Tuesday, January 9, 2024

দুপুর মিত্রের রূপকথা

 

কোনও একটা ফর্ম দাঁড়িয়ে যায় তখনই যখন এটা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যায়। জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্মের ধারণা আর ইতালো কালভিনোর কিছু কাজ আমাকে আ্যানিমেল ফ্যাবল নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ যোগায়। এরপর প্রায় এক বছর ধরে আমি এটা নিয়ে বাংলা ভাষায় কাজ করতে থাকি। সম্প্রতি এটা নিয়ে বেশ কয়েকজনের কাজ দেখা যাচ্ছে। আশা করি চারপাশের চর্চা এই ফর্মটার আরও অনেক বিকাশ আনবে।-দুপুর মিত্র
রূপকথা- ১
এটা ছিল শিয়ালদের দেশ। একবার এই দেশে বিড়াল ছাত্রদের কি পড়ানো হবে, কিভাবে পড়ান হবে, কি কি কারিকুলাম থাকবে- এসব নিয়ে ব্যাপক ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে গেল শিয়াল শিক্ষামন্ত্রীর সাথে অন্যান্য শিয়ালদের। কারণ শেয়াল শিক্ষমন্ত্রী বলেছিলেন, এক দেশে হাজার রকমের শিক্ষা থাকতে পারে না। এতে বৈষম্য বাড়ে। এক এক শিয়াল ছাত্র এক এক রকম হয়। কেউ গরিব হয় আবার কেউ হয় ধনী। কেউ হয় প্রচণ্ড ধার্মিক-গোড়া, মৌলবাদী আবার কেউ হয় উগ্র, অনেক ইংরেজি জানা হয় কেউ, কেউ আবার নিজ ভাষা ভুলে যায়। কেউ কেউ কেবল নিজ ভাষাটাই ভাল করে জানে; অন্য ভাষা জানার প্রয়োজন মনে করে না বা নৈতিকভাবে মনে করে না। এতে এক দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। শিয়াল শিক্ষামন্ত্রীর এই কথায় বিভিন্ন শিয়াল রাজনীতিবিদরা ক্ষেপে গেল। এদের কেউ কেউ বলল- দেশ থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে শেষ করে দেবার জন্য এই মন্ত্রী এসব করছে। আবার কেউ কেউ বলল, গরিব মানুষের এত ইংরেজি বা উচ্চ শিক্ষার কি দরকার। বড়লোকের ছেলে-মেয়েরাই কেবল এই শিক্ষার সুযোগ পাবে। এই অবস্থায় অনেক শিয়াল রাজনীতিবিদ আন্দোলনও শুরু করল। তারা শিয়াল শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চাইল। এই অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রী অনেকটা বিপাকেই পড়ল বলা যায়। ঠিক এমন সময়েই শিয়াল শিক্ষামন্ত্রী আমেরিকা সফরে গেলেন। দেশে তখন আন্দোলন তুঙ্গে। আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই শিয়াল শিক্ষামন্ত্রী সকল শিয়াল রাজনীতিবিদদের ডাকলেন। সবাইকে তিনি তাদের দাবিনামা জানাতে বললেন। সবাই দাবিনামা জানাল। শিয়াল শিক্ষামন্ত্রী বললেন, আমি আপনাদের সব দাবিই মানব। কেবল আমার একটি মাত্র শর্ত আছে। সকল শিয়াল রাজনীতিবিদ জানতে চাইলেন- কি সেই শর্ত। শিয়াল শিক্ষামন্ত্রী বললেন, আপনাদেরকে প্রত্যেক ছাত্রদের চশমা পড়াতে হবে। এই চশমার ব্যবস্থা সরকার করবে। মানে আমেরিকা সরকার আমাদের দেশের ছাত্রদের জন্য এসব চশমা পাঠাবে। আপনারা রাজি কিনা? সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। ছাত্ররা সবাই চশমা পাবে , তাও আবার আমেরিকার চশমা। এটা তো ভালই। সব দাবিই মানা হল। মানে শিক্ষাব্যবস্থা আগের মতই থাকল। আর শিয়াল শিক্ষার্থীরাও আমেরিকার চশমা পড়ে শিক্ষা নিতে শুরু করল।

বড়দের রূপকথা-২

বিড়ালদের দেশে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। আজ এতজন খুন,কাল এতজন ধর্ষিত। আজ এখানে হাতবোমা,কাল ওখানে গ্রেনেড। এমনকি এমনও ঘটনা ঘটছে বিড়ালদের ঘরে গিয়ে খুন খারাবি হচ্ছে। কিন্তু বিড়াল পুলিশ এসবের কোনও কুল কিনারাই করতে পারছে না। এখনও পর্যন্ত বিড়াল পুলিশ কোনও ঘটনার বিচার তো দূরের কথা কাউকে আটক পর্যন্ত করতে পারেনি।

এসব নিয়ে বিড়াল সাংবাদিক, বিড়াল এনজিও কর্মী, বিড়াল রাজনীতিবিদ এমনকি বামপন্থি বিড়ালরাও ক্ষুব্ধ। শুধু দেশের এইসব ঘটনার কারণে এইসব অনিশ্চয়তার কারণে এইসব অশান্তির কারণেই ক্সুব্ধ নন, বিড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নানা সময়ের নানা বক্তব্যে তারা যারপর নাই বিরক্ত।

একবার এক বিড়াল সাংবাদিক কোনও এক অনুষ্ঠানে বিড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- দেশে এসব হচ্ছে। এই প্রশ্নের উত্তরে বিড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তাতো হবেই। দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত। অশিক্ষিত বিড়ালদের দেশে খুন একটু বেশিই হয়। এটা সরকারের কোনও ব্যর্থতা নয়।

একবার এক সেমিনারে বিড়াল এনজিও কর্মীরা বিড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘিরে ধরলেন। দেশে এত এত ধর্ষণ হচ্ছে। কয়েক বছরে ধর্ষণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০%। কিন্তু আপনারা কিছুই করছেন না। বিড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তাতো হবেই। অশিক্ষিতের দেশে একটু ধর্ষণ বেশিই হয়। আপনারা শিক্ষিতের হার বাড়ানোর কাজ করেন, তাহলেই ধর্ষণ কমে আসবে।
এইভাবে বিড়ালদের দেশ চলতে লাগল। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও এনজিও, কোনও দূতাবাস এসব নিয়ে কোনও ইস্যুই তৈরি করতে পারল না।

একদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব বললেন, স্যার ভাবীকে ইদানিং প্রায়ই বিরোধী দলের একজন নেতার বাড়িতে দেখা যায়।

বিড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তাতো হবেই। বিড়াল দেশের জন্য এত সময় দিতে হয়, আপনার ভাবীকে সময় দেবার মত কোনও সময় কি আমার আছে?




বড়দের রূপকথা-৩

একবার হনুমানদের দেশে কারও ডান হাত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না মানে আমেরিকা একটি ডান হাত কেনার চেষ্টা করছিল। আমেরিকা প্রধানমন্ত্রীর ডান হাতের দিকে তাকায় হনুমান প্রধানমন্ত্রী বলেন এই হাত তো আপনারা আগেই কিনে নিয়েছেন। পুনরায় কিনতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।
আমেরিকা হনুমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ডান হাতের দিকে নজর দেয় সেও জানায় তার ডান হাতও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগের রাতেই বিক্রি হয়ে গেছে।
আমেরিকা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকায় সেও জানায় তার হাত বিক্রি হয়ে গেছে।
আমেরিকা সুশীল সমাজের দিকে তাকায় তাদের হাত বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা জানায় তারা।
এরকম করে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতা এমনকি সাধারণ হনুমানদেরও ডান হাত বিক্রি হয়ে গেছে।
আমেরিকা দূতাবাস হিসেব করতে থাকে। দেখে যে তাদের সবারই ডান হাত কেনা হয়ে গেছে। কিন্তু একজনের ডান হাত কেনা বাকি। হনুমান প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত হয়ে পড়েন। হনুমান দেশে কে এমন আছে যার ডান হাত এখনও কেনা হয়নি। আমেরিকা জানায় সে রাজধানী শহরের এক প্রেমিক হনুমান। প্রধানমন্ত্রী এসবের কিছুই বুঝতে পারেন না। বুঝতে পারেন না আমেরিকা এতগুলো ডান হাত কেনা হয়েছে। এত এত দামি ডান হাত। কিন্তু কেন সে সেই প্রেমিক হনুমানের ডান হাত কিনতে চাচ্ছে। সেই ডান হাতের মূল্যই বা কত? হনুমান প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকার এই আবদার খুবই হাস্যকর মনে হয়। কৌতুহলি হয়ে হনুমান প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা দূতাবাসকে একবার জিজ্ঞেসও করে, এত এত দামি ডান হাত তোমরা কিনেছ; খামোখা এই প্রেমিক হনুমানের ডান হাতের জন্য তোমরা এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছ কেন? এটা কিনলেই বা কি, না কিনলেই বা কি? আমেরিকা জানায়, তাদের সব ডান হাত কেনা হলেও ভালবাসা কেনা হয়নি। আমেরিকার এখন প্রয়োজন হনুমানদের ভালবাসা কেনা। এজন্যই সেই প্রেমিক হনুমানের ডান হাত প্রয়োজন। হনুমান প্রধানমন্ত্রী এবার বুঝতে পারে। এবং বলে এ খুবই সহজ কাজ। কিন্তু আমেরিকা জানিয়ে দেয়, এটা খুবই কঠিন কাজ। খুব সতর্ক থেক। হনুমান প্রধানমন্ত্রী এসব কর্ণপাত না করে প্রেমিক হনুমানকে ডেকে এনে তার ডান হাত বিক্রি করে দেবার কথা বলে। প্রেমিক হনুমান তাতে রাজি হয় না। প্রধানমন্ত্রী প্রেমিক হনুমানকে অনেক অনেক ডলারের কথা বলে। প্রেমিক হনুমান রাজি হয় না। প্রেমিক হনুমানকে গ্রেফতার ও পরে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। তাতেও সে রাজি হয় না। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী প্রেমিক হনুমানকে নির্যাতন চালিয়ে মেরেই ফেলে। এই ঘটনা সব হনুমান জেনে গেলে হনুমানের দেশে আন্দোলন দানা বাধে। এতে ডান হাত বিক্রি হয়ে যাওয়া হনুমানরাও যোগ দেয়। এই আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। হনুমান প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদ সাধারণ হনুমানরা দখল করে ফেলে। আর হনুমান প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

বড়দের রূপকথা-৪

একবার একটি বানর রাষ্ট্রে বানর বনরক্ষীর গুলিতে এক আদিবাসী বানর মারা যান। এই ঘটনায় আদিবাসী বানররা ক্ষেপে যান। বানর সুশীল সমাজ, বানর বুদ্ধিজীবী, বানর এনজিও কর্মীরা নানাভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু করেন। বিদেশি বানররাও এই ঘটনায় বানর রাষ্ট্রকে চাপ দিতে থাকেন। বাধ্য হয়ে বানর বনমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, বানর রাষ্ট্রে কোনও বনই এখন নাই। বানর বন রক্ষীরা একের পর এক বনের গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে বানর রাষ্ট্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। আপনারা এর কিছুই করতে পারেন নি কেন? বানর বন মন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের সরকার বনরক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এখনও করে যাচ্ছে। বন রক্ষীরা কখনোই বনের গাছ কাটেন না। তারা বনের রক্ষক। আদিবাসী বানররাই বনের গাছ কাটে। আমরা তারপরও কিছু বলি না। কখনও কখনও তাই বনরক্ষীদের একশন নিতে হয়। বন আদিবাসীর মৃত্যু এই কারণেই হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বনের কোনও গাছের একটি পাতা ছিড়লেও বন রক্ষীদের গুলি করার পারমিশন আছে। বনরক্ষীরা গাছ কেটে বিক্রি করার কথা সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা।

বানর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু আমাদের কাছে প্রমাণ আছে বনরক্ষীরাই গাছ কেটে বিক্রি করেন। আর আদিবাসী বানররা গাছ বন থেকে খাবার সংগ্রহ করতে না পারায় বন ছেড়ে তারা সমতল ভূমির দিকে চলে আসছে। বানর বনমন্ত্রী এসব অস্বীকার করেন এবং বলেন আপনারা যদি আমাদের পরের বার সরকার নির্বাচিত করেন তাহলে বনের ভেতর কারও ছায়া দেখা পাওয়া মাত্র গুলি করার আইন আমরা বাস্তাবায়ন করব। বন সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা সরকার করেছে এবং পরের বার নির্বাচিত হলে আরও অনেক কিছু করবে।

