ়, জঞ্জালময়, কণ্টকময় একটি সংসার জগৎকে সুখী করে তুলতে। এমনিতেই মা আর কতটা ধর্ম-কর্ম করে, মনে হবে এই বয়সেই লক্ষ্মী ধর্ম-কর্মে তার মাকে ছাড়িয়ে গেছে, সেই লক্ষ্মীকেই কি-না সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের কত বকাবকি। ঘুম থেকে উঠে সে গীতার উপর সাদা ফুল দেয়নি কেন, স্বামীকে কাজে যাবার আগে প্রণাম করেনি কেন, হাজারও ধর্ম-কর্মের অজুহাত আজ যেন লক্ষ্মীকে দিতেই হবে। এরপর শুরু হল শিকিার ধর্ম-কর্ম শেখানোর পালা। যেন লক্ষ্মীর এক চুল এদিক-সেদিক হলে পুরো পৃথিবীটাই উল্টে যাবে, স্বামী ধর্ম মানুক আর না মানুক স্বামী হল দেবতা, তাকে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু এই লক্ষ্মীকে যার কি-না সারাদিনে একটুও গল্প করবার অবসর হয় না, এত ছোট সংসার হওয়ার পরও তাকে সবই করতে হবে।


 


মেয়ের চুলে তেল দিতে দিতে মা তাকে গল্প শোনায়, ভাদরকাটানির গল্প- ঠিক গল্প না, মায়ের দেখা গল্প- দেখা ইতিহাস- তাদেরই গ্রামে ওদের মতই ছিল ছোট ছিমছাম সংসার। সেই সংসারে স্বামী যদিও কিছুটা ধর্ম মানত, মেয়েটা ততটা মানত না- এমনভাবেই মানতে না যে প্রায়শ স্বামীর সঙ্গে মেয়েটা ঝগড়াই করত। একবার কী এক কারণে স্বামী ভাদ্র মাসে বাড়িতেই ছিল, কারোরই খেয়াল ছিল না যে ভাদ্র মাসে প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দেখলে অমঙ্গল হয়। ভাদ্র মাস যাবার পর সেই যে ওদের সংসারে অভাব শুরু হল- স্বামী কাজ পায় না কোথাও, একবেলা খায় তো দুই বেলা খায় না- এরকম করে চলতে লাগল আর একদিন শোনা গেল কোন এক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছে।


 


লক্ষ্মীর ভেতরটা যেন হু-হু করে উঠল, যেন এই ঘটনা তার জীবনে না ঘটে, যেন সে আরও বেশি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনই ভুলেও সে ধর্ম-কর্ম নিয়ে কোনো চুল পরিমাণ এদিক-সেদিক হতে দেবে না। মুহূর্তের ভেতরেই লক্ষ্মী কেমন শিউরে উঠল, লক্ষ্মীর ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল আর ভাবতে লাগল এর আগে কি কোথাও কোনো অমঙ্গলকর কাজ করেছে কি-না আর ভাবে, ভাদ্র মাসে সে কোনোদিন স্বামীর মুখ দেখবে না। দু’দিন বাদে লক্ষ্মী যখন তার মাকে বিদায় দিল তখনও তার চোখে-মুখে ছিল প্রতিজ্ঞা আর হারানোর ভয়, যেন একটু এদিক-সেদিক ও কোনো কিছুতেই হতে দেবে না, তাহলেই উল্টে যাবে সব। সংসারে সুখ টিকিয়ে রাখতে হলে যে প্রাণপণ তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতেই হয় তা যেন লক্ষ্মীকে আর কারও বোঝানোর দরকার নেই। যেন লক্ষ্মী সত্যি এবার বুঝে নিয়েছে জগৎ সংসারের ভার।


 


আগে যদিও বিকেল বেলাতে এক-আধবার পাশের বাড়িতে গিয়ে গল্পে জুড়ে দিত তাও এখন আর নেই। আর সে কারণেই পাড়া প্রতিবেশীরা একদিন এসে বেশ কৌতুক করেই বলছিল, কি গো লক্ষ্মীর যে কোনো দেখা-সাাৎ নেই, কোনো সাড়া-শব্দ নেই- হঠাৎ এত স্বামীর প্রেমে পড়ে গেল। লক্ষ্মীও হেসে বলছিল, না গো দিদি সংসারের কাজ সারতে সারতে এখন আর সময় পাই না, ছোট সংসার হলে কী হবে সংসারটা যে একটা জগৎ এটা যখন কেউ বুঝতে পারে তখন কি আর কাজের শেষ থাকে।