বড়দের রূপকথা-৫

এটা ছিল পাখিদের দেশ। পাখিরা সকালে উঠে গান করত। তারপর খাবার সংগ্রহে বেরুত। সারাদিন কাজের পর ঘরে ফিরে ঘুমুত। একবার এক বয়স্ক পাখি বলল- দেখ আমাদের জীবন খুবই সুন্দর। আমরা নিজেরা কাজ করি। খাবার সংগ্রহ করি। তারপর ঘরে এসে ঘুমাই। আমাদের মধ্যে কোনও কোলাহল নাই। কোনও বিভেদ নাই। কিন্তু যার জন্য আমরা এমন সুখে, উনি আমাদের একটি কাজে খুবই বেজার। পাখিরা চিন্তিত হয়ে পড়ল। কি এমন কাজ তারা করে যার জন্য উনি এমন বেজার। পাখিরা উত্তর খুঁজে পেল না। পরদিন বুড়ো পাখিটি সবাইকে জিজ্ঞেস করল কিন্তু সব পাখিই জানাল যে তারা এর উত্তর খুঁজে পায়নি। বুড়ো পাখিটি বলল- আমাদের বিপদ খুবই সন্নিকটে। যার জন্য আমরা এতটা সুখী তাকেই আমরা মনে করতে পারছি না। সে কি কারণে বেজার তা আমরা মনেই করতে পারছি না। বুড়ো পাখিটা বলল- সকালে আমরা গান গেয়ে কাজে বের হই। এটা খুবই খারাপ কাজ। গান কখনও ভাল কিছু না। গান গাইলে আমাদের মনের কথাগুলো সবাই জেনে যায়। এমনকি শিশু পাখিরাও বড়দের মনের কথা জেনে ফেলে। পাখিদের সমাজ নিশ্চয়ই এতটা নোংরা হতে পারে না। সব পাখি বুঝতে পারল। কোনও কোনও পাখি নিজেদের অপরাধী মনে করল। সত্যিই তো আমরা এতটা খারাপ কাজ করছি। আবার কোনও কোনও পাখি বিষয়টি মেনে নিতে পারল না। গান গাইলে কি এমন অপরাধ। আমরা তো কারও ক্ষতি কিছু করি না। বুড়ো পাখিটা বলল- কাল থেকে কেউ তোমরা গান গেও না। আরকেউ যদি গান গায় তাহলে তাকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হবে। পাখিদের রাষ্ট্র এইসব অপরাধীদের শক্ত হাতে দমন করবে। এমনকি তাদের মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। পাকিদের রাষ্ট্র সবচেয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র। তার মানে এই নয় যে সবাই সবার মত করে চলবে। পাখিদেরকে রাষ্ট্রের নিয়মানুযায়ী চলতে হবে। কারণ পাখি রাষ্ট্রের যে সুখ, তা বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের। পাখিদের মধ্যে যে যুবক ও শক্তিশালী, সে যে পাখিরা গান করবে তাদের চিহ্ণিত করে সমাজ থেকে বের করে দেবার দায়িত্ব নিল। পরদিন সকালে কোনও পাখিই গান করল না। পরের দিন সকালে একটি পাখি অজান্তেই গান গেয়ে ফেলে। তাকে যুবক পাখি ধরে নিয়ে বুড়ো পাখিটার কাছে আনে। বুড়ো পাখিটা তাকে বলে- আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও তুমি খারাপ কাজ করেছ। তুমি আমাদের ধর্মের লোক হয়ে ধর্ম নষ্ট করেছ। তোমাকে শুধু সমাজচ্যুত নয়, তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। সব পাখি নিশ্চুপ হয়ে রইল। আর যেসব পাখিরা গান কেন গাওয়া যাবে না ভেবেছিল, তারা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বুঝতে পারল বুড়ো পাখিটার এসব আচরণের বিরুদ্ধে তাদের দাঁড়াতে হবে। ভিতরে ভিতরে তারা দল বাধতে শুরু করল। আন্দোলন শুরু করল। পাখিদের মধ্যে দুই দল হয়ে গেল। দুই দলের মধ্যে একদিন যুদ্ধ বাধল। দুই পক্ষের যুদ্ধে অনেক পাখি মারা গেল। এমনকি বুড়ো পাখিটাও মারা গেল। এই অবস্থায় রাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি হল। পাকিদের আরেকটি রাষ্ট্র এই যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করল। পাখিদের দুই দল একটি সমঝোতায় আসতে সম্মত হল। পাখিদের আরেকটি রাষ্ট্র দুই দল পাখিকে বলল- তোমরা আমাদের রাষ্ট্রের নিয়ম অনুসরণ করতে পার। যার গান গাওয়ার ইচ্ছা সে গান গাইবে, আর যে গান গাইতে চায় না, সে গাইবে না। দু্ই দল পাখি এই প্রস্তাবে সম্মত হল। এরপরও পাখিদের রাষ্ট্রে মাঝে মাঝে দুই দলের মধ্যে মারপিট হয়। আগের মত সুখের সেই পাখিরাষ্ট্র আর হয়ে ওঠে না।

বড়দের রূপকথা-৬

একবার কালো বিড়ালের দেশে সাদা বিড়াল দেশের প্রধানমন্ত্রী দাওয়াত পেলেন। সাদা বিড়াল প্রধানমন্ত্রী যথারীতি দাওয়াত গ্রহন করলেন এবং সময় করে সফরেই চলে আসলেন তিনি। কালো বিড়ালের দেশে তিনি ঘুরতে লাগলেন। কালো বিড়ালদের আতিথেয়তায় সাদা বিড়াল মুগ্ধ। সফর শেষে সাদা বিড়াল প্রধানমন্ত্রীর একটি কথাই মনে হতে লাগল। কোথাও তিনি কোনও কালো নারী বিড়াল দেখতে পাননি। তিনি এই কৌতুহল নিজের ভেতর আটিকিয়েও রাখতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে কালো বিড়াল দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তার এই বিষয়টা জানালেন। কালো বিড়াল প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমাদের দেশের সমাজটা অনেক রক্ষণশীল। কেউ নারীদের বাড়ির বাইরে বের হতে দেন না। এতে সাদা বিড়াল প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হলেন। তিনি বললেন, দেখ তোমাদের জাতির কখনই উন্নতি হবে না। নারীরাই জাতি বানানোর কারিগর। তাদেরকে যদি ঘরের ভেতর বন্দি করে রাখ, তাহলে সেই জাতি অন্ধকারেই থেকে যাবে। কালো বিড়াল প্রধানমন্ত্রী সাদা বিড়াল প্রধানমন্ত্রীর কথা স্বীকার করে নিলেন। সাদা বিড়াল প্রধানমন্ত্রী বললেন, নারী উন্নয়নে তোমাদের দেশে যে কোনও ধরনের সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত। কালো বিড়াল তার দেশের নারী উন্নয়নে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। সত্যি সত্যি কালো বিড়ালের দেশ নতুন আরেকটি দেশে পরিনত হল। এক সময় সেখানে নারীরা এতটাই উন্নতি করল যে অফিস, আদালত, ব্যাংক, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গাতেই বেশির ভাগ ছিল নারী কালো বিড়াল। সেখানে এখন সাদা বিড়ালদেরও অবাধ যাতায়াত। দেশের ব্যবস্থাটা এমন করা হয়েছিল যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে নারীদের এগিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। একটা সময় দেখা গেল কালো বিড়ালের দেশে সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত কেবল নারী কালো বিড়ালরাই। এটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে নারী কালো বিড়াল তাদের সমান যোগ্যতার কোনও পুরুষ কালো বিড়াল খুঁজে পাচ্ছিল না। একজন-দুইজন নারী কালো বিড়াল পুরুষ সাদা বিড়ালকে বিয়ে করতে শুরু করল। পুরুষ সাদা বিড়াল এত সুন্দর আর ধনাড্য যে নারী কালো বিড়ালরা তাদের দিকেই ঝুঁকে গেল। এক পর্যায়ে দেশের প্রায় সব কালো নারী বিড়ালরাই পুরুষ সাদা বিড়ালদের বিয়ে করে ফেলল। ওদের নতুন বংশধর তৈরি হল, যা সাদা বিড়ালও নয় আবার কালো বিড়ালও নয়। একদিন কালো বিড়ালের দেশে কোনও কালো বিড়াল খুঁজে পাওয়া গেল না।

বড়দের রূপকথা-৭

বাঘের দেশে একবার এক মহত উদ্যোগ নেওয়া হল। উদ্যোগটা ছিল দেশ স্বধীন হবার পর এত এত খারপ ঘটনা ঘটেছে যে যারা দেশ স্বাধীন করেছে তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান পায়নি, তাদেরকে সেই সম্মানটা দেওয়া। সেই অনুযায়ী বাঘ দেশের প্রত্যেকটা জেলায় মুক্তিযুদ্ধের তালিকা করা শুরু হল। এই তালিকার পর তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে এবং তারপর তারা নানা সুবিধাদি পাবে।
সেই সময় এক বাঘ মুক্তিযোদ্ধা সেই তালিকায় না লেখাতে গেল। এই বাঘ মুক্তিযোদ্ধা খুবই দরিদ্র। লেখাপড়া জানে না। তাকে বলা হল- আপনি যে মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ কি? আপনি কি সরকারি দর করেন? বাঘ মুক্তিযোদ্ধা বলল, না তবে মুক্তিযুদ্ধে আমার পায়ে গুলি লেগেছিল। সেই থেকে আমি পঙ্গু।
তাকে আবার বলা হল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কোনও পত্রিকায় আপনার নাম উঠেছে। পঙ্গু বাঘ মুক্তিযোদ্ধা বলল, না তবে মুক্তিযুদ্ধে আমার পায়ে গুলি লেগেছিল। সেই থেকে আমি পঙ্গু।
তাকে আবার বলা হল, আপনি যে মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ কি? আপনি তো সরকারি দল করেন না। সে সময়ে পত্রিকায় আপনার কোনও নাম নেই। আপনি তো এক্সিডেন্ট করেও পঙ্গু হতে পারেন।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালযের ওই তরুণ কর্মকর্তা বলল- শুনুন এর চেয়ে আপনি সরকারি দলে যোগ দিন আর কিছু বখশিশ আমাকে দিয়ে দেবেন। আপনাকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেব।
পঙ্গু বাঘ মুক্তিযোদ্ধা সেই তরুণ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে অফিস থেকে বের হলেন। তারপর তার স্বাধীন করা দেশের ওপর হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেলেন।

বড়দের রূপকথা ৮

সিংহদের দেশে একবার ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ধর্মযুদ্ধ মানে এক দলের বক্তব্য এটাই আমাদের দর্ম আরেক দলের বক্তব্য ওটা নয়, এটাই আমাদের ধর্ম। এই জাতীয় যুদ্ধ। মানে একদল বলছিল রাষ্ট্রকে ধর্মের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, এর ভিতর দিয়েই ধর্ম রক্ষা পাবে। মানে রাষ্ট্রকেই ধর্ম বানাতে হবে। আরেক দলের বক্তব্য না রাষ্ট্রে যেহেতু অন্য ধর্মও আছে কাজেই রাষ্ট্রকে ধর্মীয় বানান যাবে না। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে হবে মানে যে ধর্মের সিংহরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই ধর্মকে প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু কোনও দল এই প্রশ্ন তুলল না যে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে যখন এক ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তখন সেটা আর ধর্ম নিরপেক্ষ থাকে না। সেটাও হয় ধর্মীয় রাষ্ট্র। এই প্রশ্ন না তোলার ভিতরে দুই দলেরই কারসাজি আছে বলে মনে করল কোন কোন সিংহ। তাদের ধারণা উভয়েই ধর্মীয় রাষ্ট্র চায়। একদল শুধুমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দটি সামনে আনে। মূলত পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ এক ধর্মের সিংহের কথা তুলে আবারও সেই ধর্মের বর্মেই রাষ্ট্রকে আটকে রাখা হয়। তারপরও দুই দল হয়। কারণ সাধারণ সিংহরা এই সব শব্দের মারপ্যাঁচ ধরতে পারে না। দুই দল সিংহের মধ্যে তর্ক হয়, মারপিট হয়। সাধারণ সিংহেরা মারা যায়। কিন্তু দুই দলের ভিন্ন ভাবে একই চাওয়া ধর্মীয় রাষ্ট্রটাই টিকে থাকে। মানে রাষ্ট্র ধর্মের ভিতরে আটকে থাকে। এবং ক্রমাগত সিংহদের রাষ্ট্র একদিন মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাধারণ সিংহেরা বুঝতে পারে না, এসব কেন হয় আর কিভাবে হয়।

বড়দের রূপকথা ৯

প্রজাপতি রাষ্ট্রে একবার এক প্রজাপতি পুলিশ দেদারছে ঘুষ খাওয়া শুরু করল। তার ঘুষ খাওয়া এই পর্যায়ে চলে এসেছিল যে তার সাথে কেউ দেখা করতে গেলেও এমনি কথা বলতেও ঘুষ দিতে হত। পত্র-পত্রিকায় তার নামে হাজারও রিপোর্ট। তাতে তার কিছু যায় আসে না। তার অনেক টাকা। অনেক ধন –সম্পত্তি। শহরে বাড়ি করেছে। গাড়ি করেছে। সবই ঘুষের পয়সায়। রাষ্ট্র আর কয় টাকা দেয়। একদিন তার কি জানি মনে হল আর সেদিন থেকেই ঘুষ খাওয়া বন্ধ করে দিল। মানে তার হয়ত মনে হয়েছিল অনেক ঘুষ সে জীবনে খেয়েছে। সব কিছুরই তো একটা সীমা-পরিসীমা আছে। একবার যদি সে ফেসে যায় তাহলে আর সে উঠতে পারবে না। তাই ফেঁসে যাবার আগে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দেওয়াটা অনেক ভাল। একদিন গেল দুই দিন গেল । সে ঘুষ নিল না। এভাবে এক মাস- দু মাস; সে ঘুষ নিল না। একদিন তার নামে প্রোমোশনের অর্ডার এল। কিন্তু এর সাথে অর্ডার ছিল পোস্টিংয়েরও। তাকে গ্রামে পোস্টিং দেওয়া হল। প্রজাপতি পুলিশটি মনে মনে ভাবল- ভালই হল এবার ঘুষ না নিয়ে গ্রামে শান্তিতে বসবাস করা যাবে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে সে সৎ ভাবে কাজ করা শুরু করল। কিন্তু সেখানকার তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মিলল না। কারণ সে ঘুষ না খেলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘুষ খেতে পারে না।তাকে বাধ্য হয়ে আবারও ঘুষ খেতে হল। কিন্তু এক দুই-পয়সার ঘুষ সে খেতে পারে না। কেমন যেন তার অস্বস্তি লাগে। তাই সে আবারও আগের মত ঘুষ খাওয়া শুরু করল। মানে প্রজাপতি পুলিশকে এখন আবার দেখতে হলে এমনকি কথা বলতে হলেও ঘুষ দিতে হয়।

বড়দের রূপকথা ১০

একবার কাকদের রাষ্ট্রে একজন বিজ্ঞানী বিশেষ একটি খাবার তৈরি করলেন। তিনি সরকারকে জানালেন এই খাবার খেলে দেশের খুন-খারাবি, অত্যাচার-নির্যাতন মারপিট মোট কথায় সকল ধরনের অপরাধ কমে যাবে। কারণ খাবারের মধ্যে এমন কিছু উপাদান দেওয়া হয়েছে যা অপরাধের প্রবণতা কমায়। মানে শরীরের যে সমস্ত জিন অপরাধের জন্য দায়ী তার ঠিক পাল্টা জিন এই খাবারে রয়েছে। কাকদের সরকার খুব খুশি হল। ড. কাককে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কাকেদের রাষ্ট্রপ্রধান এই শুভ সংবাদ দেশবাসীকে জানাতে বললেন এবং ড. কাক তাই করলেন।

এরপর দেশের নানা আনাছে-কানাচে এই খাবার পাঠান হল এবং এই খাবার কেনার ধুম পড়ে গেল। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সত্যি সত্যি কাকেদের দেশে অপরাধ কমে গেল। শুধু কমল না ভয়াবহভাবে কমে গেল। ড. কাকের এই উদ্ভাবনীতে রাষ্ট্রপ্রদান খুশি হয়ে বিশেষ সম্মাননা দিলেন এবং ড. কাকের সমস্ত ধরনের ব্যয়-ভার সরকার নিয়ে নিলেন।

ছয় মাস পর দেখা গেল দেশের যে সমস্ত দোকানে এই সব খাবার, তার চাহিদা এত পরিমাণ বেড়ে গেল যে সরকারকে এই খাবার সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হল। একদিন কোনও দোকান থেকে এই খাবার চুরি হল। এর পর আরেকদিন দেখা গেল এই খাবারের জন্য ভয়নক মারপিট হল কাকেদের মধ্যে। একদিন খুনও হল এক কাক। এভাবে এই খাবারের জন্য আবারও অপরাধ বাড়তে লাগল।

বড়দের রূপকথা ১১

এক দুই বানর আলাপ করছিল দেশের যে অবস্থা তাতে দেশের মাটিতে আর পা রাখা যাবে না। আরেকটি বানর বলল- তাহলে কি করব। আগের মতই এক গাছের ডাল থেকে আরেক গাছের ডাল এইভাবে আমরা চলাচল করব না দেশের এই অব্স্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা কাজ করব। প্রথম বানরটি বলল- দেশের যে অবস্থা তাতে এই অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাও মুশকিল। আগের মতই এক গাছের ডাল থেকে আরেক গাছের ডাল- এই ভাবে আমরা চলাচল করব।
তো কিছু বানর মাটিতে পা রাখা ছেড়ে দিল। এক গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে চলতে লাগল আরেক গাছের ডালে। অনেকদিন পর এইভাবে চলতে গিয়ে কিছু বানর সমস্যা টের পেল। তারা বলল- আগের মত গাছ আর নেই। এখন এক গাছ থেকে আরেক গাছের দূরত্ব অনেক বেশি। কিছু কিছু এলাকায় গাছই নেই যে কারণে অনেক জায়গায় যাতায়াতই করা যায় না। এই আবস্থায় সেই প্রথম বানরটি পরামর্শ করল – কি আর করা যাবে। এইভাবে তো বেশিদিন চলাচাল করা যাবে না। আমাদের মাটিতে নেমে এই দেশের সরকারকে গাছ লাগাতে হবে।

বানররা মাটিতে পা ফেলে সরকারকে তাদের কথা জানাল। সরকার গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করল। আরকেটি বানর বলল- আমরা যদি মাটিতে পা ফেলে সরকারের বিরুদ্ধে গাছ লাগানোর দাবিই তুলতে পারলাম, তাহলে কেন দেশের ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে দাবি তোলা যাবে না। তাহলে তো আর সমস্যাই থাকবে না। আমরা গাছের ডালেও চলাচল করতে পারব আবার মাটিতেও পা ফেলতে পারব। মাটিতে পা যেহেতু ফেলতেই হল তাহলে আমরা ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলনই করি না কেন? অনেক বানরের এই কথা যৌক্তিক মনে হল। সরকার বলল- তোমাদের তো একটা দাবি আমরা পুরণ করেছিই। এত দাবি তো আমরা পূরণ করতে পারব না। বানরা ফিরে গেল আর ভাবতে লাগল এখন তাদের গাছের ডালেই চলাচল করতে হবে। কেউ কেউ ভাবল প্রথম দাবিটা যদি গাছ লাগানোর দাবি না হয়ে সরকার ব্যবস্থা পরির্র্তনের দাবি হত,  আর মাটিতে পা ফেলা বন্ধ করে গাছের ডালে ডালে চলাচল করার সিদ্ধান্ত না নেওয়া হত; তাহলে এত আর সমস্যা হত না।

বড়দের রূপকথা-১২

একবার রাজহাঁসের দেশে পরিবেশবাদীরা খুব ক্ষেপে গেল। ক্ষেপে গেল মানে বড়লোক রাজহাঁসদের এলাকায় একটি পুকুর ছিল। সরকার ওই পুকুর ভরাটের টেন্ডার দিয়েছিল। টেন্ডার দেবার পরপরই বড়লোক পরিবেশবাদী রাজহাঁসেরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মানববন্ধন করল। স্লোগান দিল। পরিবেশবাদী তারপর বড়লোক সরকার একটু বিব্রতই হল। মিডিয়া প্রশ্নহীনভাবে পরিবেশবাদীদের পক্ষ নিল। আসলেই রাজধানীতে তো কোনও পুকুর নেই। এ‌ই পুকুরটাও যদি ভরাট করা হয়, তাহলে রাজধানীর হবে কি? পরিবেশবাদীরা বড়লোক হলে কি হবে,ওরা সত্যিকারের রাজধানী উন্নয়নের পক্ষে। এই অবস্থায় সরকার বাধ্য হয়ে পুকুর ভরাটের টেন্ডার বাতিল করল। আন্দোলনও থেমে গেল।

এখন প্রতিদিনই বড়লোক ঘরবাড়িগুলো একটা দুইটা ঘরবাড়ি ময়লা-আবর্জনা পুকুরে ফেলতে পারে। অন্যান্য ঘরবাড়িগুলোও তাদের দেখাদেখি পুকুরে ময়লা ফেলা শুরু করল। এভাবে পুকুরে ফেলতে ফেলতে একদিন পুকুর ভরাট হয়ে গেল। সেই পুকুরে একদিন রাতে প্রভাবশালী এক বড়লোক দখল করে নিল। পরদিন সকালে সরকার তাদের উৎখাত করে নিজেদের সাইনবোর্ড বসিয়ে দিল। বড়লোক রাজহাঁসেরা এরপর থেকে তাদের ঘরবাড়িতেই থাকা শুরু করল। তারা এখন আর পুকুরে নামে না।

বড়দের রূপকথা-১৩

একবার শিয়ালদের দেশে এক শিয়াল সাংবাদিক মারা গেল। অন্যান্য শিয়াল সাংবাদিকরা এতে ক্ষেপে গেল। ওই দেশের সকল মিডিয়ার সকল সাংবাদিক এক জোট হয়ে গেল। এই হত্যার বিচার করতেই হবে। শিয়াল সাংবাদিকরা নানা কর্মসূচি দিল। মিছিল করল। স্লোগান দিল। শিয়াল সরকার এই ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করল। সরকার জানাল- সর্বোচ্চ চেস্টা করছে সরকার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই খুনের কোনও রহস্য উদঘাটন বা ক্লু পাওয়া যায় নি যা দিয়ে বিচার এগুনো যাবে। তবে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সাংবাদিকরা ক্ষেপে গেল। যে দেশে সাংবাদিক হত্যা হয়, যে দেশের সরকার সাংবাদিক হত্যা ঠেকাতে পারল না; সে দেশের সরকার আবার কিসের সরকার।  তারা আরো বড় করে আন্দোলন শুরু করল। কোনও কোনও সাংবাদিকের ধারনা হল- সরকার এই খুনের বিচার করতে পারছে না, কাউকে আটকাতেও পারছে না। সরকারই বোধহয় এই খুনের সাথে জড়িত। সাংবাদিকরা সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিল। মিছিল করল। সমাবেশে সরকারের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি নেওয়ার ঘোষণা দিল। এক বছর গেল। সরকার কিছুই করতে পারল না। সাংবাদিকরা আরও কঠোর কর্মসূচির কথা ভাবল। এই অবস্থায় সাংবাদিকরাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। এক দল বলল- সরকার চেষ্টা করছে, এই অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া ঠিক হবে না। আরেক দল বলল- না, সরকারের কোনও ইচ্ছা নেই বলে এর বিচার হচ্ছে না। আমাদের কঠোর কর্মসূচি দিতেই হবে। এতে করে সাংবাদিকরা দুই ভাগ হয়ে গেল। এইভাবে আরো এক বছর গেল। দুই দলের ভেতর কারা নেতৃত্বে আসবে তা নিয়েও ঝামেলা হল। ধীরে ধীরে কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের আসার সংখ্যা কমে এল। এই অবস্থায় সাংবাদিকদের মধ্যে আরও একটি দল দেখা দিল। তারা বলল- এই দুই দল সাংবাদিকের এক দল সরকারি। আরেক দল বিরোধি দলের। এদের দিয়ে কোনও আন্দোলন হবে না। তাই তারা নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছে। একদিন এই আন্দোলন থেমে গেল। তারপর হঠাত একদিন এই খুনের ব্যাপারে সরকার মুখ খুলল। সরকার বলল- এই খুনের পেছনে সাংবাদিকরাই জড়িত। সাংবাদিকরা এই ঘটনায় কোনও  প্রতিবাদ করল না।