 


লক্ষ্মী সকালে উঠে, স্নান সারে, ঠাকুর ঘরে যায়, ফুল তুলে, নাস্তা বানায় স্বামীকে খাইয়ে বিদায় দেয়, একটু বেলা হলেই ঘর লেপা, এটা সেটা পরিষ্কার করা, আবার রান্না, আবার ঠাকুর ঘর , সন্ধ্যার ধূপবাতি এসব করতে করতে সে বারবার মনে রাখে ভাদ্র মাসের প্রথম তিন। এটা কোনোভাবেই ভোলা যাবে নাÑ এটা সব সময় যেন মনে রাখতে হবে, এখন চলছে বৈশাখ তারপর আশ্বিন তারপর ভাদ্র নাম জপের মত করে মনে রাখে সে কোন মাসের কোন দিন এল আর কখন আসবে ভাদ্র মাস।


 


একবার তো দেরি করে স্বামীর বাড়ি ফেরার কারণে তার মধ্যে একপ্রকার ঝড়ই বয়ে গেল- এমন ঝড় সব কিছু কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে গেল তার। সে মনেই করতে পারছিল না, এটা ভাদ্র মাস না কার্তিক মাস না আশ্বিন মাস। তার বারবার মনে হতে লাগল, সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল এটা ভাদ্র মাস আর বুকের ভেতর কেমন হু-হু করে উঠল তার- সেই অমঙ্গল, সংসারের অমঙ্গলের ছাপ বোধহয় লেগেছে, ভাদ্র মাসে তো স্বামীর মুখ দেখা বারণ তবুও সে দেখেছে। লক্ষ্মীর প্রথমে মুখ তারপর শরীরজুড়ে স্বেদবিন্দু জমা হতে লাগল, তারপর বৃষ্টির মত করে যেন ওই সব ঘাম ঝরতে লাগল, সারা শরীর ভিজে গেল তার।


 


এর কিছু সময় পরেই দরজায় ঠুকঠুক শব্দ, সে যেন চমকে উঠল, তার মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ হচ্ছিল না, কোনোরকমে সে দরজা খুলে দেখতে পেল তার স্বামী। অন্য কোনোদিনের মত সে ঝটপট আজ আর গামছাটা এনে দিল না, বরং নিস্প্রভ বসে রইল। স্বামীরও বুঝতে বেশি দেরি হল না, প্রশ্ন করে বসল, কি গো কিছু আজ হয়েছে নাকি তোমার? শরীর খারাপ? যেন সমস্ত কিছু- সমস্ত আবেগ, সমস্ত প্রেম, সমস্ত বুকফাটা কান্নাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হুট করে উঠে দাঁড়াল লক্ষ্মী, কোনো কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল, খাবার বাড়ল, স্বামী খেল, তারপর লক্ষ্মী।


 


এমন করেই দিন যাচ্ছিল ওদের, যেভাবে নৌকোর বৈঠায় এক এক টানে নৌকো এগোয়, সংসারটাও যেন সেভাবে এগুচ্ছিল। মাঝে স্বামীর কাজের চাপ বেড়ে যায়Ñ আজ আসে তো কাল আসে না, রাত-দিন খাটুনি আর লক্ষ্মীর একাকী ঘরে স্বামীর কথা ভাবা, সংসারের কথা ভাবা। লক্ষ্মী কোনো এক বিকেলে একবার পাশের বাড়ির কাকীর সাথেও ভাদরকাটানি নিয়ে আলাপ করছিল যে তার মার কাছে শুনেছে ভাদ্র মাসে প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দেখলে অমঙ্গল হয়। তার মা বলেছে এরকম এক সংসারে স্বামীর মুখ ভাদ্র মাসে দেখায় শেষ পর্যন্ত স্বামীটি মারা যায়। কাকীও তাকে বলেছিল আমরা সবাই এটা পালন করি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকীও বলেছিল বলা তো যায় না কার জীবনে কখন কী ঘটে। লক্ষ্মী একবার তার শাঁখার দিকে তাকায়, আবার ঘর থেকে আয়না বের করে করে ভালো করে সিঁদুর দেয় আর ভিতরে ভিতরে যেন বলতে থাকে- ঠাকুর আমার যেন এমন না হয়।