বড়দের রূপকথা-১৪

হরিণদের দেশে একসময় সমস্ত বাবা হরিণরা সন্তান হরিণদের ওপর ক্ষেপে গেল। বাবা হরিণদের অভিযোগ- ছেলে-মেয়েরা এখন আর তাদের কথা শুনে না। গান শুনতে গেলে দেখা যায়- কি এসব জ্যাজ, রক বাংলা গানে মিশিয়ে ফেলছে। নাটক দেখা যায় না। খালি প্রেম আর বিপ্লব। সাহিত্য পড়া যায় না। আগের মত সাহিত্য আর নাই। মনে হয় পাড়ার বখাটেরা এসব লিখে রেখেছে। না আছে ভাষা, না আছে বোধ। আবার ইন্টারনেট এসেছে। যে যার মত যা খুশি বলে যাচ্ছে।  লিখে যাচ্ছে। বলা আর লেখারও তো একটা সৌন্দর্য থাকে। বাবারা সরকারকে প্রভাবিত করল। তারা বলল- সরকার যেন এমন কিছু করে যাতে করে ছেলে-মেয়েরা এত স্বাধীনতা না পায়। বড়দের সম্মান করে। বড়দের কথা শুনে। দেশের জন্য কাজ করতে হলে তো বড়দের কথা শুনতে হয়। এখনকার তরুণ প্রজন্ম বড়দের কথাই মানে না, দেশের জন্য কি করবে। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এখনও পর্যন্ত কাজ কি তেমন করি নাই। এসব তরুণরা তো কিছুই মানতে চায় না। সরকার ব্যবস্থা নিতে রাজি হল।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সব হরিণ ছেলে-মেয়েরা জমায়েত হল। তারা সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল ও সমাবেশ করল। তারা বলল- আমরা কখনোই বড়দের বিরুদ্ধে নই। আমরা নতুন একটি দেশের পক্ষে। সময় অনেক পাল্টেছে। একশ বছর আগের ধারনা নিয়ে বসে থাকলে দেশ আর এগুবে না। আমরা যা করছি দেশের ভালোর জন্যই করছি। তাদের ব্যর্থতাকেও স্বীকার করে নিতে হবে। তারা যা পারেনি আমাদের তা করতে হবে। কিন্তু আমরা জানি তাদের মত চিন্তা করে এইসব ব্যর্থতাকে বিজয়ে আনা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের মত করে এগুতে চাই। দেশকে ধ্বংস করে নয়, দেশের সাথে একাত্মতা হয়ে আমরা নতুন কিছু করতে চাই। সরকার এদের ওপর লাঠিচার্জ করল। কিন্তু তারা সরল না। বরং উল্টো অনশনের ডাক দিল হরিণ ছেলে-মেয়েরা। এদিকে সবার বাড়িতে মা হরিণরা কান্নাকাটি শুরু করল। এক পর্যায়ে বাবা হরিণরা সন্তান হরিণদের দাবি মনে নিল। তরুণ  হরিণরা নতুন উদ্যোমে বিশ্বের সাথে তাল রেখে দেশ গঠন করতে লাগল।

বড়দের রূপকথা-১৫

একবার ইঁদুরদের দেশে দুই দল ইঁদুর উন্নয়ন বিতর্কে নেমে গেল। একদল বলল- আমাদের ধানক্ষেতে করা গর্তে ধান সংগ্রহ করা উচিত। আবার আরেক দল বলল- না, ধান ক্ষেতের ভেতর নিজেদের করা গর্তে ধান সংগ্রহ করা উচিত নয়। এতে করে ভাল উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দ্ই দল ইঁদুর অন্যের চাষ করা ক্ষেত থেকে কিভাবে ধান সংগ্রহ করা উচিত, এ নিয়ে মহাতর্কযুদ্ধ শুরু হল। কিন্তু ইঁদুরদের কোনও পক্ষই বলছিল না, আমরা অন্যের ধানক্ষেত থেকে ধান সংগ্রহ করি। এটা আমাদের করা উচিত না। আমাদের নিজেদেরই ধান চাষ করা উচিত।

উন্নয়ন বিতর্ক এতদূর এগোল যে দুই দল ইঁদুরের মধ্যে যুদ্ধ হল। এতে করে যে সমস্ত ইঁদুর ধান ক্ষেতে গর্ত করে ধান সংগ্রহ করার পক্ষে তারা জিতে গেল। হেরে যাওয়া ইঁদুরদের দিয়ে এরা দাস হিসেবে ধান সংগ্রহ করে ধান ক্ষেতে করা গর্তে ধান সংগ্রহ করাতে লাগল।  একদিন ধানক্ষেতটি যার, সে ট্রাক্টর দিয়ে ইঁদুরদের সমস্ত গর্ত গুড়িয়ে দিল আর সংগ্রহ করা ধানগুলো মিশে গেল ধানক্ষেতের মাটিতে।

বড়দের রূপকথা-১৬

এক দেশে ছিল এক মশা কবি। সে সারাক্ষণ গুণগুণকরে গান করত আর কবিতা পড়ত কাউকে অপছন্দ হলেই মশা তাকে কামড় দিয়ে আসত। একদিন মশা শহরের সবাইকে বলে আসল, তোমরা যদি আমাকে প্রতিদিন কবি মশা, কবি মশা বলে না ডক, তাহলে আমি তোমাদের কামড়াব। এমন কামড়াব যে মশাদের কামড় খেয়ে তোমরা শহর পালাতে বাধ্য হবা। কবি মশার এই হুমকিতে শহরের মানুষ আসরেই ভয় পেয়ে গেল। সত্যি সত্যি কবি মশা যদি কামড়াতে শুরু করে, তাহলে আমাদের শহর ছেড়ে পালাতেই হবে; এর চেয়ে বরং কবি মশা বলে ডাকলে মশারও কবিতা লেখার উৎসাহ বাড়ল আর আমরাও মশার কামড় থেকে রক্ষা পেলাম।

এখন প্রতিদিন সবাই কবি মশা, কবি মশা বলে জপ করে। শহরের মানুষ বেশ সুখেই আছে। কোনও মশাই একন আর কামড় দেয় না।এইভাবে কতদিন আর জপ করবে। জপ করতে করতে একদিন শহরে দুই একজন মানুষ ভুলে যেতে লাগল যে জপ করতে হবে।  এবং তারা দেখতে পেল যে, তাদেরকে মশারাও কামড়াচ্ছে না। এইভাবে মশা না কামড়ানোও শহরের সবাই ভুলেই গেল কবি মশার কথা। অনেকদিন পর কবি মশা দেখা দিল। শহরের সবাই বেশ ভীত। তারা তো কবি মশা জপ করতে ভুলেই গেছে। মশারা নিশ্চয়ই এখন বড় ক্ষতিকর কিছু একটা করবে। সবাই চুপচাপ হয়ে রইল। কবি মশা নিজে থেকেই বলল- তোমরা আমাকে ভুলে গেছ বলে আমি কিছু মনে করি নাই। আমি জানতাম কবি মশা ডাকতে তোমরা ভুলে যাবে। আমি অবশ্য তোমাদের কিছুই বলব না এবং সত্যিকার অর্থে তোমরা যে ভাবছ আমি হযত খারপ কিছু করব সেটাও হয়ত করব না। কেননা আমি নিজেই কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি এবং আমি বুঝে গেছি কবিতা লেখা সবাইকে দিয়ে হয় না।

বড়দের রূপকথা- ১৭

বোয়াল মাছের সাথে অন্য ছোট মাছদের সম্পকর্টা ঠিক কি রকমের এটা রূপকথাটি না বলা পর্যন্ত বোঝা যাবে না। বোয়াল মাছটি এই পুকুরে একটাই। সে সব মাছেদের হর্তা-কর্তা। মানে নির্বাচিত এমপি। তার কথা মতই এই এলাকা চলে।  তবে বেশি ছোট মাছগুলো বোয়াল মাছকে ভয়টা একটু বেশিই পায়। কেননা বোয়াল এমপি একটু ক্ষেপে গেলেই ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলে। পুকুরের সব মাছ এই কথা জানে। কিন্তু বোয়াল মাছের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। নির্বাচনের সময় তাকেই ভোট দিতে হয়। বোয়াল মাছটি যখন পুকুরে ঘুরতে বের হয়, অনেক ছোট ছোট মাছও তার সাথে থাকে। বোয়াল মাছ তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়। এই ছোট মাছগুলো পুকুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর সংগ্রহ করে বোয়াল মাছকে জানায়। কোথায় কোনও ছোট মাছ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে, ছোট মাছ বোয়াল এমপিকে খবর দেয়। পরে বোয়াল মাছটি এসে ছোট বিদ্রোহী মাছটিকে খেয়ে ফেলে।

এবারও নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। বোয়াল মাছ ছোট ছোট মাছদের জন্য অনেক বড় বড় কয়েকটি খাবারের আধার স্থাপন করেছে পুকুরে। অনেক ছোট মাছের এখন আর খাবার সংগ্রহ করতে হয় না। আধারের কাছে এসেই দিনের সব খাবার পেয়ে যায়। নির্বাচন শুরু হবার এক মাস আগে এই আধার স্থাপন করাতে সব ছোট মাছই খুশি। তাছাড়া বোয়াল মাছ প্রত্যেক ছোট মাছের বাসায় এসে দেখা করেছে। ছোট মাছেরা আলাপও করেছে, যে মাছ  আমাদের মত ছোট মাছদের এক নিমিষেই খেয়ে ফেলতে পারে, সে আমাদের না খেয়ে  আমরা ভাল আছি কিনা এটা জিজ্ঞেস করে গেছে। এটা সত্যিই মহান বোয়ালদের কাজ। তাছাড়া সে আমাদের জন্য অনেক বড় বড় খাবারের আধার স্থাপন করেচে পুকুরে। গত দিনগুলোতে কাজ না করলেও নির্বাচনের সামনে সে যে কাজ করেছে, তাতেই ছোট মাছ খুশি। নির্বাচনের সময় এল। ছোট ছোট মাছ বিনা প্রশ্নে বোয়াল মাছকে ভোট দিয়ে আবারও জয়যুক্ত করল। সেদিন রাতেই খুশি হয়ে বোয়াল মাঝ অনেকগুলো ছোট মাছ খেল।

বড়দের রূপকথা- ১৮

ভোদরদের দেশে একবার এক ভোদর বেশ বিপদে পড়ল। বিপদে পড়ে সে থানায় এসে জানাল যে তার সব জমি এমনকি থাকার জমিও লোকজন দখল করে ফেলেছে। থানা থেকে বলল- মামলা করেন। পথে মধ্যে ভোদরের আরেক ভ্দ্র ভোদরের সাথে দেখা হল। সেই ভদ্র ভোদর পরামর্শ দিল – মামলাও যাইও না। তোমার আরও বিপদ হবে। তুমি বরং কাছারি যাও। গিয়ে দেখ, তোমার জমির কি অবস্থা। বিপদে পড়া ভোদর ভাবল- কথাটা মন্দ না। সে কাছারিতে গেল। সেখানে গিয়ে তার জমির অবস্থা জানতে চাইল। সেখানে ম্যাপ দেখে তারা জানাল, কোনও জমিই তো তার নামে নেই- এগুলো তো অনেকদিন আগে থেকেই অন্যের জমি।

ভোদর বলল- এসব আপনারা কি বলছেন। আমি তো অনেকদিন ধরেই এখানে থাকি। আমি অনেক আগেই এসব জমি কিনেছি। এসব কবে অন্যের হয়ে গেল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কাছারি থেকে বলা হল- দেখুন আপনার জমির কাগজপত্র তো লাগবে। শুধু মুখে বললে তো হবে না। আমাদের এখানে যেসব কাগজপত্র আছে তাতে কোথাও আপনার নাম লেখা নাই।

ভোদরের খুবই মন খারাপ। সে বাসায় গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু কোথাও কোনও কাগজপত্র খুঁজে পেল না। এমনকি জমি কেনার সময় সে কোনও খাজনা বা কাগজপত্র রেখেছিল কিনা তাও মনে করতে পারল না। ভোদর মনে মনে ভবছে- সে এখন সর্বস্বান্ত। কোনও ভাবেই এখন আর সে জমি খুঁজে পাবে না।

রাতে তার একটি বুদ্ধি এল। কাছারিতে টাকা দিয়ে সে ম্যাপে তার নাম লিখাবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠেই ভোদর কাছারিতে চলে এল। মিষ্টি এনে সবাইকে খাওয়াল। সাথে বড় সাহেবকে অনেক টাকা তুলে দিল। কাছারির বড় সাহেব বলল- দেখুন, আপনাকে সত্যি কথাটিই বলি।  আপনি যতই টাকা খরচ করেন এখন আর কোনও লাভ হবে না। যারা টাকা দিয়ে এসব জমির নাম লিখিয়ে নিয়েছে তারা অনেক ধনী লোক এবং প্রভাবশালী। আপনি টাকা দিয়ে আপনার এসব জমি ফেরত পাবেন না। এখন কেবল একটাই পথ, আপনাকে কাগজপত্র দেখাতে হবে। এটা হলে আমরা চেষ্টা করতে পারি। ভোদরের্এসব কথা মনে ধরল না। সে মামলা করল। আইনজীবীকে বোঝাল যে এসব তারই জমি কিন্তু তার হাতে কোনও কাগজপত্র নাই। কয়েকজন খারাপ লোক টাকা দিয়ে তার জমি নিজেদের করে নিয়ে নিয়েছে। এই মামলায় ভোদরের অনেক টাকা খরচ হল। কিন্তু কোনও ভাবেই কাগজ ছাড়া প্রমাণ করতে পারল না যে এসব তারই জমি মানে মামলায় ভোদর হারল। এবং ভোদর সর্বস্বান্ত হল। ভোদর বুঝতে পারল, সে এক জায়গায় অনেকদিন ধরে বসবাস করলেও, এমনকি সেই জায়গা কেনা থাকলেও কোনও মূল্য নেই যদি না তার কাছে কোনও কাগজপত্র না থাকে।

বড়দের রূপকথা- ১৯

পাখিদের দেশে নারী পাখি-পুরুষ পাখির কোনও ভেদাভেদ ছিল না। তারা উভয়েই মিলেমিশে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাত। একবার পাখিদের ভেতর ধর্ষণের প্রবণতা বেড়ে গেল। কোন কোন পাখি ধর্ষণ করে এটাও সব পাখির জানা ছিল। কিন্তু কেউ কিচ্ছু করতে পারছিল না। এক পর্যায়ে নারী পাখিরা আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনে পুরুষ পাখিরাও থাকে। আন্দোলন এতটা বড় আকার ধারন করে যে ধর্ষক পাখিরা শাস্তি পায়। নারী পাখিরা এসব ঘটনার পর থেকে বেশ সচেতন। তারা আগের চেয়ে অনেক স্বাধীনতাও ভোগ করতে লাগল। এখন ধর্ষণ নয়, সামান্য টিজ করলেই যে কারও বিরুদ্ধে থানা হাযত করা যায়।

অনেক দিন দেখা গেল, কিছু কিছু ধর্ষক পাখি আন্দোলনকারী নারী পাখিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। এটা নারী পাখিদের সাথে আন্দোলন করা পুরুষ পাখিরা মেনে নিতে পারল না। পুরুষ পাখিরা এসব নিয়ে কানাঘুষা শুরু করল। এদের দল নেতা পুরুষ পাখির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী নারী পাখিরা নারী হয়রাণির অভিযোগ আনল। কেন এ‌ই অভিযোগ আনা হল- তা অন্যান্য পুরুষ পাখিদের বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু কোনও পুরুষ পাখিই এসব নিয়ে এরপর থেকে কথা বলতে সাহস পেল না। কেবল পুরুষ পাখিদের ভেতরে জ্বলতে থাকল আগুন প্রতারণার।

বড়দের রূপকথা- ২০

এক দেশে  ছিল এক বানর বিচারক। এই বিচারক সব সময়ই কারো না কারো কাছ থেকে কিছু খেত। এমনকি বিচার কাজের সময়ও সে খেত। তবে বিচার কাজের সময় নিয়ম ছিল যে দোষীকে খাওয়াতে হবে। সে যা খাওয়ায় তাতেই হবে। একবার খুনের মামলার আসামি বিচার কাজের সময় বিচারককে বাদাম খাইয়েছিল। বিচারক খুশি হয়ে তাকে ভাতের পরিবর্তে বাদাম খাওয়ার শাস্তি দিয়েছিল।

একবার চুরির মামলায় আসামি বিচারককে বিচারকাজের সময় লজেন্স খাইয়েছিল। বিচারক চোরকে সাজা হিসেবে ভাতের পরিবর্তে লজেন্স খাওয়ার শাস্তি দিয়েছিল।

তবে একটা বিচার নিয়ে একবার আদালতে বেশ সরগোল হয়েছিল। এই বিচারকের ছেলেই একটি ধর্ষণ মামলায় আটক হয়েছিল। বিচারকাজ চলার সময় বিচারক ছেলের কাছ থেকে কিছুই খায়নি। কারণ ছেলের কাছ থেকে কি খাবে সে, বিচারক স্বয়ং বাবা, ছেলেকে কিভাবে মামলা থেকে ছাড়িয়ে আনা যায় তা নিয়েই ছিল চিন্তিত। কিন্তু নিয়তির এমনই নির্মম পরিহাস, ছেলের কাছ থেকে বিচারক কিছু না খাওয়ার কারণে, ছেলের শাস্তি হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

বড়দের রূপকথা- ২১

হনুমানদের দেশে তাত্ত্বিকদের নিয়ে বেশ সমস্যা দেখা দিল। একজন তাত্ত্বিক বলল- আমরা যেভাবে দিনের বেলা ভাত খাই, তা ঠিক নয়; আমাদের ভাত খাওয়া উচিত রাতে। এর কিছুদিন পর আরেকজন তাত্ত্বিক বললেন, না এটা ঠিক নয়। রাতের বেলা ভাত খাওয়া কখনই ঠিক নয়। খাওয়া উচিত দিনে। এরপর আরো একদল তাত্ত্বিক বলে ওঠল, না এসব কোনটাই ঠিক নয়। আমাদের রাতের বেলা নয়, এমনকি দিনের বেলাও নয়; আমাদের সত্যিকার অর্থে ভাত খাওয়া উচিত সকালে।

এই নিয়ে তিন দল তাত্ত্বিকদের মধ্যে বেশ গরম তর্ক শুরু হয়ে গেল। মিডিয়া, তাদের অনুসারীরা এবং এবং এর সাথে দেশের অনেক হনুমানও যোগ দিল। তর্কটা এতদূর এগুলো যে এ নিয়ে দেশে দাঙ্গা হওয়ার উপক্রম হল। সরকার এই তিন দল তাত্ত্বিকদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। সরকার বললেন, আমরা  আপনাদের সবার কথাই শুনেছি। কিন্তু আমাদের ধারনা ভাত একেবারে বাদ দিয়ে প্রতিদিন আলু খাওয়ানোর কথা ভাবছি এই দেশে। আপনাদের কি মত? এতে আপনাদের মতামতও ঠিক থাকল।  দাঙ্গাও হল না।  তাত্ত্বিকরা ভেবে বললেন, উত্তম প্রস্তাব। বৈঠকে তাত্ত্বিকদের আলু খাওয়ানো হল। তাত্ত্বিকরা মিডিয়াতে সবাই মিলে ঘোষণা দিলেন, যেহেতু ভাত কখন খাওয়া উচিত তা নিয়ে আমাদের মত বিরোধ আছে, সেহেতু আমার মনে হয় সকলের ভাতের পরিবর্তে আলুই খাওয়া উচিত।

এক মাস পর দেশের হনুমান আলু খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেল। কোথাও ভাত খেতে না পাওয়ায় তারা আন্দোলন শুরু করে দিল। সরকার বলল- এতে আমাদের কোনও হাত নেই। তাত্ত্বিকদের কারনেই তারা এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। হনুমানরা আরও ক্ষেপে গেল। একদিন রাতে সব হনুমান মিলে তিন তাত্ত্বিক হনুমানকে ঘরে থেকে বের করে এনে উত্তম-মধ্যম দিল এবং দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিল তারা।

বড়দের রূপকথা- ২২

বিড়াল তথ্যমন্ত্রীকে বলা হল, ফ্রিজে মোট কতটা মাছ ছিল, এটা জানাতে হবে। কেননা মাছওয়ালার দাবি, ফ্রিজে যে পরিমাণ মাছ সে রেখেছিল, তা নেই। বিড়াল তথ্যমন্ত্রী বুঝতে পারল না ঘটনাটা কি?  সে একবার ভাবল মাছওয়ালা ইচ্ছে করে তথ্যমন্ত্রণালয়কে ফাঁসাতে চাচ্ছে। আবার তার মনে হল, বিড়ালদেরও বিশ্বাস নেই। কোনও বিড়াল না জানিয়েও মাছ খেয়ে ফেলতে পারে।

তথ্যমন্ত্রী তাই দ্বিতীয় তথ্যটি যাচাইয়ের জন্য প্রশাসনকে তলব করল। প্রশাসন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখল যে আসলে সেদিন সব বিড়াল ঘুমিয়ে ছিল। কেউই জানে না যে ফ্রিজে মাছ রাখা হয়েছিল। তথ্যমন্ত্রীর প্রশাসনকেও সন্দেহ হল। কারণ প্রশাসনের সব কর্মকর্তারাও বিড়াল। মাছ বিড়ালই চুরি করে এটাই স্বাভাবিক। এবং এটা বিড়ালরা বিশ্বাস করবে না, এটাও ঠিক। কিন্তু না বিড়াল তথ্যমন্ত্রী কোনোধরনের ক্লু খুঁজে পেল না যে বিড়ালদের কেউ এই মাছ নিয়েছে। কাজেই কতগুলো মাছ ছিল তাও সে ধরতে পারল না। বাধ্য হয়ে মাছওয়ালাকে সন্দেহ করল বিড়াল তথ্যমন্ত্রী। বিড়াল তথ্যমন্ত্রী মাছওয়ালাকে সন্দেহ করায় মাছওয়ালা ক্ষেপে গেল। মাছওয়ালা মিডিয়াতে বলল- মাছ বিড়ালরাই চুরি করে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিড়াল তথ্যমন্ত্রী কোনও বিড়ালকেই ধরতে পারে নি। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে বিড়াল তথ্যমন্ত্রীই এই মাছ চুরি করেছে। কেননা মাছ বিড়ালরাই চুরি করে।

এই কথা অন্যান্য বিড়ালদের বিশ্বাস হল। তাদেরও মনে হল যে মাছ যদি চুরি হয়ে থাকে তবে সেটা বিড়ালই করেছে। আর বিড়াল তথ্যমন্ত্রী যেহেতু কোনও বিড়ালের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারে নি, কাজেই এটা বিড়াল তথ্যমন্ত্রীরই কাজ।   এই অবস্থায় মাছওয়ালা বিড়াল তথ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিড়ালদের নিয়ে আন্দোলন শুরু করল। এই আন্দোলনের ভিতর দিয়ে বিড়াল সরকারের পতন হল। বিড়ালদের সরকার হিসেবে তখন আর কোনও বিড়াল থাকল না, মাছওয়ালা হয়ে গেল বিড়ালদের সরকার।