 


আমি মাঝে মাঝে অবাক হই এই ভেবে যে লক্ষ্মী তার বরকে নিয়ে এত ভাবে, সংসার নিয়ে এত ভাবে, বলতে গেলে পুরো জীবনটাই যে এই নারী সংসারের মুখে তুলে দিচ্ছে তার কি সত্যি কোনো সাধ-আহাদ নেই। তাহলে কি সংসার নামক বস্তুটির সাথে এর চেয়েও আরও বহুগুণ সাধ-আহাদ জড়িয়ে আছে যা কেবল লক্ষ্মী জানে, আমরা নই। হতে পারে বিচিত্র এই জগতের ভিতর সাধ-আহাদেরও রয়েছে হাজারো রকমফের, রয়েছে এমন কিছু গোপন সুখের ডালি যা সহজেই কেউ দেখতে পায় না। লক্ষ্মী তার বর আর সংসার নিয়েই পড়ে থাকে- কথাটি বললাম আরও এই কারণে যে তাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই তার বিয়ের বয়স খুব একটা বেশি নয়, অথচ পোশাক-আশাক, শাড়ি-কাপড় দেখলে মনে হবে তার যেন জগতে সাধ-আহাদ বলে কিছু নেই। শুধু তাই নয়, বরকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া তো দূরে থাক বরের সাথে যে একটু সাধ-আহাদ করে গল্প করবে তাও দেখা যায় না।


 


লক্ষ্মীকে আজ খুব উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছিল, ঝড় বয়ে গেলে পর চারপাশে তাকালে যেমন নুয়ে পড়া গাছ, পথঘাট, ডাল-পালা পড়ে থাকা এমন দেখায় লক্ষ্মীর চোখে-মুখে তেমনি এক তাণ্ডবের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। লক্ষ্মীর বর বীরেন মাঝে মাঝে আসে না এটা সত্য কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে লোকটার কোনো খোঁজখবর নেই- এটা বিচলিত হবার মত সংবাদই বটে। একবার ভাবে বীরেন বুঝি তার মায়ের বাড়ি গিয়ে কোনো একটা কাজে আটকা পড়েছে, আবার ভাবে তাহলে তো কেউ তাকে খবর দিত, আবার ভাবে তাহলে কি তার মা-বাবার বাসায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি-না যে কোনো কিছু কাউকে জানানোর সময় পায়নি।


 


এমনও তো হতে পারে তাকে মহাজন বড় বড় কাজ এলে বন্দরে পাঠায়, সে বোধহয় বন্দরেই গিয়েছে। এরকম কিছু ভাবতে ভাবতে লক্ষ্মী মনে করা চেষ্টা করল এটা যেন কী মাস লক্ষ্মী চাুস দেখতে পেল এটা ভাদ্র মাসার প্রথম তিন দিন সে বরের সাথে কাটিয়েছে। তার নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, একবারও সে বাড়ির বাইরে গেল না, একবার অন্তত একবার পাশের বাড়ির কারও সাথে আলাপ করলেও তো বুঝতে পারত এখন ভাদ্র মাস। তার বুঝতে দেরি হল না এটা অমঙ্গলের ছাপ। তার বুঝতে দেরি হল না বড় ধরনের কিছু একটা ঘটেছে। তার সেই মায়ের গল্পটা মনে পড়ল, মনে পড়ল সেই গল্পে মেয়েটি তার বরকে হারিয়েছিল। তার দু’চোখ দিয়ে কখন থেকে যেন অনবরত কান্না ঝরছিল, তার হাত-পা সারা শরীর অবশ হয়ে পড়ছিল সে চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। যে মাসটির জন্য, যে সময়টিকে নিয়ে এতদিন ধরে সে সতর্ক ছিল, এতটা সময়েও যে ভুলতে দেয়নি নিজেকে এটা ভাদ্র মাস এটা প্রথম তিন দিন সেই ঘটনাটাই আজ তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল। নাকি এই যে মানুষের ভাগ্যে যা থাকে তাকে সে আটকাতে পারে না মানে ভাগ্য বলেও একটা ব্যাপার আছে। একা একটা অন্ধকার ঘরে আজ যে লক্ষ্মী নামের মেয়েটি মরার মত পড়ে আছে সেই মেয়েটিই তো প্রাণপণে বাঁচাতে চেয়েছে তার বরকে তার সংসারকে কোথাও কোনো ত্র“টি হতে দেয়নি। যদিও আমিও অনেক দেখেছি ভালো মানুষগুলোর জীবন যে কী পরিমাণ কষ্টের হয়, হয়তো আমার আরেকটা অভিজ্ঞতার যোগ হল।