বড়দের রূপকথা- ২৩

গাধাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই ছিল গাধা। ছাত্র-শিক্ষক-কেরানি সবাই গাধা। কারণ ওটা গাধাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়। গাধাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও ছাগল ছাত্রকে ভর্তি করান হত না আবার মানুষ ছাত্রকেও ভর্তি করান হত না। শিক্ষকও ছাগল বা মানুষ থেকে কাউকে নেওয়া হত না।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে আলাপ হত। কিন্তু সবাই ছিল একাট্টা। কারণ কোনও বিভাগে গাধা ছাড়া অন্য কোনও শিক্ষক নেওয়া হলে গাধা শিক্ষকদের ভয় বেড়ে যেত। তারা ভাবত, যদি ছাগল শিক্ষককে নেওয়া হয়, তাহলে সে এমন ছাগলামি করা শুরু করবে যে গাধা শিক্ষকরা তার সাথে পারবে না। এছাড়া ছাগল শিক্ষকেরা ছাগল ছাত্র এবং ছাগল শিক্ষকদেরও নেওয়া শুরু করবে। এতে করে গাধা শিক্ষকেরা বিপদে পড়তে পারে।

মানুষ ছাত্র বা মানুষ শিক্ষক নেওয়ার প্রশ্নই উঠত না। কারণ এদেরই বেশি ভয় গাধা শিক্ষকদের। এদের নেওয়া হলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই মানুষদের হয়ে যাবে। তখন আর কোনও গাধাকে পাওয়া যাবে না। তাই শুধু গাধাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে শুরু করল। এসব গাধা শিক্ষকরা এক সময় খেয়াল করল। তারা যে গাধা, এটা থেকে তো বের হওয়া প্রয়োজন। কেননা এভাবে গাধা হয়ে কতদিন থাকা যায়। বেশ কিছু গাধা শিক্ষক যুক্তি করল, একটা তাদের পক্ষের মানুষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার। যে শিক্ষকটি গাধাদের পক্ষেই কথা বলবে, কিন্তু সে মানুষ হওয়ার কারণে গাধারা কেবল গাধা বলেই গণ্য হবে না। এতে করে তারা মানুষ হিসেবেও গণ্য হবে। এইভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। যথারীতি সব গাধাদের বুঝিয়ে একজন মানুষ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হল। প্রথম প্রথম গাধাদের ভিড়ে বোঝা যেত না এটা মানুষ শিক্ষক। মনে হত এই শিক্ষকটিও সব গাধার মত গাধা শিক্ষক।  এইভাবে দুই তিন বছর যাবার পর আরও কিছু মানুষ শিক্ষক নেওযা হল। মানুষ ছাত্রও ভর্তি করান হল। দেখা গেল গাধাদের বুদ্ধি বেশ ভালই কাজে লেগেছে।  অনেক দিন পর দেখা গেল সেখানে কোনও গাধা শিক্ষক নেই, ছাত্র নেই এমনি কেরানি পর্যন্ত নেই।  সবাই মানুষ। সব মানুষেরা গাধাদের মত আচরণ করছে।

বড়দের রূপকথা- ২৪

ছাগলদের দেশে একবার এক দল ছাগল চলে গেল উত্তরে আর আরেকদল ছাগল চলে গেল দক্ষিণে। চলে গেল মানে দুই দল ছাগল এক দেশে থাকতে পারছিল না। যে সমস্ত ছাগলের দাঁড়ি আছে তারা বলল এই দেশে কোনোভাবেই থাকা যাবে না। এই দেশ থাকার মত নয়। এটি ধ্বংস হয়ে গেছে। আরেকদল দাঁড়ি ছাড়া ছাগল বলল- এই খানেও আমরা থাকতে পারছি না। নানা অত্যাচার নিপীড়ন করা হচ্ছে। এই দেশে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল। তবে সব দাঁড়িওয়ালা আর দাঁড়িছাড়া ছাগলই দেশ ত্যাগ করল না। অনেকেই দেশ ছাড়ল আবার অনেকেই দেশ ছাড়ল না। যারা ছাড়ল না তারা দুই তিন বছর ভাল থাকে। আবার পাঁচ বছরের মাথায় মারপিট শুরু করে। পাঁচ বছরের মধ্যে আরও অনেক দাঁড়িছাড়া ছাগল দেশ ছাড়তে শুরু করে। কিন্তু দাঁড়িওয়ালা ছাগল বাড়তে থাকে। এইভাবে দাঁড়িওয়ালা ছাগল অনেক শক্তিশালী হয়ে যায়। আর দাঁড়িছাড়া ছাগল নিরীহ, নিপীড়িত হয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে থাকে। এরপর দাঁড়িওয়ালা ছাগল এক সময়ে বেশি হয়ে যাওয়ায় তাদের মধ্যে খাদ্য-বাসস্থান অর্থাৎ অর্থনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। দাঁড়িওয়ালা ছাগলদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব যত বাড়ে, তত এই দ্বন্দ্ব দাঁড়িছাড়া ছাগলের ওপর এসে পড়ে। এক পর্যায়ে এই দেশে কোনও দাঁড়িছাড়া ছাগল দেখতে পাওয়া যায় না। দাঁড়িওয়ালা ছাগলই কেবল দেশে বসবাস করতে থাকে।  অর্থনৈতিক টানাপোড়েন যত বাড়তে থাকে ততই দাঁড়িওয়ালা ছাগলরা এবার নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে। এবার আর এই দ্বন্দ্বটা দাঁড়িছাড়া ছাগলের ওপর গিয়ে পড়ে না। পড়ে না মানে দেশে দাঁড়িছাড়া কোনও ছাগলই নেই। তাই দাঁড়িওয়ালা ছাগলদের দুই দলে ভাগ হয়ে যেতে দেখা যায়। এক দল বলে যাদের আত্মীয় স্বজন বা পূর্ব পুরুষেরা অন্য দেশে আছে, তারা এই দেশ ছেড়ে দিলেই পারে। কিন্তু এই দেশের মায়া ত্যাগ করে কেউ যেতে চায় না। এক পর্যায়ে এদের ভিতরে মারপিট, দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়। দাঁড়িওয়ালা ছাগলদের দেশে সংঘাত এখন নিয়মিত বিষয়। একদিন খুন-খারাবি আর রক্তারক্তির এক দেশে পরিণত হয় দাঁড়িওয়ালা ছাগলদের দেশ।

বড়দের রূপকথা- ২৫

দুই দেশের দুই গরু আলাপ করছিল।

এক গরু বলল: আমাদের দেশে পতাকা করের কথা বলে। যেখানে যেভাবে পতাকা উড়ানো হয়, তার ভেতরে করের কথা থাকে।

আরেক গরু বলল: কিভাবে?

গরু বলল: আমাদের দেশের পতাকায় তিনটি রঙ। লাল-নীল আর সবুজ। লাল রং কি কর দিতে হবে তার প্রতীক, নীল রং কিভাবে কর দিতে হবে তার প্রতীক আর সবুজ রং কখন কর দিতে হবে তার প্রতীক।

অপর গরুটি বলল: আমাদের দেশেও তাই। তবে আমাদের দেশের পতাকায় বাড়তি একটি সূর্য আছে।

বড়দের রূপকথা- ২৬

দুই বানর আলাপ করছিল।

: কেন আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা মসজিদ -মন্দিরে গেলেও অনেক নিরাপত্তা নিয়ে যায়?

: কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মসজিদ-মন্দিরেও মার খাওয়ার ভয় থাকে।

বড়দের রূপকথা- ২৭

পিঁপড়েদের দেশ খুবই সাম্যবাদী এবং পরিশ্রমী। এরা সকলেই খাবার সংগ্রহ করে, জমা করে এবং বিপদের সময় সকলে মিলে খায়। একবার এই পিঁপড়েদের দেশে কোকাকোলা ফোন করল। ফোন করে জানাল- আপনারা আপনাদের দেশে পতাকা পরিবর্তন করেছেন । আমরা অনেক সুবিধা দিয়েছি। আপনারা যদি  আপনাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেন তাহলে আপনাদের দেশের মানুষের পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ সকল কিছুর দায়িত্ব আমরা নেব।

পিঁপড়েদের প্রেসিডেন্ট তখন তার পিএসের কাছে জানতে চাইল- রয়্যাল কোলার সাথে চুক্তি আমাদের কবে শেষ হবে?

বড়দের রূপকথা- ২৮

শিয়ালদের দেশে চুরি বাড়তেই লাগল। বাড়িঘর থেকে জিনিসপত্র চুরি, স্কুল-কলেজের জিনিসপত্র চুরি এমনকি ব্যাংকের টাকা চুরি ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চুরি তো আছেই। শিয়ালরা এতে অতিষ্ঠ হয়ে গেল। সরকারের কিছু না করায় শিয়ালরা আন্দোলনে নামল। কিন্তু কোনই লাভ হচ্ছে না। বরং যেন চুরি আরও বাড়ছে। বাধ্য হয়ে শিয়ালরা সরকারকে আলটিমেটাম দিল। কিছু করতে না পারার ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে শিয়াল সরকার বিভিন্ন সড়ক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিকা আর ব্যানার সরবরাহ করল। তাতে লিখা ছিল-

চুরি কর না। সরকার প্রতিযোগী পছন্দ করে না।

বড়দের রূপকথা- ২৯

কাকদের দেশে কাক রাজনীতি নেতাদের মধ্যে ঝগড়া-বাদাবাদি লেগেই থাকত। সরকারি বিরোধী উভয় দলের দলনেতা কাক সারাক্ষণ কা কা করত। এ নিয়ে দেশের ভিতর একটা অশান্তির সৃষ্টি হল। এই দুই দলের কাক দুই প্রধান নেতা অনবরত মিথ্যা কথা বলত। একবার এক টকশোতে এই দুই কাককে ডাকা হল। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হল- আপনাদের দলের কাক যখন মিত্যা কথা বরে তখন তার পক্ষে আপনারা কিভাবে যুক্তি তৈরি করেন। উভয় কাকই বলল-

আমরা বলি এটা কাকের দোষ না। কাকের ঠোঁট ভিন্নভাবে নড়ে এই কথার তৈরি হয়েছে।

বড়দের রূপকথা-৩০

মশকীদের দেশে ডাকাতির পরিমাণ দিনকে দিন বাড়তেই লাগল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেল যে, এমন একটা বাড়িও দেখানো সম্ভব হচ্ছিল না যে বাসায় ডাকাতি হয়নি। একবার এ দেশের প্রেসিডেন্টের বাড়িতেই ডাকাত পড়ল। প্রেসিডেন্ট ডাকাতদের বলল- তোমরা কি বুঝতে পারছ না যে তোমরা কার বাড়ির সম্পত্তি চাচ্ছ। আমি এ দেশের প্রেসিডেন্ট। তোমরা আমার বাড়ির সম্পত্তি চাইতে পার না। তখন ডাকাত দলের এক মশা বলেছিল- তাহলে তো আরও ভাল হল। আমার আপনার সম্পত্তি চাচ্ছি না। আমরা আমাদের সম্পত্তিই চাই।

বড়দের রূপকথা-৩১

গরুদের দেশে রাষ্ট্রীয় টিভির নাম ছিল গরু টিভি। একবার সে দেশের গরু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে টিভিতে সরাসরি প্রশ্নোত্তরে ডাকা হল। সে অনুষ্ঠানে একজন জিজ্ঞাসা করলেন- আচ্ছা বলুন তো গরু আর আস্তিক-নাস্তিক ইস্যুর মধ্যে পার্থক্য কি? গরু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এর উত্তর দিতে পারেন নি। অনুষ্ঠান শেষে এর উপস্থাপক উত্তরে বলেছিলেন- গরু ১০ বছর পরে আর দুধ দিতে পারে না। কিন্তু আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু পারে।

বড়দের রূপকথা-৩২

একবার কবুতরের দেশে একটা সমস্যা বেধে গেল। অসংখ্য কবুতর কবিতা লিখা শুরু করল। যাকে দেখা যায় সেই কবি। কবিতা লেখাটা সমস্যা ছিল না। কিন্তু যারা কবিতা লিখত, তারা শুধু কবিতাই লিখত না। তারা একই সাথে যারা আমলা কবি ছিল তারা ঘুষ খেত, ধর্ষণ করত। যারা সাংবাদিক কবি ছিল তারা মিথ্যা সংবাদ প্রচারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করত। যারা এনজিও কবি ছিল তারা গরীব মানুষের নামে টাকা এনে নিজেরা খেয়ে ফেলত। এমনকি অন্যের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়াও যথারীতি রেওয়াজ হয়ে দাৎড়াল। এসব এত বেশি বাড়তে লাগল যে কবিদের অত্যাচার একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এ সময় সংসদে প্রস্তাব করা হল, কবিদের দুর্নীতি দমনে যেন দুর্নীতি দমন কমিশন বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। দুদক একটি বিশেষ সেল গঠন করল। একবার এক কবির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে দুদক মামলা করল। মামলার জেরায় কবি বলল-কবিরা সমাজে সব করতে পারে। কারণ সে কবি। আর প্রেম তো অবশ্যই। এনজিওদের প্রেম যৌন হয়রানি হিসেবে দেখা একটা স্বভাব। এরা কোনও একটা মেয়েকে দেখে হাসলেও যৌন হয়রানির গন্ধ পায়। এনজিওরা যে প্রেমকে যৌন হয়রানি হিসেবে দেখে, তাদের জীবনে কখনই প্রেম আসবে না।