চারপাশটা কেমন থমথমে, দূর থেকে একটি শেয়াল একনাগাড়ে ডাকছে তো ডাকছেই আর তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে কুকুর। লক্ষ্মীর চোখ হঠাৎ বড় হয়ে উঠল, হাত-পা কেমন সচল হয়ে উঠল তার। দরজায় কে যেন ঠকঠক করে শব্দ করছে আর বলছে, লক্ষ্মী ঘুমিয়ে গেলা নাকি!


 


প্রকৃতপে ওটা ভাদ্র মাস ছিল কিন্তু লক্ষ্মীর বর প্রতিদিনই বাড়িতে এসেছে। কিন্তু লক্ষ্মীর কেন এমন মনে হল যে সে এক সপ্তাহ যাবত বাড়ি আসে না বা আর আসবে না বা আদৌ আর ফিরবে না, এটা নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি। কিন্তু এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই লক্ষ্মীর মধ্যে আরও কিছু বিষয় প্রকট হয়ে উঠল, এমনকিছু বিষয় যা আরও বেশি ভাবনার উদ্রেক করে মানে লক্ষ্মীর মনে হয়, যে এসেছে সেদিন রাতে সে তার বর নয়। হুবুহু তার বরের মত দেখতে অন্য কেউ, সে বিশ্বাস করতে পারে না ভাদ্র মাসে এভাবে স্বামীর মুখ দেখলে কোনো স্বামী বেঁচে থাকতে পারে। কাজেই সে কেমন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, বোবার মত হয়ে যায়। লক্ষ্মী একটা মেশিনের মত, সবকিছু যেন করে, সকালে উঠে, স্বামীকে নাস্তা দেয়, ঠাকুর ঘরে যায়, পূজাপালি করে, কিন্তু ভাদ্র মাসের কথা আর মনে করে না। কারণ মনে করেই বা কি হবে তার স্বামী তো আর বেঁচে নেই- যে এখন তার সাথে সে তার স্বামীর মত অন্য কেউ। একটি মেশিন-একটি যন্ত্র- স্বয়ংক্রিয় কোনকিছুর মত লক্ষ্মী দিন কাটাতে শুরু করে- স্বয়ংক্রিয় কোন কিছুর মত নয় আমার একবার মনে হয় লক্ষ্মী চরিত্রটি স্বয়ংক্রিয় মানে অটোমেটেড সফ্টওয়্যার জেনারেটেড।


 


লক্ষ্মী কেমন পুতুলের মত হয়ে যেতে থাকে, – লক্ষ্মীকে দেখলে মনে হয় শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় না, ঘামে না, হাসে কিন্তু পুতুলের মত হাসি, কথা বলে কিন্তু পুতুলের মত কথা। এটা প্রথম মনে হয় তার বরের। একবার বর তাকে জিজ্ঞেসও করে-তোমাকে এমন লাগছে কেন? লক্ষ্মী অবাক হয়ে যায়, কিছু বলে না। সে পাশের বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা আমাকে কি এখন পুতুলের মত মনে হয়। পাশের বাড়ির লোকজন কিছু বুঝতে পারে না। একবার তাকায়, তারপর বলে, হ্যাঁ একেবারেই পুতুলের মত। লক্ষ্মীর চারপাশে কেবল মানুষ আর মানুষের ভিড় জমতে থাকে আর লক্ষ্মী হতে থাকে পুতুল। লক্ষ্মী কাউকেই বোঝাতে পারে না সে পুতুলের মত না মানুষের মত।


 


 


 


পাতাবাহার


 


বাসে ওঠে স্বভাবসুলভ পেছনের একটি সিটে বসেই কেমন চমকে গেলাম, কেমন হতচকিত হয়ে গেলাম এই দৃশ্য দেখে যে, সামনের যতগুলো সিট তাতে সবাই একজন একজন করে বসে আছে। আশ্চর্য তো, মানুষ তো সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চায়, সমাজে থাকতে চায়, রাষ্ট্র গঠন করতে চায়; কিন্তু এরা সবাই একটি একটি সিট নিয়ে বসে আছে কেন? বাসে ওঠার লোক আজকে না হয় কম, তাই বলে ওরা এক সিটে দুইজন বসবে না, বসল না কেন, দুইজন বসে তো গল্প করা যেত, দুইজন বসে তো একে অপরজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যেত, দুইজন বসে তো কিছুটা সময় দু’জনে মিলে কাটানো যেত। কিন্তু ওরা একজন একজন করে বসল, আমিও খেয়াল করলাম যে স্বয়ং আমিও একা বসে থাকা সব সিটের পাশ দিয়ে এসে পেছনের সিটটিতে বসেছি, সেখানেও আমি একা। আমিও তো পারতাম কারও সাথে বসতে, পরিচিত হতে, গল্প করতে কিন্তু করলাম না, কেন যেন করলাম না। আমি কি একা থাকতে চাই, একাকী শঙ্খচিলের মত সমস্ত দুপুর, সমস্ত আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াতে চাই, উড়ে উড়ে নিজের মত করে দেখতে চাই সমস্ত পৃথিবী। ওরা হয়তো একা, ওরা হয়তো একা থাকতে চায়, ওরা হয়তো একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করে না, ওরা হয়তো ভালবাসতে পারে না, ওরা হয়তো হাত বাড়িয়ে দিতে পারে না বন্ধু বলে, ওরা হয়তো ওদের মত থাকতে চায়, ওদের মত অথবা ওরা হয়ত ধনীলোক, গরিবদের সাথে মিশে না, বা ওরা হয়তো নিজেদেরকেই শুধু ধনীলোক ভাবে, অন্য কেউ তার চেয়ে ধনী এটা ভাবতে পারে না। কিন্তু ওদের তো বউ আছে, বান্ধবী আছে, প্রেমিকা আছে, ছেলেমেয়ে আছে, ওরা তো ওদের পাশে থাকতে পারত, এক সিটে বসতে পারত। অথচ আজ কারও পাশেই বউ নেই, বান্ধবী নেই, প্রেমিকা নেই, ছেলেমেয়ে নেই। হয়তো কোনো কারণে আজ একসাথে বের হয়নি অথবা যে যার কাজে চলে গেছে আজ যে যার মত। কিন্তু ওদের বউ থাকলে বা বান্ধবী থাকলে বা প্রেমিকা থাকলে বা ছেলেমেয়ে থাকলে ওরা কি একসাথে বসত? ওরা কি একসাথে বসে একজন আরেকজনের হাত ধরে থাকত, ওরা কি পাশে বসে দু’জন দু’জনের স্বপ্নের কথা বলত, ওরা কি হঠাৎ সবার অল্েয চুমু খাওয়ার চেষ্টা করত? হয়তো করত কিন্তু আজ কেন যেন ওদের দেখে তা মনে হচ্ছে না- কেবল মনে হচ্ছে ওরা একা, একা থাকতে চায়, কেবলই একা কেন যেন মনে হচ্ছে এরকম।


 


তবে আমি কি চাই, আমিও তো বসে আছি একা, আমি কি একা, একাই তো, আমার তো কোনো বউ নেই, বান্ধবী নেই, প্রেমিকা নেই, ছেলেমেয়ে নেই, একেবারেই নির্ভেজাল একা, একটি মরা গাছের মত একা, লোকজন হয়তো দেখে ভাবে এই গাছটির কোনো পাতা নাই, এই গাছটির পাতা হয় না, ফল হয় না, এই গাছটিকে কেটে ফেলতে হবে। ভাবছি বেঁচে থাকা কত ভয়ঙ্কর, উৎপাদনের সঙ্গে না থাকলে বেঁচে থাকার কোনো মূল্য নাই। লোকজন হয়তো ভাবে এই লোকটা একেবারেই অসামাজিক, বউ নেই, প্রেমিকা নেই, বান্ধবী নেই, সারাণ একা একা ঘুরে; লোকজন হয়তো সন্দেহ করে, এড়িয়ে এড়িয়ে চলে; হয়তো কিছু বলতে চায়, এরকম কিছু যে তুমি এমন কেন, হয়তো বলতে চায় তুমি আমাদের পাশে কখনও বসবে না, কেন যেন লোকজন আমার দিকে তাকায়ও না, কেন যেন আমাকে দেখে হাসেও না, কাঁদেও না।