বড়দের রূপকথা-৩৩

প্রেসিডেন্ট ব্যাঙ খুব চিন্তিত। কারণ ভারত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। পাকিস্তানও চালিয়েছে। চীন আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে যেতে পারে শীঘ্রই। হয়ত তারও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।

উপদেষ্টা ব্যাঙ বললেন, স্যার এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

প্রেসিডেন্ট বললেন, মানে ? এটা চিন্তার বিষয় নয়।

উপদেষ্টা বললেন, না। কারণ কয়েকদিন পর তারা পারমাণবিক অস্ত্রের কথা ভুলে যাবে। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়বে ভায়াগ্রা কিনতে।



বড়দের রূপকথা-৩৪

বাঘ একবার খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল না তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি। উদেদশ্য কি তার জীবনের। অনেক খুঁজে খুঁজে সে বের করল কারও জীবনের সমস্যা সমাধান করাই তার জীবনে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। তারপর সে নানা সমস্যা সমাধান করতে থাকল। নানা বিপদ থেকে অনেককে রক্ষা করতে থাকল।

একবার সে বিপদে পড়ল। কিন্তু সে কোথাও খুঁজে পেল না এমন কাউকে যে তাকে এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে।

বড়দের রূপকথা-৩৫

একজন বিখ্যাত শকুন রাজনীতিবিদ আকাশে উড়তে উড়তে খেয়াল করলেন, একটা শিশু কাঁদছে। শকুন শিশুটির কাছে এসে জিজ্হাসা করলেন- তুমি কাঁদছ কেন?

শিশুটি বলে- তার বাবা ৫ বছর আগে মারা গেছেন।

শকুন রাজনীতিবিদ বলেন, এটা আসলেই কষ্টের। কিন্তু উনি তো ৫ বছর আগে মারা গেছেন। এখন কাঁদছ কেন?

শিশুটি বলে, কিন্তু আজ তার বাবা ভোট দিতে এসেছিলেন; অথচ তার সাথে দেখা করেন নি।

বড়দের রূপকথা-৩৬

একজন সত্যিকারের গণতন্ত্রকামী গাধা হেঁটে যাচ্ছিল আর বুঝতে পারছিল না কাকে ভোট দেওয়া উচিত নৌকা না ধানের শিষ।

গাধা একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে ভোটে দেওয়া উচিত।

সে উত্তর দিল- নৌকা

গাধা আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে ভোট দেওয়া উচিত।

সে বলল- ধানের শিষ।

গাধা সত্যি বিপদে পড়ল। সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল-তার কাকে ভোট দেওয়া উচিত।

তার স্ত্রী বলল- নৌকা আর ধানের শিষ দুটিই পদার্থ। তোমার অপদার্থ কাউকে ভোট দেওয়া উচিত।

বড়দের রূপকথা-৩৭

বানরদের দেশে একবার একটি সমস্যা বেশ প্রকট হয়ে পড়ল। বানরদের মধ্যে এমন দুই দল দেখা গেল যাদের দুই দল নেতা সব সময় বিপরীতি মুখী অবস্থানে থাকে। যেমন ধরেন একদল বানরের দলনেতা যদি উত্তর দিকে ঘর বানায়, আরেক দল বানরের দলনেতা ঘর বানায় দক্ষিণ দিকে। এক বানর যদি ডান হাত দিয়ে খায়, অন্য দলনেতা বানর খায় বাম হাত দিয়ে। এক দলনেতা বানর যদি আস্তে কথা বলে, আরেক দলনেতা বানর কথা বলে জোরে জোরে। এক বানর যদি ডান দিকে যেতে বলে, আরেক বানর বাম দিয়ে চলে যায়। দুই দলনেতা বানর নিয়ে বানরেরা রীতিমত সমস্যায় পড়ে গেল। তাদেরকে নিয়ে কোনোভাবেই কোনোকিছুই বানরেরা ভাতে পারছিল না।  হঠাৎ বানরদের মাথায় বুদ্ধি আসে। তারা দেখতে চায় দুই দলনেতা বানরকে একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হলে তারা কি করবে। হয়ত তাদের মধ্যে মিল হয়েও যেতে পারে। যথারীতি সব বানর এই  বুদ্ধিতে সায় দিল। দুই দল বানরেরা সবাই দিন তারিখ ঠিক করে একটি জায়গায় দুই দল নেতা বানরকে রেখে দিল। দুই দলনেতা বানর অনেকদিন পর নির্জন ঘরে দুইজনকে পেয়ে সত্যিকার অর্থে খুশিই হল। তারা তাদের নানা বিষয় নিয়ে গল্প শুরু করল। তাদের এই যে গল্প শুরু হল, তা যেন আর থামতেই চাইল না।

বড়দের রূপকথা-৩৮
বানরদের দেশে এক বানর লেখক মনে করতেন লেখকের লেখায় অবশ্যই লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং একজন লেখক তিনি যে রাজনীতি বিশ্বাস করেন তাই তার লেখায় নিয়ে আসেন এবং লেখকের এভাবেই রাজনৈতিক অবস্থান থেকে লেখা উচিত যেন তার কোনও গল্প বা উপন্যাস বা অন্য কোনও লেখা লেখকের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধী না হয়ে ওঠে।

সেই বানর লেখক নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন এবং তারপর লিখেন যাতে করে তার কোনও লেখায় শিল্পের স্বার্থে হলেও যেন নিজ রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরে না যায়। এইভাবে সেই বানর লেখক লিখতে থাকলেন। কেউ কেউ বলতে লাগল আপনার লেখা কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে ওঠছে। অরও কিছুদিন পর কেউ কেউ বলতে লাগল, আপনার লেখা আগের মত নেই, কেমন যেন হয়ে গেছে, ভাল লাগছে না। কেউ বলতে লাগলেন, তার লেখা প্রচণ্ড রাজনৈতিক হয়ে ওঠছে। তা লেখায় রাহনৈতিক মেনিফেস্টেশন অনেক বেশি। সর্বশেষ তার সমালোচনা গিয়ে দাড়াল তিনি শিল্প লিখেন না, লিখেন রাজনীতি।

একদিন বনমন্ত্রী বনের ভিতর হাটতে হাটতে সেই বানর লেখকের দেখা পেলেন। বনমন্ত্রী দূর থেকে দেখছিলেন, একটি বানর আইন অমান্য করে বনের গাছ খেয়ে ফেলছে। মন্ত্রীর মনে হল, বানরকে উচিত শিক্ষা না দিলে বানরের পক্ষে কখনই বনের আইন বোঝা সম্ভব নয়। তাই বনমন্ত্রী বানর লেখকটিকে গুলি করে মেরে ফেললেন।  বানর লেখকের সমালোচকেরা বলতে লাগল, শিল্পের কারণে নয; রাজনৈতিক কারণেই প্রাণ গেল বানর লেখকের।

বড়দের রূপকথা-৩৯

এক দেশে এক সিংহ সব সময় খুবই গম্ভীর হয়ে থাকত আর বিভিন্ন জায়গায় বলত এই দেশে কিছু হবে না। এই দেশে যারা চিন্তা করে তারা সবাই মান্ধাতা আমলের চিন্তা করে। এই দেশ কখনই আগাবে না। এই সিংহটি ভাবত সে চিন্তায় সবার চেয়ে এগিয়ে। যে কোনও বিষয়ে সে তর্ক করতে আসত। আর প্রমাণ করতে চাইত তার মত করে এই দেশে কেউ আর ভাবে না। তার চিন্তা থাকত উন্নত বিশ্বের মত। এভাবে চিন্তার অমিলের কারণে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। ক্রমশ সে নিজে নিজেই একা হয়ে যাচ্ছিল আর বলছিল এই দেশে থেকে তার কিছু হবে না। এই দেশের কিছু হবে না। সিংহটি সত্যিকার অর্থেই অনেক একা হয়ে গেল। তাকে এখন আর যেখানে সেখানে দেখা যায় না। যেখানে সেখানে নয় অনেক ধরেই তাকে কোথাও যেতে দেখা যায় না। অন্যান্য সিংহরা যারা এই সিংহ থেকে দূরে থাকত, তারা ব্যাপারটা খেয়াল করল। একদিন তারা ওই সিংহকে দেখতে গেল। অন্যান্য সিংহরা সিংহটিকে বলে আসল, উন্নত চিন্তা করতে করতে যারা একা আর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা আসলে অনুন্নত আর পিছিয়ে পড়ার চিন্তাই করে। যে চিন্তা বিচ্ছিন্ন করে দেয় সে চিন্তা না করাই ভাল।

বড়দের রূপকথা-৪০

বিড়ালদের দেশে এক অদ্ভুত রোগ দেখা গেল। সমস্ত বিড়ালদের মধ্যে একটি মানসিক রোগ দেখা গেল। একই সময়ে প্রায় সব বিড়ালের মানসিক রোগ বিড়ালদের ইতিহাসে দেখা যায়নি। রোগটি ছিল বিড়ালরা মিউ মিউ না করে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল। বিড়ালদের দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে প্রায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। বিড়ালরা মিউ মিউ না করে কেন ঘেউ ঘেউ করছে। এটা তো হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ করে এত বিড়ালের মধ্যে এই রোগ কিভাবে ছাড়াল কেউ বুঝতে পারছিল না। বিড়াল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ডাকা হল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করলেন এই রোগ সাড়ান সম্ভব। তিনি জানালেন, ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে রোগের সিম্পটম স্টাডি করেছে।  আরও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। কমিটি কাজ করতে প্রায় সব সদস্যরা এই রোগে আক্রান্ত হলেন। তারাও যথারীতি ঘেউ ঘেউ শুরু করলেন। এক মাস যেতে না যেতেই বিড়াল স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও এই রোগে আক্রান্ত হলেন। তিনিও  মিউ মিউ না করে ঘেউ ঘেউ শুরু করলেন। সরকার প্রধান এবার সত্যি বিস্মিত হলেন। এবং ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি এই রোগ এত ভয়াবহ মহামারী রূপ নেওয়ায় জাতিসংঘের দ্বারস্ত হলেন। জাতিসংঘের বিশেষ দলে এসে এই রোগের প্রতিকার বার করলেন। সব বিড়ালরা আবারও মিউ মিউ করা শুরু করল। কিন্তু এবার সরকার প্রধানেরই এই রোগ হল। সরকার প্রধানের ঘেউ ঘেউ করার সিম্পটম দেখা মাত্র জাতিসংঘ তাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিল এবং দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে  ও রোগ ভাল না হওয়া পর্যন্ত দেশের বাইরেই থাকতে বলল। বাধ্য হয়ে দেশের ভার অন্য কারও কাছে দিয়ে সরকার প্রধানের অন্য দেশে যেতে হল। সরকার প্রধানের এই ঘেউ ঘেউ রোগ ভাল না হওয়ায় আর তিনি দেশে ফিরতে পারেন নি।