 


কিন্তু আমি একা কেন, আমি কি কোনো মেয়েকে বলব আমি একা, আমাকে সঙ্গ দাও; আমি কি কোনো মেয়েকে বলব, আমি কখনও ভালোবাসা পাইনি, তুমি কি ভালোবাসবে, আমি কি কোনো মেয়েকে বলব, চল আমরা বন্ধু হই। বলা তো আর হয় না, বলতে যে আর পারি না কিন্তু বললে কী হত, বললে কি মেয়েটি আমার বন্ধু হত, বললে কি মেয়েটি আমাকে ভালোবাসত, বললে কি মেয়েটি আমাকে সঙ্গ দিত। দিত হয়তো, হয়তো বা না, কিন্তু আমি একা এটা ঠিক, একেবারেই একা, খুব দূরের একটা স্টেশনের মত, ভুতুরে রহস্যময় স্টেশনের মত একা। হয়তো এই স্টেশন জানে অনেক কিছু তাই চুপচাপ থাকে, কাউকে কিছু বলে না, মানুষজনও কিছু বলতে সাহস পায় না, কেবল এতটুকুই জেনে রাখে সবাই, এই স্টেশনটি অনেক কিছু জানে।


 


আমি কি স্টেশনের মত, আমাকে দেখে কি মানুষজন মনে করে অনেক কিছু জানে তাই চুপচাপ, আমার সাথে কি মানুষজন কথা বলতে ভয় করে। করে হয়তো, হয়তো বা না।


 


কিন্তু আমি একা এটা ঠিক, আমি কখনও বান্ধবীর হাত ধরে স্বপ্ন দেখিনি, আমি কখনও প্রেমিকার ঠোঁটে ঠোঁট মেলাইনি, আমি কখনও প্রেমিকার পাশে বসে সূর্যাস্ত দেখিনি। তবে আমি একবার এক গোপন অ্যাকাউন্ট থেকে একজনকে প্রেমের কথা জানিয়েছিলাম, সেই মেয়েটি সাড়া দিয়েছিল, সে যখন সাড়া দিল তখন আমার একবার মনে হয়েছিল, আমি কেন গোপন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রেমের বার্তা পাঠালাম। একবার মনে হল ওই অ্যাকাউন্টে আমার ছবিটা দিয়ে দেব, যাতে করে সে বুঝতে পারে এটা আমি, এই যে এই আমি। পরে আবার মনে হল, না এটা গোপন অ্যাকাউন্ট, এটা সে জেনে ফেললে হয়তো আর সাড়াই দেবে না। তার থেকে এই-ই ভালো, আমি তার সঙ্গে সেই গোপন অ্যাকাউন্টে কথা বলি, আমি তার সঙ্গে সেই গোপন অ্যাকাউন্টে ভালোবাসি, আমি তার সঙ্গে সেই গোপন অ্যাকাউন্টে তার জন্য সমস্ত প্রেম নিয়ে বসে থাকি- সে সাড়া দেয়। আমি ধরে নিই সে আমাকেই সাড়া দিয়েছে, আমি ধরে নেই সে আমাকেই ভালোবাসছে, আমি ধরে নেই সে আমাকেই চায়, গোপন অ্যাকাউন্টকে নয়।


 


আমি একবার চেয়েছিলাম সেই গোপন অ্যাকাউন্টের পাতাবাহার নাম পাল্টে নিজের ঠিকানা দিতে, কিন্তু কখনও পারিনি- কখনও কি পারব না? হয়তো পারব, হয়তো পারব না; যেভাবে কেউ কেউ পারে না বলে সহজেই পৃথিবীর শাস্তিটাকে মেনে নেয়, তেমন আমিও। কিন্তু আমি যে একা এটা ঠিক, কারণ যে মেয়েটি ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছে, সে তো আমাকে সাড়া দেয়নি, সাড়া দিয়েছে আরেকজনকে- মানে সেটা হয়তো আমিই, সেখানকার ভাষা, সেখানকার আবেগ; সবই তো আমার কিন্তু আমি না, ওটা পাতাবাহারের। পাতাবাহার অন্যরকম করে কথা বলে, পাতাবাহার অন্যরকম করে গান গায়, পাতাবাহার অন্যরকম করে হাসে, সবচেয়ে বড় কথা পাতাবাহার একটি মেয়েকে বলতে পেরেছিল ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা, হতাশার কথা, স্বপ্নের কথা- আমি তা পারিনি, আমি তা পারি না। কাজেই আমি পাতাবাহার না। পাতাবাহার অন্য কেউ, পাতাবাহার একা নয়, আমি একা।