বড়দের রূপকথা-৪১

কবুতরদের দেশে একবার একটি জাতীয় বিতর্ক দেখা গেল। কবুতররা বলল-চিঠি এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত আদান প্রদানের মাধ্যমেই কেবল তথ্য থাকতে পারে অন্য কোনভাবে নয়। কিন্তু কবুতর তথ্যমন্ত্রী বলল- সময় পাল্টিয়েছে। এখন কবুতররা ঠোঁটে করে কেবল চিঠি এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যায় না। এখন নানাভাবে চিঠিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র আদান প্রদান হয়। কাজেই তথ্যের সংজ্ঞা এখন আর আগের মত নেই। এটা নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ বড়ই হতে লাগল। এক সময় হরতালও ঘোষণা করা হল। দেশের বড় অংশের কবুতর মনে করতে লাগল সরকার বিশেষ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তত্যের সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে। তারা এর প্রতিহত করতে হবে বলে হরতালে ঘোষণা দিল। কিন্তু কবুতরদের একটি অংশ তথ্যের সংজ্ঞা পাল্টানোটা সমর্থন না করলেও হরতালও সমর্থন করল না। যার ফলে আন্দোলন খুব একটা দাঁড়াল না। একদিন তথ্যমন্ত্রীর তথ্যের সংজ্ঞাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থান পেল। কেবল কবুতরদের বড় একটা অংশ দেখতে পেল দেশ মিথ্যা তথ্যে ভরে গেছে।বড়দের রূপকথা-৪২

একবার গরুদের দেশে অধিকাংশ গরু কৃষিমন্ত্রীর কাছে এই মর্মে বিচার দিল যে তারা কোনও ধান বা অন্য কোনো শস্য ঘরে তুলতে পারছেন না। ঘরের তোলার আগেই সেসব খেয়ে ফেলছে শালিখ পাখি। কৃষিমন্ত্রী বললেন, এটা দেখা তো আমার দায়িত্ব না। শস্য বা ধান ভাল ফলেছে কিনা, সেটা আমি দেখেছি। এটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ। কারণ শস্য ফলার পর কেউ  এসব খেয়ে ফেলছে। গরুরা

সবাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমস্ত কথা শুনে বললেন, এই কাজ গরুদের মধ্যে কেউ করলে আমরা তাৎক্ষণিক বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তুএই কাজ যারা করছে তারা কেউই আমাদের প্রজাতির নয়। তাছাড়া এদেরকে শায়েস্তা করতে সরকারের বড় একটা তহবিল শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া সরকার একা পাবে কিনা এটাও সন্দেহের।

তবে একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেতেপারে। গরুরা যেখানেই শালিখকে দেখবে তখনই শালিখকে তাড়া করবে। এই ক্ষেত্রে সরকার গরুদের বিশেষ সহায়তা দিবে। গরুরা এতে রাজি হল। এরপর থেকে এখনও গরুরা শালিখ দেখলে তাড়া করে। আর শালিখ সুযোগ পেলেই গরুর ঘাড়ে ওঠে বসে থাকে।

বড়দের রূপকথা-৪৩

শিয়ালদের দেশে শিয়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন যেদেশে এত পরিমাণ চুরি বেড়ে গেছে যে এখন চুরি করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বললেন ঠিক আছে আইন সংশোধন কর।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকদিন প্রধানমন্ত্রী জানালেন যে ডাকাতি এত বেড়ে গেছে যে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বললেন ঠিক আছে তাই করুন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার আরেকদিন প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন দেশে এত পরিমাণ মিথ্যা বেড়েগেছে যে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বললেন ঠিক আইন সংশোধন করুন।

দেশে প্রায় ৬ মাস চুরি ডাকাতি মিথ্যা বলা একদম থেমে গেল। সরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অভাবনিয় সাফল্যে পুরস্কারও পেলেন। ৬ মাস পরে হঠাত এক সময় চুরি-ডাকাতি-মিথ্যা বলা এত পরিমাণ বেড়ে গেল যে সরকার আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খেল। কয়েক মাস পর সরকার চুরি-ডাকাতি-মিথ্যা বলার শাস্তি মৃত্যু রহিত করে লঘু শাস্তির সিদ্ধান্ত নিল।

বড়দের রূপকথা-৪৪

শিয়ালরা মুরগি ধরে খেয়ে ফেলে বলে মুরগিদের এমন জায়গায় রাখা হল যাতে শিয়াল টের না পায়। কিন্তু শিয়াল যথারীতি টের পেল এবং মুরগি ধরে খেল। এইভাবে যতবারই মুরগি শিয়াল থেকে দূরে থাকে, পালিয়ে থাকে, আড়ালে লুকিয়ে থাকে; ততবারই শিয়াল মুরগিকে দেখতে পায় এবং তা ধরে খায়।

একবার মুরগিদের প্রধান কে জিজ্ঞাসা করা হল- আপনারা কেন এর বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান নিচ্ছেন না বা বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছেন না। মুরগি জানাল- আমরা অবশ্যই প্রস্তুতি নিয়েছি এবং এখনও নিচ্ছি। কিন্তু আমরা এটা বুঝেছি যে শিয়ালরাই রাজনীতিবিদের জাতি কারণ তারা মুরগি ধরে খেতে পারে।  আমরা এই রাজনীতির অবসান চাই।

বড়দের রূপকথা-৪৫

বাদুরদের দেশে একবার এক বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটি খুব বেশি দিন আগেও নয়। সে দেশের সেনাবাহিনী প্রতি রাতে বাদুরদের হত্যা করত। সন্ধ্যা হলেই সেনাবাহিনী নেমে পড়ত আর বাদুরদের খুঁজে বেড়াত। কিন্তু কোনও বাদুর এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারত না। একসময় এমন এক অবস্থা দাড়াল দেশে আর বাদুরই দেখা যেত না। এর বেশ কিছুদিন পর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনির সবাই এ‌ই দুর্যোগে মারা যায়।  কিছু বাদুর বেঁচে যায়। এরাই এখনও দিনের বেলা বের হয় না যাতে কেউ বুঝতে না পারে বাদুর বেঁচে আছে আর রাতের বেলা বের হয় যাতে সেইসব সেনাবাহিনীকে তারা মেরে ফেলতে পারে।

বড়দের রূপকথা-৪৬

এক সময় হাঁসের বাচ্চারা ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার সাথে সাথেই সাঁতার পারত না। যে সমস্ত হাঁস বড় বড় নেতা ছিল তারা তাদের ছেলেমেয়েদের জলে ডুবে মরার আশঙ্কায় দেশের বাইরে শিক্ষা নিতে পাঠাত। যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে শিক্ষা নিত তাদের ছেলেমেয়েরাও এ ব্যাপারে আরও অনেক শিক্ষা পেত। ধীরে ধীরে এদের সংখ্যাই বাড়তে লাগল। এক সময় এমন অবস্থা হল যে হাঁসের ছেলেমেয়েদের আর শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর দরকার হল না। কারণ হাঁসের ছেলেমেয়েদের কোনও ধরনের শিক্ষা দেবার আগেই মানে বাচ্চা ফুটেই তারা জলে নেমে যায় এবং সাঁতার কাটতে পারে।

বড়দের রূপকথা-৪৭

এক সময় শিয়ালরা দিনের বেলা বের হত। নানা কাজ করত, খাবার সংগ্রহ করত। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল তারা যে সমস্ত কাজ করে মানুষও একই রকম কাজ করে, তারা যেভাবে কথা বলে, চিন্তা করে,  মানুষও সেভাবে কথা বলে চিন্তা করে। শিয়াল যে সমস্ত জায়গায় যায়, কাজ করে মানুষও সেসব জায়গায় যায়, কাজ করে। একবার তাই শিয়াল আর মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধল। শিয়ালরা মানুষের সাথে পরাস্ত হল। তাই এখন আর তারা দিনের বেলা বের হয় না। বের হয় রাতের বেলা। আর সুযোগ পেলে মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়।

বড়দের রূপকথা-৪৮

কুকুরদের দেশ একবার দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল কুকুর চুপচাপ থাকত আর আরেক দল কুকুর ঘেউ ঘেউ করত। এই দুই দলের বিভক্তি এতটাই বেরে গেল যে এদের মধ্যে একবার প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধে যে সমস্ত কুকুরেরা চুপচাপ থাকত তারা হারল। দেশে এরপর ঘেউ ঘেউ করা কুকুরে ছেয়ে গেল। তাই তখন থেকে দেশে শুধুমাত্র  ঘেউ ঘেউ করা কুকুরই দেখা যায়।

বড়দের রূপকথা-৪৯

শিয়ালরা একবার সন্ত্রাসী কারা এবং কোন কাজকে সন্ত্রাস বলবে তা বুঝতে পারছিল না। একজন শিয়াল বলল- সব সন্ত্রাস সন্ত্রাস নয়। কোনও সন্ত্রাস যদি ধর্মের জন্য হয়, তাহলে সেটা সন্ত্রাস নয়। ধর্মের জন্য যুদ্ধ করা যায়।

আরেক শিয়াল বলল- সব সন্ত্রাস সন্ত্রাস নয়। কোনও সন্ত্রাস যদি আদর্শের জন্য হয যেমন মার্কসবাদ, তাহলে সেটা সন্ত্রাস নয়। বিপ্লবের জন্য যুদ্ধ করা যায়।

অন্য আরেক শিয়াল বলল- সব সন্ত্রাস সন্ত্রাস নয়। কোনও সন্ত্রাস যদি পেটে ভাত যোগারের জন্য হয় , তাহলে সেটা সন্ত্রাস নয়। বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করা যায়।

শিয়ালরা সমাধানে আসতে পারছিল না। সন্ত্রাসী শব্দটা ভাল অর্থে ব্যবহার করা ঠিক হবে, না খারাপ অর্থে। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নিল সন্ত্রাস মানে প্রচলিত অর্থে ত্রাস নয়। এর ভিতর দিয়েই শিয়ালদের দেশ সন্ত্রাস শব্দ ও কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিল।

বড়দের রূপকথা-৫০

এক সময় বিড়ালরা খুব পরিশ্রমী ছিল। তাদের নিজেদের দেশ ছিল। অনেক উন্নত ছিল তাদের দেশ। তারা সকালে উঠত। কাজ-কর্ম করত। তারপর রাত হলে ঘরে যেত । পরিবারকে সময় দিত। ক্লান্তি এলে ঘুমিয়ে পড়ত। তারা এতটাই উন্নতি করল যে আশপাশ কোন, পৃথিবীর অন্য কোনও দেশই তাদের সাথে পারল না। জিডিপি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান থেকে শুরু করে সবকিছুতে তারা এত বেশি আগানো, এত বেশি উঁচুতে ছিল যে অন্য কোনও দেশ চিন্তাই করতে পারত না তারা বিড়ালদের দেশের কাছাকাছি আসতে পারবে।

একবার বিড়ালদের দেশের সরকার প্রধান ঘোষণা দিল, আমরা দেশের এতটাই উন্নতি করেছি, দেশের জন্য এতটাই পরিশ্রম করেছি যে সমস্ত বিশ্ব এখন আমাদের কাছে মাথানত করে থাকে। আমাদের অবস্থান এতটাই উঁচুতে যে আগামী একশ বছর। আমাদেরকে কেউ নাগাল পাবে না। সরকার প্রধান ঘোষণা দিলেন, আমরা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য অনেক করেছি। এখন আমাদের আরাম- আয়েসের সময়। বিড়ালরা যে যার মত ছুটি নিয়ে সময় কাটাতে লাগল। এইভাবে তারা প্রায় ৫০ বছর কাটিয়ে দিল।

হঠাতই তারা খেয়াল করল এইভাবে অলস সময় কাটালে তারা এবার পিছিয়ে পড়বে। সরকারপ্রধান সবাকে ছুটি বাদদিয়ে কাজে যোগ দানের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু কোনও বিড়াল কাজ করতে চাইল না। বরং তারা ছুটি নিয়ে কাটাতেই পছন্দ করত। এইভাবে আরও পঞ্চাশ বছর পর তারা দেউলিয়া হয়ে গেল। কিন্তু  আর আগের মত পরিশ্রম করে কিছু করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলল। এইভাবে বিড়ালরা তাদের দেশ হারাল। আস্তে আস্তে মানুষ বিড়ালদের দেশ দখল করল।  আর বিড়ালরা মানুষের ঘরে থাকা শুয়ে করল। এভাবে  বিড়ালরা মানুষের বিছানায় শুয়ে থাকতে শিখল । উচ্ছিস্ট খাবার খেতে শিখল। এটা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ বিড়ালকে তাড়িয়ে দিলেও বিড়ালরা আবারও মানুষের ঘরে আসে, প্রয়োজনে চুরি করে খাবার খায়। মানুষের নরম বিছানায় শুয়ে থাকে।