 


পাতাবাহার একবার মেয়েটিকে দেখা করার ঠিকানা দিল, সময় বেঁধে দিল, এই সময়ের মধ্যে এখানে আসবে। পাতাবাহার একবার ধারণা করেছিল মেয়েটি আসবে না, আবার এ-ও ভেবেছিল- আসতেও পারে। আসতেও তো পারে এরকম একটি সম্ভাবনা নিয়ে পাতাবাহার সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে গিয়ে রীতিমত অবাক হয়ে গেল, বিস্মিত হয়ে গেল, তার কাছে মনে হল পৃথিবীর সমস্ত সুখ এখন তার কাছে, তার কাছে মনে হল এখন সেই রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে আজ টগবগিয়ে এসেছে। এত সুন্দর একটা মেয়ে, অপূর্ব একটা মেয়ে সাদা শাড়ির উপর লালপাড়, কেমন দেবীর মত লাগছিল দূর থেকে। পাতাবাহার কি কাছে যাবে মেয়েটির, কীভাবে যাবে, আমিই তো পাতাবাহার, আমি কীভাবে তাকে পরিচয় দেব, কীভাবে বলব তুমি যে পাতাবাহারকে চেন সে আমিই। কীভাবে বলব আমিই তোমাকে ভালোবাসি, মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি- আমিই তোমাকে চাই, একসাথে বসতে, হাত ধরে স্বপ্ন দেখতে চাই। এই প্রেম, এই একটি নারীর প্রতীা, একে তো আর দুঃখ দেওয়া যাবে না, একে তো আরা কষ্ট দেওয়া যাবে না, দূর থেকে দেখেছি ঘণ্টা খানিকের মত বসে থেকে সে চলে গেছে। সে কি তখন অনেক কষ্ট পেয়েছিল, হয়তো পেয়েছিল, পাওয়ার কথা। আমি তাই সেদিন রাতেই তাকে মেসেজে জানিয়ে দেই কোনো একটা কারণে পাতাবাহার আসতে পারেনি। সে হয়তো েেপছে, প্রচণ্ড রেগে গেছে কিন্তু তারপর আবারও প্রেম, পাতাবাহারের সঙ্গে প্রেম। আমরা প্রতিদিন সময় করে কথা বলি, প্রতিদিন কে কখন কী করছি সবই একে অন্যকে জানাই। যেন একই সাথে আছি আমরা, একই সাথে কেটে যাচ্ছে আমাদের প্রেমের সংসার। আবারও একদিন পাতাবাহার মেয়েটিকে দেখা করতে বলে, অনেক অনুরোধ করে- অনেক ভাবে বোঝায় যে এবার আর আগের মত হবে না। মেয়েটি আসে, সেই সাদা শাড়ি, লালপাড়, যেন দেবী। এবার তো দেখা করতেই হবে- এবার তো বলতেই হবে যে আমিই পাতাবাহার, এবার তো বলতেই হবে যে তুমি যাকে এতদিন দূর তার যন্ত্রে ভালোবেসে এসেছ সে আমিই। আমি তার কাছে যাই, সে একবার আমার দিকে তাকায়, তারপর আবারও অন্যদিকে। এরপর একবারও আমার দিকে চোখ রাখেনি। আমি তখনই বুঝতে পারছিলাম সে যাকে পাতাবাহার নামে চিনে, সে যে পাতাবাহারকে এতদিন ধরে ভালোবেসেছে, সে যে পাতাবাহারের জন্য আজ অপো করে বসে আছে, সে আমি না। আমি তবু তার কাছে যাই, আমাকে যে আজ বলতেই হবে- আমাকে যে আজ বলতেই হবে আমিই পাতাবাহার, আমিও এতদিন ধরে তোমার জন্য বসে আছি- আমিই তোমাকে ভালোবাসি- পাতাবাহার নয়, তুমি আমাকেই ভালোবাস, পাতাবাহারকে নয়। কারণ আমিই পাতাবাহারের স্রষ্টা, আমি যা বলি পাতাবাহার তাই করে, আমি যেভাবে ভালোবাসি, বাসতে চাই, স্বপ্ন দেখি, দেখতে চাই সবই আমার, পাতাবাহারের নয়। পাশে যে লম্বা বেঞ্চে বসে আছে মেয়েটি আমি তার পাশে বসি, বসে একবার তার দিকে তাকাই। সে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন ইতস্তত বোধ করে। সে যাই করুক, যাই বলুক; আজ যদি সে আমাকে অস্বীকারও করে, আজ যদি সে আমাকে ঘৃণাও করে, তারপরও আমাকে বলতে হবে, কারণ পাতাবাহার যে বলেছে আজ আসবেই। আমি মেয়েটির আরেকটু কাছে এসে বসি, মাথা নিচু করে বলি- আপনি যে পাতাবাহারের জন্য অপো করছেন সে আমিই। সে আমার দিকে তাকায়, তার মুখে তখন হাসি ছিল, আমার সেই হাসির কাছে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল, নিজেকে বিসর্জন দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। যে মেয়ে এমন ভুবনজয়ী হাসি হাসতে পারে, সে নিশ্চয়ই আমাকে ফিরিয়ে দেবে না, আমার ভিতরে তখন রাজ্য জয়ের আনন্দ। আমরা অনেকণ কথা বললাম, হাসলাম, স্বপ্ন দেখলাম, কী এক সুখে আমি সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম- রাতে সে আমাকে মেসেজ পাঠাল আমি যে পাতাবাহারকে এতদিন ধরে চিনেছি, আজ যে পাতাবাহারের সাথে তার কথা হল, তার মধ্যে যে যোজন যোজন ফারাক। আমার আর বুঝতে দেরি হল না, এবার পাতাবাহারও একা, আমিও একা। এরপর অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি আর কখনও পাতাবাহার হতে পারিনি অথবা পাতাবাহার আমার মত না।


 


কিন্তু এখন যারা বাসে একা একা বসে আছে ওদের জীবনেও কি এরকম গোপন অ্যাকাউন্ট আছে, এরকম পাতাবাহার আছে, যে পাতাবাহার যে তারাই, তা কখনই বোঝাতে পারেনি। হয়তো আছে, হয়ত বা নেই।


 


হয়তো এই গোপন অ্যাকাউন্টগুলো এমনই যে সে কখনই মানুষের মত না, বাস্তবের মত না, কেবল স্বপ্নের মত, কল্পনার মত আর হয়তো তাই বাস্তবের কেউ তাকে মেনে নিতে পারে না। আজ এই বাসে সবাই হয়তো এই কারণে একা এক একটি সিটে বসে আছে, আমার মত নিজের সেই গোপন অ্যাকাউন্টের কথা, সেই পাতাবাহারের কথা ভাবছে।


 


 


 


 


দুপুর মিত্র বাংলাদেশে কপিলেফ্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত। বিশ্বব্যাপী কপিরাইট আইন স্বাধীন মত প্রকাশে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই প্রতিবাদ হিসেবে কপিলেফ্ট আন্দোলনের জন্ম। মূলত এই কপিলেফ্ট আন্দোলন ইউরোপে এখনো সফ্টওয়্যার কেন্দ্রিক। কিছু কিছু দেশে সংগীত শিল্পে এই কপিলেফ্ট আন্দোলনের চল রয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা জগতে কপিলেফ্ট আন্দোলন বাংলাদেশেই প্রথম। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দুপুর মিত্র প্রকাশ করছেন


http://www.copyleftwebjournal.tk নামের একটি ওয়েব জার্নাল। এই জার্নালেই প্রথম কপিলেফ্ট আন্দোলনের মেনিফেস্টো প্রচার করা হয়। এই জার্নালটি বাইলিংগুয়াল ( বাংলা ও ইংরেজি) হওয়ায় খুব দ্রুত একটি বিশেষ স্থান লাভ করেছে যেখানে বাংলাদেশ, ভারত, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং কপিলেফ্ট আন্দোলনের কারণে এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হয়েছে।


 


এছাড়া সম্প্রতি SOPA ও PIPA আইনের বিরুদ্ধে কপিলেফ্ট আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় তার অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো।


তার প্রথম কবিতার বই ৪৪ কবিতা (২০১০) বাংলাদেশের প্রথম কপিলেফ্ট কবিতার বই। “দশভুজা” গল্পের বইটিও কপিলেফ্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি বিক্রির জন্য নয়।